এবারের মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাশের হার রাজ্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি উত্তরের কালিম্পং জেলায়। প্রথম দশে থাকা ৫৭ জনের মধ্যে ১৩ জন উত্তরের। প্রথম স্থান তো বটেই, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় এবার প্রথম পাঁচ জনের মধ্যে রয়েছে উত্তরের জেলা কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার ও মালদহের ছাত্রছাত্রীরা। কেবল এবারই নয়, বিগত কয়েক বছর ধরেই কৃতীদের তালিকায় বারবার উঠে আসছে উত্তরের স্কুলের ছেলেমেয়েরা, সেরা স্কুলের তকমা পেয়েছে উত্তরের প্রান্তিক স্কুল। কেবল স্কুলেই নয়, ন্যাকের বিচারে কলেজেও এবার রাজ্যের সেরা কোচবিহারের এবিএনশীল কলেজ। যে কৃতিত্বের দাবিদার ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে শিক্ষকরাও। পিছিয়ে থাকা প্রান্তিক বাংলার এই পারফরম্যান্স কি সত্যিই উত্তরের সরকারি শিক্ষার মান উন্নয়নের সূচক? উত্তর দক্ষিণের চিরকালীন ফারাক কি ক্রমশ ঘুচবার ইঙ্গিত? ছাত্রছাত্রীর অভাবে যখন একের পর এক সরকারি বিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যাওয়ার পথে তখন এই ধরণের ফলাফল উৎসাহব্যঞ্জক? নাকি অন্য কিছু! এইসব প্রশ্নের উত্তরে নিজেদের অভিমত অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন উত্তরের শিক্ষাজগতের সঙ্গে জড়িত মানুষেরা। তাঁদের মধ্যে থেকে বাছাই ভিন্ন ধরণের কয়েকটি অভিমত নিয়েই এই প্রতিবেদন।
উত্তরবঙ্গের জেলাগুলি থেকে মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় ভাল রেজাল্ট উত্তরবঙ্গবাসী হিসেবে আমাকে অবশ্যই গর্বিত করে। এই ভাল রেজাল্টের পেছনে যে কারণগুলি রয়েছে তার প্রথমটিই বলব অভিভাবকদের সক্রিয়তা, দ্বিতীয়ত বিদ্যালয়ের পঠন-পাঠনের পরিকাঠামো এবং তৃতীয়ত অবশ্যই কিছু শিক্ষকের অবদান। কিন্তু লক্ষ্য করে দেখবেন এই ভাল রেজাল্ট কিছু নির্দিষ্ট সংখ্যক বিদ্যালয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ। যে বিশাল সংখ্যক বিদ্যালয়গুলিতে এই পরিকাঠামোর অভাব রয়েছে তারা কিন্তু পিছিয়েই থাকছে। পরিকাঠামোগত ও শিক্ষকের অভাবে শিক্ষালাভের এই অসমতা দূর করতে পারলে আমার মনে হয় পরীক্ষার রেজাল্ট সামগ্রিকভাবে আরও ভাল হবে।
দীপক কুমার রায়, উপাচার্য, রায়গঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়
বাংলায় মধ্যবিত্তের একটা বড় অংশের ছেলেমেয়েরা ইংরাজি মাধ্যমে শিফট করে গিয়েছে, আমার মনে হয় উত্তরের তুলনায় দক্ষিণে সেই প্রবণতা বা সু্যোগ দুইই বেশি। যে প্রবণতা আজকাল আরো বেশি করে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, মাধ্যমিক পরীক্ষার পরেই ছেলেমেয়েদের বাড়ি থেকে অনেক দূরে বাংলার বাইরে পাঠিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নিচ্ছেন বাবামায়েরা। এর কারণ ব্যাখ্যা করবার প্রয়োজন নেই এবং এ রাজ্যের সরকারি শিক্ষার মান নিয়ে নতুন করে আর কিছু বলবার নেই। কিন্তু এসবের মধ্যে একটাই ভালো লাগাবার বিষয় যেটি তা হলো, এবারও যে ছেলেটি এবার কোচবিহার থেকে মাধ্যমিকে প্রথম হয়েছে কিংবা এর আগেও জলপাইগুড়ির যে ছেলেটি কলা বিভাগ থেকে উচ্চ মাধ্যমিকে প্রথম স্থান দখল করেছিল এদের মধ্যে বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতি অনুরাগ এবং একই সঙ্গে ইংরাজির উপর দখল আমাকে মুগ্ধ করেছে। আমার মনে হয়, উত্তরের ছেলেমেয়েরা এখনও বাংলার মাটির সঙ্গে অনেক বেশি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে বলেই এখনও এখানকার সরকারি স্কুল থেকে এমন মণিমানিক্য পাওয়া যাচ্ছে।
শঙ্কর ঘোষ, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি
উত্তর খুঁজতে গেলে কিন্তু খুব বেশি আশার বার্তা নেই। সামগ্রিকভাবে উত্তরের প্রায় সব সরকারি বাংলা মাধ্যম স্কুল শিক্ষকের অভাবে ধুঁকছে। গোটা রাজ্যেই বাংলা মাধ্যমে ছাত্র কমছে, যারা পড়ছে বড় অংশ অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে প্রান্তিক পরিবারের। উত্তরবঙ্গে বিকল্প কম বলে, বাংলা মাধ্যম এখনো অনেকটা জোরালো, এবং কিছু ক্ষেত্রে শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত পরিবারের এখনো ভরসার জায়গা। কিন্তু কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষায় নতুন নতুন বিষয়, পরিকাঠামো উত্তর জুড়ে একেবারেই শূন্য। সাহিত্য ও সমাজবিজ্ঞান তবু কিছু শিক্ষকের ব্যক্তিগত নৈপুণ্যে চলনসই, বিজ্ঞানপাঠের পরিকাঠামো কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার, রায়গঞ্জ, বালুরঘাট প্রমুখ বিশ্ববিদ্যালয়ে একেবারেই আজকের দিনের প্রয়োজনীয় মানের নয়।
জয়দীপ সরকার, অধ্যাপক
সুযোগসুবিধের ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। সরলভাবে বিষয়টি এইভাবে ভাবতে ভালো লাগলেও উপলব্ধির স্তরে বিষয়টি ভুল। মেধা তালিকার এরকম রেজাল্ট সামনে রেখে ভাবার অবকাশ এখনও তৈরি হয়নি। এখনও অনেক অনেক ফারাক। তবে হ্যাঁ, এগিয়েছে অনেকটা, আগ্রহ সচেতনতা বেড়েছে, বেশ কিছু স্কুল ধারাবাহিকভাবে সমান প্রতিযোগিতা দিতেও সক্ষম হচ্ছে। বেশ কিছু শিক্ষকও সমান স্তরের প্রশিক্ষণ দিতে পারছেন। ফলে একটা রেজাল্ট হচ্ছে। কিন্তু তার মানে এটি সামগ্রিক চিত্র নয়। বস্তুত উত্তর আছে উত্তরেই। কেউ কেউ অতিক্রম করতে পারছে কায়ক্লেশে, বাকিরা পার্থক্যের স্রোতে লড়াইটা দিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। প্রতিভা থাকলেও প্রতিকূলতাই পিছিয়ে রাখছে। উত্তর দক্ষিণ সমানভাবে এগুচ্ছে, উত্তরের সমান উন্নতি হচ্ছে, এটা বাস্তবিক প্রেক্ষিত ভাবনাও নয়। প্রভেদ ঘুচানোর উদ্যোগও বিশেষ নেই। ফারাকটা আছে বরাবর, বরাবরের মতো থেকেই যাচ্ছে। তার মধ্যে এই অগ্রগতির খবর আমাদের উত্তেজিত করে বইকি, পাশাপাশি রাগ-অভিমানও তির্যকতায় প্রকাশ পায়। সমান না-থেকেও আমরা যে পেরে উঠছি এই ভাবনাটিই বরং আমাদের বেশি বেশি করে জারিত হয়।
জ্যোতির্ময় রায়, শিক্ষক ও লোকসংস্কৃতি গবেষক
বিদ্যাচর্চায় উত্তরের এই পারফরম্যান্স অবশ্যই আত্মবিশ্বাসের ভিত পোক্ত করছে। রাজধানী শহর থেকে বহুদূরে, বহুল সমস্যা জর্জরিত প্রতিকূল অবস্থানে বসেও জ্ঞানসাধনায় সিদ্ধিলাভ সম্ভব তা যেমন প্রমাণিত তেমনই আগামীকালের জন্যেও অনুকূল বার্তাবাহী। কিন্তু এই উত্তরবঙ্গেরই জলপাইগুড়ি জেলার পাশের হার কয়েক বছর ধরে খুবই হতাশাজনক, র্যাংকিংয়ে সর্বশেষ স্থানটি জলপাইগুড়ি জেলার! সত্যিই ভাববার বিষয় এইরকম রেজাল্ট হচ্ছে কেন? কাগজে পড়লাম প্রচুর স্কুল ছুটের কারণে এই অবস্থা। আমার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা বলে, বনবস্তি, চা-বাগান, প্রত্যন্ত গ্রামীণ এলাকা, যাতায়াতের নূন্যতম সুবিধাটুকু পর্যন্ত নেই এমন সব জায়গা থেকে ছাত্রছাত্রীরা স্কুলে আসে, তাদের অনেকেই ফার্স্ট জেনারেশন লার্নার (স্বাধীনতার সাত দশক পরেও), বাড়িতে লেখাপড়ায় সাহায্য করার কেউ নেই এবং সর্বোপরি দারিদ্র্য। সেই সঙ্গে ভাষাগত বাধার কথাও উপেক্ষা করা যাবে না। কারণ ভাষাই পাঠ উপলব্ধির মূল বাহন। বাংলাভাষার সঙ্গে আবাল্য যুক্ত কারও পক্ষে বাংলায় পঠনপাঠন যতটা সহজ ঠিক ততটাই কঠিন বাংলাভাষার সঙ্গে প্রায় সংযোগবিহীন কোনও ছাত্রের পক্ষে বাংলামাধ্যমে পড়াশোনা করে, সিলেবাসভুক্ত বিভিন্ন বিষয়গুলোতে পারদর্শী হওয়া ও ভালো রেজাল্ট করা। অথচ এই জলপাইগুড়িতেই নাগরাকাটা ব্লকে ভারত সরকারের ট্রাইবাল এফেয়ার্স পরিচালিত একলব্য মডেল রেসিডেন্সিয়াল স্কুলে সেই চা বাগান বা প্রত্যন্ত এলাকার আদি জনজাতির ও নানান ভাষাভাষী ছাত্রছাত্রীরাই ধারাবাহিক ভাল ফল করে চলেছে। কারণ সেখানে ছেলেমেয়েদের নিয়মানুবর্তিতার মধ্যে দিয়ে সযত্নে শিক্ষা দেওয়া হয়। অতএব শিক্ষার দুর্বল জায়গাগুলির সঠিক অনুসন্ধান আজ বোধহয় ভীষণ জরুরি।
তনুশ্রী পাল, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক
শিক্ষার মান বেড়েছে কিনা বলা মুশকিল। তবে জাতীয় শিক্ষানীতি মেনে পশ্চিমবঙ্গের স্কুল কলেজের সিলেবাসেও একটা সামঞ্জস্য এসেছে, বিশেষ করে কেন্দ্রীয় বোর্ডের সঙ্গে। কিন্তু সমস্যা অন্য জায়গায়। সরকারি স্কুলে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা এবং মান দুইই কমেছে, এটা অস্বীকার করার জায়গা নেই। তবু এ বছর তো বটেই বিগত কয়েক বছর ধরেই উত্তরবঙ্গের প্রান্তিক শহরগুলির সরকারি স্কুল কলেজ থেকে উঠে আসা মেধাবী ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা আশাব্যঞ্জক। যদিও এখন শিক্ষা অনেক বেশি টেকনিক্যাল ও মেথডিক্যাল, টেকনোলজির যুগে চাইলেই যে কোনো প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে সাফল্য সম্ভব, কিন্তু তবুও বলব শহরের তুলনায় শহরতলি বা মফস্বল বা গ্রামকেন্দ্রিক জীবনচর্যায় প্রচলিত পাঠনির্ভর শিক্ষার গুরুত্ব এখনও হারিয়ে যায় নি। দেখনদারি বাণিজ্যিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাইরে পরিশ্রমী বিদ্যাচর্চা এখানে এখনও আশানুরূপভাবেই বিদ্যমান। কিন্তু এও সত্যি যে সাফল্য এখনও সর্বত্রই ব্যক্তিগত উৎকর্ষকেই নির্দেশ করে।
নবনীতা সান্যাল, শিক্ষক
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team