× home হোম archive আগের ওয়েব সংখ্যা panorama ডুয়ার্স সম্পর্কে play_circle_filled ভিডিও file_download মুদ্রিত সংখ্যার পিডিএফ library_books আমাদের বইপত্র
people এখন ডুয়ার্স সম্পর্কে article শর্তাবলী security গোপনীয়তা নীতি local_shipping কুরিয়ার পদ্ধতি keyboard_return বাতিল/ফেরত পদ্ধতি dialpad যোগাযোগ
login লগইন
menu
ad01112021081913.jpg

ক্যাসেট থেকে নেট যুগে! কতটা পথ পেরোলে তবে পুরুষ হওয়া যায়?

ধীমান সান্যাল
A journey from cassette to net
Pic courtesy: unsplash.com

আমাদের বড়ো হয়ে ওঠার গল্পগুলো খুব বেশি বলা হয় না। হয়তো সংকোচ কাজ করে কোথাও, কিংবা ভয়, লজ্জা। আনন্দমেলায় ধারাবাহিকভাবে পান্ডব গোয়েন্দা বের হত। হাঁদা-ভোঁদা, নন্টে-ফন্টে, বাঁটুল দি গ্রেট, চাঁদমামা, শুকতারা পেরিয়ে সদ্য পা রেখেছি তখন। শৈশব ছেড়ে কৈশোরে বিকেলগুলোর হাফ প্যাডেল ছেড়ে ফুল প্যাডেল। চোখের সামনে খুলে যাচ্ছে আনন্দলোক। নবকল্লোল এসেছে জীবনে। ফলে খেলা ছেড়ে এপাড়া-ওপাড়া টহল। দলবেঁধে হাঁটতে বেরোয় যে হাঁসেরা আমি সেই দলের নাম না জানা কেউ… গোঁফের রেখার বৃদ্ধি দেখতে আয়নাচুরির দুপুর। যে মেয়েরা পাড়ার ফাংশনে ভালো নাচে, প্রাইজ পায় আমি মনে মনে তাদের পাশে হাঁটি। স্কুলের টিফিন পিরিয়ডে স্বর্গের দরজা খুলে দিতে থাকে…
বন্ধুরা সবাই মিলে চাঁদা দিয়ে আনন্দলোক আর নবকল্লোল কেনা হত। সেফ হোমে রাখা হত। সুযোগ বুঝে প্লেন মাঠের এককোণে নিষিদ্ধ মৌতাত। ডাব্বু রত্নানির ক্যামেরা আর আমাদের নিজেদের চোখজোড়া তখন শত্রুপক্ষের ড্রোনকেও হার মানাত। বিষয় তখন গৌণ, আসল হল উত্তেজনা। শরীর জুড়ে অবাধ্য কাঁপুনি। না ঝাঁকুনিটা তখনো শুরু হয়নি। সেই প্লেনমাঠের ব্রিটিশ ব্যাপারটাই আস্তে আস্তে উধাও হয়ে গেল। সেই রাজবাড়িটাও চোখের সামনে ধুলো হয়ে যেতে দেখলাম। 
আমার ভুবন তখন আধা শহর আধা মফস্বল। এই নিস্তরঙ্গ জীবনে পড়ার ব্যাচে কোনও আধুনিকা এলে নিজেকে একদম 'রঞ্জনা আমি আর আসব না' মনে হওয়া আমি ইনফেরিয়র কমপ্লেক্স নিয়ে শিক্ষক দিবসের উপহার গিফট কিনতে যেতাম।
একটা সদ্য ফোঁটা ফুল মনে হত শহরের সকালকে। জিনস্ ছিল না। টি শার্ট থাকলেও তাকে কী বলে তা না জানি না। শার্ট ছিল প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বড়ো। তবু আমরা ঘুরে বেড়াতাম। বাড়ি ফিরতে দেরি হলে চোখ আর কানটা একটু নামিয়ে নিলেই চলত। সকাল ছিল, দুপুর ছিল, বিকেল আর সন্ধে ছিল। সন্ধে পেরোলেই সারাদিন শেষের স্মৃতিচারণ আর ক্লান্তি ভুলে পড়াশোনা। পাশের রান্নাঘর থেকে মায়ের রান্নার ছ্যাঁকছোঁক। রাত বাড়লে ঘুম পেত। হয়তো ঘুমিয়েই পড়েছি। ডেকে তুলে মা যখন খাইয়ে দিত সেটা ছিল সেই অভিজ্ঞতা, যেগুলো বহুবার বহুজন বহুভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, পারেননি। কারণ প্রত্যেক মায়ের গায়ের গন্ধ আলাদা।

(২)

ভদ্র আমি আর সেয়ানা আমির মাঝে ব্যবধান ছিল বাড়িটুকু থেকে খেলার মাঠ। মাঠ পেরিয়েই ছুট ছুট ছুট। আমাদের কোনও রেললাইন ছিল না, কিন্তু প্লেনমাঠ ছিল। কখনও কখনও নির্জন দুপুরে সেই জায়গাটা ইংল্যান্ডের কোন কাউন্টি ভেবে কল্পনা করে নিজেকে ব্রিটিশ ভেবে গলায় ঢেলেছি ঠান্ডা তীব্র বিয়ার। ‘চিল্ড’ শব্দটার সাথে তখনও পরিচয় হয়নি। সিগারেটের প্রথম সুখটানও সেখানেই। তারপর তেজপাতা এলাচ আরও কত কী ভেষজ উপাদান!
আমরা তথাকথিত কোনও যুদ্ধ দেখিনি, বিপ্লব দেখিনি কিন্তু আটপৌরে জীবন থেকে আস্তে আস্তে যন্ত্রের একটা পরিবর্তন ঘটতে দেখেছি, যদিও খুব ধীরে তবুও তার প্রভাব আমরা শরীরে ও মনে ভালোই টের পাচ্ছিলাম। প্রথমে সেই ম্যাগাজিনগুলোর কন্টেন্টের বদল ঘটল, কভার স্টোরির বদলে স্থান পেল নায়ক নায়িকাদের ব্যক্তিগত কেচ্ছা কেলেঙ্কারি এবং তাদের রগরগে উষ্ণ ছবি। সাহিত্যগুণ হারাতে বসল আনন্দলোক এবং সমসাময়িক অন্যান্য পত্রিকাগুলি। আর এর জায়গা নিল অন্য ধরনের বইয়েরা। যে বইয়ে গল্প থাকে, নিষিদ্ধ সম্পর্ক থাকে, যৌনতা থাকে ফ্রি-তে। সাহিত্য পদবাচ্য নয় কিন্তু রসে টইটুম্বুর। সেই উপচে পড়া যৌনতার নেশার ঠিকানা ভবানী সিনেমা হলের উল্টোদিকের ফুটে এক ছোট্ট দোকান। হলুদ মলাট। মাঝে মাঝে সাদা কালোতে ছবি। সেই ছবি দেখেই প্রথম প্রথম কান মাথা গরম। প্রথম এক না বলতে পারার মত ঝাঁকুনি এল শরীরে। সামলে নিলাম। পরে কাহিনী ছাড়া আরেক রকমের বই ছড়িয়েছিল উন্নত মলাট আর ল্যামিনেটেড পেপারে। কিন্তু বাজারে থাকতে পারেনি বেশিদিন। কারণ গল্প ছাড়া কেউই কিছু বিশ্বাস করতাম না আমরা। 
জেনকিন্স স্কুলের মোড়ের এক দোকানে ছিল রঙিন স্টিকার, জলছবি, দেশ-বিদেশের ষ্ট্যাম্পের কালেকশনের আটপৌরে গ্যালারি। কেনার সামর্থ্য অনেক সময় না থাকলেও দেখতে তো পয়সা লাগত না। টিফিনের ঘন্টা পড়লে দূর থেকে শুনেই দে দৌড়… আর একটা ঠিকানা ছিল, সেখানে গেলেই বিহারি মালিক কেন যেন দূর দূর করে তাড়িয়ে দিত। তবু দাঁড়িয়ে থেকে বই ঘাঁটতাম। গোটা জেলার পুরোনো বই পাওয়া যেত সেখানে। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন ম্যাগাজিন, জার্নাল, ছবি মনের জানালা খুলতে শুরু করে দিয়েছিল। ওটাই তখন আমার একলা কলেজ ষ্ট্রিট। ইম্প্রেশনিজম, পোষ্ট ইম্প্রেশনিজম, কবিতার দিকবদল, প্যারিস জুড়ে একের পর দীর্ঘদিনের প্রচলিতের ফর্ম ভেঙে ফেলা সব কিছু ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে বোঝার চেষ্টা করছিলাম। তখন তো এতো কিছু বুঝতাম না। আস্তে আস্তে বোঝার চেষ্টা করি এখনও। আর বুঝতাম পাল্টে যাচ্ছিল আমার চারপাশটা। আমাদের চারপাশটা।

(৩)

বাড়িতে যে বইগুলোর ঢোকার অধিকার ছিল সেগুলোর মলাটে ঢুকতে থাকল হলুদ নিষিদ্ধ বইগুলি। এ বাড়ি সে বাড়ি ঘুরে ঘুরে সে বইএর তখন পয়সা উশুল। পাড়ার অল্পবয়স্ক সংবাদপত্র বিক্রেতার কাছেই পাওয়া যেত নতুন আগমনের খবর। আবার পয়সা জমানো, আবার বই ঘুরত বাড়ি সে বাড়ি। কিছুদিন পর গল্পগুলো মোটামুটি প্রেডিক্টেবল হয়ে যেতে লাগল, ঠিক এখনকার বি গ্রেড হিন্দি সিনেমার মত। উৎসাহ হারিয়ে গেল তাই। তবুও কালেকশনটা রাখা থাকত নিয়ম করে, ঘুরে ঘুরেই। 
আরো একজনের বই আমরা লুকিয়ে পড়তাম সেই সময়। ফেলুদা কাকাবাবু যদি এলিট ক্লাস হন ইনি একদম আমাদের পাড়ার গোয়েন্দা। ভক্তরা নাক সিঁটকোত। কিন্তু স্বপন কুমারের গোয়েন্দা কাহিনির তাৎক্ষণিক উত্তেজনা ফেলূদা ব্যোমকেশকেও পেছনে ফেলে দিত সেই সময়। টানটান উত্তেজনার সেইসব দিনগুলোতে ভালো মন্দ বোঝার মন তৈরি হয়নি। আর মেমোরি কার্ড ফাঁকা ছিল, যা পেয়েছি লোড করে গিয়েছি। আর কদিন পর ক্লাউড ষ্টোরেজের পয়সা দিতে হলে এগুলো হয়তো ডিলিট হয়ে যাবে। 
ভবানীগঞ্জ বাজারের ভেতরে একটা গলি। দোকানগুলো বিভিন্ন বিদেশি বিশেষ করে চাইনিজ মালে সাজানো। গলি দেখে মনে হত গরীবের একটুকরো হংকং নেমে এসেছে শহরে। সেখানকার প্রথম কিনতে চাওয়া মহার্ঘ বস্তুটির নাম ছিলো ওয়াকম্যান। অডিও ক্যাসেটের চাইতে ধারে ও ভারে একটু বড়ো। ব্যাটারিতে চলে আবার কারেন্টেও। ছোট্ট একটা স্পীকার থাকলেও হেডফোনে বেশি স্বচ্ছন্দে শোনা যেত। ব্যস ওয়াকম্যানের হাত ধরে একে একে বিভিন্ন দেশি বিদেশি পপ, রক, ইন্ডিপপ, মাইকেল জ্যাকসন, ব্যাকষ্ট্রিট বয়েজ, কেনি জি, আলি আকবর, ইউফোরিয়া প্রবেশ করলো। দরজা খুলতে লাগল একের পর এক। 
ওয়াকম্যান গিয়ে সিডি এল। একটা এমপিথ্রি সিডিতে একসাথে দেড়শোর বেশি গান আঁটে! এটা ছিল আমাদের কাছে মহাজাগতিক বিস্ময়। সেই সিডি আবার কুড়ি টাকা দিয়ে কিনতে পাওয়া যায়। আবার কিছুদিনের মধ্যেই সিডি গিয়ে ডিভিডি এল। সিনেমা গান সব চাইলেই হাতের মুঠোয়। যে পথের পাঁচালি দেখার জন্য প্রতিবার গরমের ছুটির অপেক্ষা করতাম সেই অপেক্ষা আর রইল না। একটা বোতাম টিপলে ছবির পর ছবি। সত্যজিৎ স্পিলবার্গ নোলান কিউব্রিক ক্লিন্ট ইষ্টউড মৃণাল সেন সবাই তখন হাতের মুঠোয়।
আজ মোবাইলে নেট থাকলে এক ক্লিকে সব হাজির। গুগল করো। ম্যাপ দ্যাখো। সিনেমা দ্যাখো। গান শোনো। চ্যাট করো। টেক্সট করো। কয় পা হাঁটলে তার হিসেব রাখো। কত ক্যালোরি ঝরে গেল তার হিসেব দ্যাখো। এমনকি জল খেতে হবে কিনা সেই নির্দেশও পালন করো। এটা টেকনোলজির যুগ। তাল মেলাতে হবে বৈকি। প্রিয় বান্ধবীর বিয়ের পিঁড়ি ধরার মতো এখানে কোনও মনখারাপ নেই। প্রিয় বন্ধুটি টেক্সাস থেকে আর ফিরবে না জেনেও এখানে কোনও মনখারাপ নেই। একটা, বড়োজোর দুটো প্রজন্মের কাছে এগুলো ছিল। এখন নেই। তার মানে যে নেই তা নয়। আনন্দটা আছে তবে, হোয়াসআপ ড্যুড! লেট আস গো ফর আ রাইড ব্রো। লেটস জাষ্ট চিল ব্রো। এটুকুই। কারণ এর বেশি উপকরণ আজ আর অবশিষ্ট নেই। বিস্ময়গুলো যখন হারিয়ে যায়, হলদে মলাটের ভেতর থেকে হয়ত গুমড়ে ওঠে কান্নারা… বৃষ্টি পড়লে বুঝি জলেরা বাঁচতে চায়!

করোনা কালের প্রতিবেদন ফ্রি রিডিং

Disclaimer: Few pictures in this web magazine may be used from internet. We convey our sincere gratitude towards them. Information and comments in this magazine are provided by the writer/s, the Publisher/Editor assumes no responsibility or liability for comments, remarks, errors or omissions in the content.
Copyright © 2025. All rights reserved by www.EkhonDooars.com

Design & Developed by: WikiIND

Maintained by: Ekhon Dooars Team