× home হোম archive আগের ওয়েব সংখ্যা panorama ডুয়ার্স সম্পর্কে play_circle_filled ভিডিও file_download মুদ্রিত সংখ্যার পিডিএফ library_books আমাদের বইপত্র
people এখন ডুয়ার্স সম্পর্কে article শর্তাবলী security গোপনীয়তা নীতি local_shipping কুরিয়ার পদ্ধতি keyboard_return বাতিল/ফেরত পদ্ধতি dialpad যোগাযোগ
login লগইন
menu
ad01112021081913.jpg
আংসাং কথা - ৫

আর্যদের আসার আগেই ডুয়ার্সে কৃষিসভ্যতার শুরু রাজবংশী পূর্বপুরুষদের হাতে!

শুভ্র চট্টোপাধ্যায়
Agriculture in Dooars started by Rajbangshi ancestors

সকলেই জানি যে, রাজবংশীদের পূর্বপুরুষ বহু বহু যুগ আগে পাহাড় অতিক্রম করে ডুয়ার্সের দক্ষিণের অপেক্ষাকৃত সমতল ভূমিতে নেমে এসেছিলেন। তখনো কৃষি সভ্যতার আবির্ভাব হয় নি। তখন আমাদের পূর্বপুরুষেরা সকলেই শিকারি জীবন যাপন করতেন। কোন জাতি জন্মেই ‘সভ্য’ হয়ে আবির্ভূত হয় নি। কোন জাতিই অলৌকিক ক্ষমতা নিয়ে আকাশ থেকে নেমে আসে নি। সব জাতি-গোষ্ঠীরই বিবর্তনের ইতিহাস প্রায় একই রকমের। আমরা সবাই অতীতে ‘ট্রাইব’ ছিলাম। প্রত্যেকেরই ট্যাবু ছিল টোটেম ছিল। 
রাজবংশীদের পূর্বপুরুষেরা বর্তমান ডুয়ার্সের দক্ষিণে কেন নেমে এসেছিলেন, এর কারণ নির্ণয় করা বর্তমানে প্রায় দুঃসাধ্য। শিকারি জীবনে মানব গোষ্ঠীগুলির জন্য পৃথিবীতে জায়গার অভাব একেবারেই ছিল না। গোষ্ঠীগুলো বসবাস করত ‘ভালো জায়গা’ বেছে নিয়ে। বছরের যেই সময়টা চলাফেরার পক্ষে প্রতিকূল হয়ে উঠত, সেই ঋতুতে তাঁরা কিছুদিন কোথাও সাময়িক আস্তানা গেড়ে বসবাস করতেন। শিকারের পিছু পিছু চলে যেতেন এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায়। দৈনন্দিন জীবনে আমরা বহু কিছু ব্যবহার করি। বাড়ি বদলাতে গেলে বোঝা যায়। কিন্তু ওই ভ্রাম্যমাণ জীবনে গেরস্থালির উপাদান ছিল অঙ্গুলি পরিমেয়। তাঁরা সে সব সাথে নিয়েই ঘুরতেন।
সম্ভবত শিকার করতে করতেই কারণেই রাজবংশীরা প্রাচীনকালে ডুয়ার্সের সমতল ভূমিতে নেমে আসেন। কৃষি সভ্যতা শুরু হবার পর মানব গোষ্ঠীগুলির সকলেই যে তা গ্রহণ করেছিল, এমন নয়। অনেকেই পুরনো ভ্রাম্যমাণ জীবন-ই বেশি পছন্দ করেছিলেন। কৃষিযুগে এসে রাজবংশীদের পূর্বপুরুষ দ্বারা ছোট ছোট কৃষক রাষ্ট্র গড়ে ওঠাও সম্ভব। কামরূপ প্রসঙ্গে মহাকাব্য-পুরাণে যা বলা হয়েছে, তা থেকে সিদ্ধান্তে আসা কঠিন। ওইসব রচনার বেশিরভাগটাই জনশ্রুতির উপর নির্ভর করে রচিত। প্রাচীন সংস্কৃত রচনায় করোতোয়ার পুব দিককে বলা হয়েছে কিরাত ভূমি। এ থেকে যদি ধরে নিই যে এদিকে কেবল কিরাত জাতি বসবাস করত, তবে বড় ভুল হবে। কৃষিকর্ম, আর্যদের আসার আগে থেকেই ভারতে প্রতিষ্ঠিত। আর্যরাই বরং সেটা জানতেন না। তাঁরা যখন ভারতে এসেছেন, ততদিনে ডুয়ার্সের দক্ষিণে রাজবংশীদের পূর্বপুরুষরা কৃষি রাষ্ট্র বানিয়ে ফেলেছিলেন, এটাই স্বাভাবিক। পাশাপাশি শিকার জীবনে বিশ্বাসী গোষ্ঠীগুলোও ছিল।
গোষ্ঠী থাকলে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব হবেই। অসুর ব্যাপারটা যে আর্যদের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের ফসল, সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ভারতে এসে তাঁদের প্রচুর মারামারি করতে হয়েছিল। অনার্যদের সাথে কখনো জিতেছেন কখনো হেরেছেন। অনেকের অনুমান এই যে, গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব বা যুদ্ধে হেরে যাওয়ার কারণে কোনও একটি আর্যগোষ্ঠী আসামে পৌঁছে গিয়েছিলেন। এদের উত্তরপুরুষেরাই কামরূপ সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা।
সিন্ধু সভ্যতার যুগে নগরগুলির প্রধান দুটি চাহিদা ছিল, তামা আর হাতি। দুটোই বৃহত্তর বঙ্গ থেকে যেত। তামার কারণেই বন্দরের নাম তাম্রলিপ্ত। তামা নিষ্কাশন-এর স্থান অবশ্য বর্তমানে বিহারের অন্তর্গত। আর হাতির চাহিদার জন্য যে তাঁরা কামরূপের ওপর নির্ভর করতেন, তা বলাই বাহুল্য। তবে সিন্ধু সভ্যতার যুগে ‘কামরূপ’ পরিচিত ছিল অন্য নামে। 
সুতরাং ‘পাণ্ডববর্জিত’ হলেই একটা জায়গা অসভ্য হবে, এরকম সিদ্ধান্তের কোনো কারণ নেই। তাছাড়া আর্যরা কৃষিকাজ পছন্দ করতেন না। কৃষকদের বরাবর নিচু চোখে দেখেছেন। ঠেলায় না পড়লে ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়দের কৃষিকার্য ছিল নিষিদ্ধ। অন্যকে দিয়ে জমিতে চাষ করাতে অবশ্য বাধা ছিল না। সিন্ধুসভ্যতার খনন-এর কাজে অতুলচন্দ্র সুর যুক্ত ছিলেন। তিনি গোড়াতেই বলেছিলেন যে, আমরা যাকে আর্য বা হিন্দু সভ্যতা বলি, তার মাত্র চার আনা আর্যদের অবদান। এর বারো আনাই কৃষক ও উপজাতিদের থেকে নেওয়া। 
এই দাবি একালে প্রায় প্রতিষ্ঠিত। 
প্রাচীনকালে ‘গণ’ শব্দটা কৃষক গোষ্ঠীদের বোঝাতেই ব্যবহৃত হয়েছে। গণ-এর দেবতা গণেশ যে কৃষকদের দেবতা, এর সপক্ষে বহু বহু প্রমাণ পাওয়া যায়। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, কৃষক-উপজাতিদের কাছ থেকে আর্যরা বহু কিছু শিখলেও ঋণ স্বীকার করেন নি। উল্টে তাঁদের খারাপ হিসেবে প্রতিপন্ন করেছেন। করতোয়ার পূব পাড়ের চেহারা তাঁদের কাছে ছিল প্রচণ্ড অস্পষ্ট। পৌন্ড্র দেশ সম্পর্কে মনুর বক্তব্য হলো, সেখানে যারা বসবাস করেন সবাই আচার হইতে ‘ভ্রষ্ট’ এবং ‘পতিত’। অনার্যদের বিষয়ে তাঁরা ভালো কথা বলতেন না। অনার্যরাও তাঁদের প্রচুর সমালোচনা করতেন। অনার্যদেরও ছিল জ্ঞান-বিদ্যা-বুদ্ধি-সাহিত্যের বিপুল ভান্ডার। কিন্তু তা ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে।
রাজবংশীরা যে মূলত কৃষক, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কৃষকদের দেবতা হলেন শিব। জল্পেশ, জটিলেশ্বর, কামাখ্যা-- সব মন্দিরই শিবকেন্দ্রিক। তন্ত্রের উৎপত্তিও কৃষকদের হাতে, কিন্তু একালে তন্ত্র বলতে যা বোঝায় তার সাথে প্রাচীন তন্ত্রের সম্পর্ক খুব সামান্য। অপেক্ষাকৃত দুর্গম অঞ্চল বলেই ‘কামরূপ’ সাম্রাজ্যে বৈদিক বিধি-নিষেধের প্রভাব ছিল ক্ষীণ। তাই তন্ত্রচর্চার পীঠস্থান হয়ে উঠতে কামরূপের সমস্যা হয় নি। বৈদিক ও পৌরাণিকরা কিন্তু তন্ত্রচর্চার কথা শুনলেই তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠতেন।
ঠাকুর পঞ্চানন বর্মার উদ্যোগে যখন রাজবংশীদের মধ্যে যখন ক্ষত্রিয়করণের সময় এলো, সে সময় তাঁদের একটি অংশ কৃষকদের প্রতি ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়দের অবহেলার কথা উল্লেখ করে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। রাজবংশী ‘হিন্দু’ কি না, এবং তাঁদের ‘ক্ষত্রিয়’ বলা যাবে কি না-- সে বিষয়ে ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের পরামর্শ চাওয়া হলে যাদবেশ্বর তর্করত্ন লিখলেন যে, কোচ ও রাজবংশী আলাদা জাতি। কিন্তু রাজবংশী উৎকৃষ্ট কোচেরা নিকৃষ্ট! তর্করত্ন অবশ্য রাজবংশীদের ‘ব্রাত্য ক্ষত্রিয়’ বলে মেনে নিয়েছিলেন। নবদ্বীপের বিখ্যাত পন্ডিতেরাও স্বীকার করলেন যে, বিশুদ্ধ ক্ষত্রিয় না হলেও রাজবংশীদের খানিকটা ক্ষত্রিয় হিসেবে মেনে নেওয়াই যায়। 
কিন্তু ‘ক্ষত্রিয়’ না হলেও যে রাজবংশীদের আত্মমর্যাদার কোনোরূপ হানি হয় না, তা অনেকেই বুঝতে পারছিলেন। অন্যদিকে, ‘কৃষক’ ব্রাহ্মণের বিধান মেনে ‘ক্ষত্রিয়’ হবে-- এটাও রাজবংশীদের একটা অংশকে অখুশি করেছিল। পাশাপাশি তাঁরা বলছিলেন যে, ক্ষত্রিয়করণের ফলে মুসলিম রাজবংশীদের সাথে হিন্দু রাজবংশীদের দূরত্ব তৈরি হবে। বস্তুত হিন্দু-মুসলিম নিয়ে রাজবংশীদের মধ্যে কোনো সমস্যাই ছিল না। একই উঠোনে হিন্দু-মুসলিম বসবাস করছে, এ দৃশ্য ছিল রাজবংশী গ্রামে খুবই স্বাভাবিক। 
আরো একটা ব্যাপার ছিল। ক্ষত্রিয় হলে কি রাজবংশী মেয়েরাও কি ভাটিয়া মেয়েদের মত ঘেরাটোপে ঢুকে যাবে? মাতৃতান্ত্রিক রাজবংশীদের কাছে এটা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। রামমোহনের সতীদাহ নিবারণ এবং বিদ্যাসাগরের বিধবা বিবাহ সংক্রান্ত আন্দোলন রাজবংশীদের কাছে ছিল অপ্রাসঙ্গিক। কারণ তাঁদের সমাজে না ছিল সতীদাহ, না ছিল বিধবাদের সুকঠিন জীবন। দেবেন্দ্রনাথ বর্মা এ বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে ডক্টর ইছামুদ্দিন সরকারের বক্তব্য উদ্ধৃত করেছিলেন। “রাজবংশী সমাজের নবজাগরণ বা নবচেতনার জন্য যে ক্ষত্রিয়করণ আন্দোলনের সৃষ্টি হয়েছিল, তার সামগ্রিকভাবে সংস্কৃত-করণ বা হিন্দু-করনের প্রতিধ্বনি মাত্র। কিন্তু ক্ষত্রিয়করণের ফলে সামগ্রিকভাবে সমাজে রাজবংশীদের মর্যাদা বৃদ্ধি পায়নি বা সর্ব অবস্থায় এ সমাজের মানুষের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়নি।”
বাঙালিকে বলা হয় আত্মবিস্মৃত জাতি। রাজবংশীরাও এই বিস্মৃতির বাইরে নয়।

করোনা কালের প্রতিবেদন ফ্রি রিডিং

Disclaimer: Few pictures in this web magazine may be used from internet. We convey our sincere gratitude towards them. Information and comments in this magazine are provided by the writer/s, the Publisher/Editor assumes no responsibility or liability for comments, remarks, errors or omissions in the content.
Copyright © 2025. All rights reserved by www.EkhonDooars.com

Design & Developed by: WikiIND

Maintained by: Ekhon Dooars Team