 সব্যসাচী দত্ত
                                            
                                                
                                                সব্যসাচী দত্ত
                                            
                                            
                                         
                                            
                                        ১
রায়গঞ্জের সুনীল দা। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। হোমিওপ্যাথি চর্চায় মন দিয়েছেন। চিকিৎসার এই বিদ্যায় আগ্রহ বরাবর। বইপত্র পড়ে, ইন্টারনেট ঘেটে অনেক দিন ধরেই পরিবারে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করছেন। সুস্থও হয়ে উঠেছে কেউ কেউ। তা চিকিৎসার গুণ নাকি রোগীর ইমিউনিটি তা মা গঙ্গাই জানেন। লকডাউনের পর থেকে তেড়েফুঁড়ে লাগলেন।
স্কুল বন্ধ হয়ে গেল। গ্রামের প্রাইমারী স্কুলে অনলাইন শিক্ষার ব্যবস্থাও নেই। এই পুরো সময়টাকে ব্যবহার করলেন। বাজারে একটা ঘর নেওয়া ছিল। সেখানেই চেম্বার খুলে গেল। ঔষধ এলো অনলাইনে। ঘরের মাথায় বোর্ড পড়লো, ডাঃ সুনীল সরকার। ব্যবসার ব্যবসা, সঙ্গে আড্ডাও। বেশ জমে গেল। আজকাল ফেসবুকেও তাঁকে ডাক্তার রূপেই দেখা যাচ্ছে। আর বোর্ডে ডাঃ সুনীল সরকারের পাশে ব্র্যাকেটে লেখা হোমিওপ্যাথ, ঐচ্ছিক। ঐচ্ছিক যে কেন সেটাও মা গঙ্গাই জানেন।
২
বাসুদেব বীরপাড়ায়। কালচিনিতে স্কুল। এই লকডাউনে ব্যবসা শুরু করেছে। স্কুল তো যেতে হয় না। গ্রামের বিদ্যালয়ে অনলাইন ক্লাশের ঝামেলাও নেই। ফলে অঢেল সময়। তাই শুরু করেছে খাবারের ব্যবসা। যে কেউ খাবার কিনতে পারে হোয়াটস অ্যাপে মেসেজ ক’রে। সমস্তরকম কোভিড বিধি মেনে খাবার রান্না ও পরিবেশন করা হয়। একই খাবারের মূল্য ক্ষেত্র বিশেষে আলাদা। কোভিড পজিটিভদের জন্য নুন্যতম সহায়ক মূল্য। অনাক্রান্ত পরিবারের জন্য খাবারের মূল্যর সঙ্গে যুক্ত হয় যে পাঁচজন মহিলা পুরুষ কাজ করে তাঁদের পারিশ্রমিকও। আর প্রতিদিন দশজন দরিদ্রের জন্য বিনামূল্যে আহারের ব্যবস্থা। তাতে দু’বেলা আজকাল প্রায় দেড়শো জনের রান্না হচ্ছে।
উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ইতিহাসের শিক্ষক বাসুদেবের পিতা ক্যান্সারে আক্রান্ত। তাঁর নিয়মিত চিকিৎসার জন্য অনেক টাকার প্রয়োজন। ছ’জনের পরিবার। বাড়ি তৈরির ইএমআই সব মিলিয়ে বেতনের টাকায় কুলিয়ে ওঠা মুশকিল। অতিমারিতে কত মানুষের কত যন্ত্রনা। কষ্ট হয় ওর। তাই ভাবনা চিন্তা ক’রে এই ব্যবস্থা নিয়েছে। তাতে কাজ হারানো পাঁচটি পরিবারের আয় হচ্ছে। কিছু মানুষের রসনা তৃপ্ত হচ্ছে। কিছু নিরন্ন মানুষের দু’বেলা আহারের ব্যবস্থা হচ্ছে। নিজের উদ্যোগ। ওর তো বেতন আছেই। প্রথম বিনিয়োগ করতে হয়েছিল ওকেই। কেউ কেউ হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। এখন দিব্যি চলছে। এটাই বাসুদেবের সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা। একে খুব কিছু বড় মনে করে না ও। বলে, আমি না করলে অন্য কেউ তো করতই।
৩
অনিরুদ্ধ জলপাইগুড়ির শান্তি পাড়ার বাসিন্দা। বিভিন্ন মরসুমী ফল, মধু, আখের গুড়, খেজুর-তালের গুড়ের ব্যবসা। অনিরুদ্ধ অবশ্য বলে বাণিজ্য। তবে এ তার এথিকাল বানিজ্য। রাসায়নিক মুক্ত গাছপাকা ফল। সর্ষে ক্ষেতের পাশের প্রাকৃতিক মধু। জৈব সারের আনাজ-পাতি। রস জ্বাল দিয়ে নিজের হাতে তৈরি গুড়। এমন অনেক কিছু।
এর জন্য বেতনের প্রায় সব টাকাটাই ব্যয় করে। ব্যাঙ্কের ঋণ আছে অনেক। গ্রামে গ্রামে ঘুরে ইজারা নেয় বাগান, চাষের ক্ষেত। শুদ্ধ খাদ্যসামগ্রী পরিবেশনের জন্য। কোনও কিছু বিক্রি ক’রে লাভ তো কিছুই হয় না। বরং ঘরের থেকে ভর্তুকি দিতে হয়। বিয়ে করেনি। করবেও না। পরিবারের কোনও সমস্যা নেই। পুরো জলপাইগুড়িই ওর পরিবার। ও জানে লোকে পাগল বলে। তবুও করে।
পুজোর পরে বিজয়া সম্মিলনী করে স্কুলের মাঠে। ময়নাগুড়ির একটি ছোট্ট গ্রাম চূড়াভান্ডারে ওর স্কুল। সেখানে নিজের খরচে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের আসর বসায়। গ্রামের শিল্পীদের নিয়ে অনুষ্ঠানের আয়োজন করে শহরে। এই কিছুদিন আগে লকডাউন শিথিল হলে নিজের প্রয়াত মায়ের স্মরণে মহিলাদের নিয়ে একটি অনুষ্ঠান করেছিল। যে অনুষ্ঠানে পুরুষের প্রবেশ ছিল নিষিদ্ধ। সারাদিন বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, প্রাচীন ঐতিহ্য চর্চা সঙ্গে পুষ্টিকর সুস্বাদু শুদ্ধ নিরামিষ আহার। তাতে পোশাকও নির্দিষ্ট ক’রে দিয়েছিল। সমস্ত ব্যবস্থা নিজের বেতনের টাকায়। গতকালই ফোন করেছিল কার্বাইড মুক্ত আমের জন্য। বাজারের মূল্যে নির্বিষ ফল। ওর অনেক কাজ নিয়েই বিতর্কের অবকাশ আছে। কিন্তু নিষ্ঠার অভাব নেই।
৪
কোচবিহার জেলার চ্যাংড়াবান্ধার ভোটবাড়ি গ্রামের বাসিন্দা শচীমোহন বর্মন। চ্যাংড়াবান্ধা উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। সাহিত্যপ্রেমী মানুষ। মুক্তচিন্তার আন্দোলন গড়ে তুলেছেন। নিয়মিত সাহিত্যচর্চা তাঁর ব্রত। কেবল নিজেই সাহিত্যচর্চা করেন তা নয়। বেশ বড় একটি সংগঠন গড়ে তুলেছেন। যাঁরা কোনওদিন সাহিত্যচর্চার কথা পরিকল্পনাতেও আনতে পারতেন না তাঁদের বই প্রকাশিত হচ্ছে। কবিতার, গল্পের এমনকি উপন্যসেরও। উদ্যোগ মাস্টারমশাই-এর। পাশে সক্রিয়ভাবে পেয়েছেন স্ত্রী নন্দা বর্মন কে। বছরভর সাহিত্য উৎসবের আয়োজন, সেমিনার, সম্মান প্রদানের পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক কাজ। সমস্ত খরচ তাঁর। অতিথিদের সঙ্গে সাহিত্য উৎসবের তিন দিন গ্রামের সমস্ত মানুষের পাত পরে তাঁর বাড়িতেই। খরচ আসে বেতনের টাকায়। এখন অবসর গ্রহণ করেছেন। পেনসনের টাকায় সংস্থার কাজ চলছে।
হাউসবিল্ডিং লোন নিয়ে করা বাড়িটিও আইন মোতাবেক দান করেছেন সংস্থাকে। একটি মিউজিয়ামও গড়ে তুলেছেন বাড়িতে। সেখানে এই অঞ্চলের বাদ্যযন্ত্র, মাছ ধরা ও চাষের সরঞ্জাম, পুরোনো বাসনপত্র, আসবাব রয়েছে। আছে একটি লাইব্রেরী। সেখানে হাজার দশেক বইয়ের সঙ্গে আছে অসংখ্য ক্ষুদ্র পত্র-পত্রিকা। রয়েছে সঙ্গীত চর্চার ব্যবস্থা, অত্যাধুনিক রেকর্ডিং স্টুডিও, মুক্ত মঞ্চ, নাটকের মহড়াকক্ষ।
৫
সুদর্শন দা’র একটা গল্প শুনেছিলাম। সত্য কাহিনি। তখনও উচ্চ প্রাথমিকের এই চাকরিটা পাননি। কৃষিকাজই সংসারের ভিত্তি। তাই সকাল সকাল পান্তা খেয়ে হাল কাঁধে মাঠে। দুপুর পর্যন্ত কৃষিকাজ। একদিন দুপুর হয়ে গেছে। মাথার ওপর গনগনে সূর্য। প্রচন্ড জল পিপাসা পেয়েছে। সঙ্গে আনা জলও শেষ। বাড়িটাও কিছুটা দূরে। ধারে কাছে জলের কোনও উৎস নেই। তৃষ্ণায় বুক ফেটে যাচ্ছে। কী করবেন? পাশের মাঠেই চাষ হয়ে যাওয়া মাটির ফাঁকে ফাঁকে বৃষ্টির জল জমে আছে। সেই জলই মুখ লাগিয়ে খেয়ে নিলেন। না, কিস্যু হয়নি!
এখন খেতে পারবে?
কী জানি!
পঞ্চাশোত্তীর্ণ নিস্পাপ হাসি সুদর্শন দা’র চোখে মুখে। কথাগুলি আবার মনে পড়লো এই অতিমারির কালে। সামাজিক মাধ্যমে শিক্ষকদের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হচ্ছে বারবার। অথচ একবারও কি কারুর মনে হয় আচ্ছা সমালোচনা করবার আগে একবার অন্তত খোঁজ নিই শিক্ষকরা কেমন আছেন।
বেশ অনেক কাল পর আবার ব্যাঙ্কে দেখা সুদর্শন দা’র সঙ্গে।
কেমন আছো?
এই আছি।
এই অসময়ে ব্যাঙ্কে? বেতন তোলো নাই।
না, এখনও তুলি নাই।
পাঁচটি এনইএফটি ফর্ম চেয়ে নিল।
কাকে টাকা পাঠাবে?
কাছে ডেকে নিল। খুব মৃদুস্বরে বললো আরে ভাই আর বলিস না। পরিচিত পাঁচটা পরিবারের কোনও কাজ নাই। লকডাউনে চাকুরি গেছে। ওদের প্রতিমাসে তিন হাজার করে দিচ্ছি।
কোথাকার!
আমাদের গ্রামেরই।
তাহলে তো হাতে হাতেই দিতে পারো।
না রে ভাই হাতে হাতে দিতে লজ্জা লাগে।
আর তোমার বেতন!
এই তুলবো আজ।
তুমি এখনও চাষের কাজ করো সুদর্শন দা?
আরে ভাই ওই নিয়েই তো আছি। মাসে তিন চারদিন স্কুলে যাই মিড-ডে-মিল বিলি করতে। বাকি দিন চাষ-বাস নিয়েই আছি। আবার কাছে এগিয়ে আসে, চাষের কাজ করি কেন জানিস? আমাকে দেখে গ্রামের শিক্ষিত ছেলেগুলি যদি চাষের কাজে এগিয়ে আসে। ভাই শিক্ষা ভয়ঙ্কর জিনিস। সব কাজ করতে দেয় না। আর শিক্ষিতের শিক্ষার গুমোর থাকবে না!
তো লাভ হ’ল তাতে?
তবে আর বলছি কি? এখন তো বলছে শুনি অনেকেই, মাস্টার হয়ে সুদর্শন যদি চাষের কাজ করতে পারে আমরা কোন হরিদাস?
বলেই বেশ জোরে হেসে ওঠে সুদর্শন দা। ব্যাঙ্কের গম্ভীর পরিবেশ সহসা চমকে ওঠে।
(গোপনীয়তার কারণে এই লেখায় দুটো ক্ষেত্রে নাম ও জায়গা বদলে নিয়েছি। ঘটনাগুলো সত্য)
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team
