চৈতালী দে (নাথ)
                                            
                                            
                                        
                                            
                                        আমার ভিতর বাহিরে অন্তরে অন্তরে আছো তুমি হৃদয় জুড়ে…
কবির লেখা পংক্তি কটি ধার করে এই লেখা শুরু করলাম। আসলে ডুয়ার্স নিয়ে কিছু লিখতে বসলে আমার প্রথম যে অনুভূতি মনে আসে তার সাথে কবি রুদ্র মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ’র এই পংক্তিগুলো ভীষণ ভাবে মিলে যায়। ডুয়ার্স নামটি হৃদয়ের গভীর গহনে লুকিয়ে থাকা এক প্রেমিকের নাম যেন। যার সাথে জড়িয়ে আছে এক ভীষণ রকমের ভালোলাগা আর প্রাণভরা ভালোবাসা। যখন মন বিষাদ মাখা থাকে, তখন ডুয়ার্সের কথা ভাবলে মন ভালো হয়ে যায়। আবার যখন চারিদিকে আনন্দ মুখরতা, ভীষণ ভালোলাগা, তখন হঠাৎ মন যেন ছুঁয়ে আসে ডুয়ার্স এর চেনা পথ।
আমার সুন্দরী ডুয়ার্স, আমার ভালোবাসার ঝিনুক, যার মধ্যে আছে হাজারো মুক্তো সাজানো। আজ যখন আমি পরবাসে, তখন পরম যত্নে সেই মুক্ত গুলো স্মৃতির পট থেকে তুলে এনে পরপর সাজাই আমার মনের কোনায়। আমি ফিরে যাই আমার ফেলে আসা দিনগুলিতে। এমন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর পাহাড় আর নদীর সহাবস্থান খুব কম জায়গাতেই দেখা যায়। দিগন্ত জোড়া নীল আকাশ আর আকাশের গায়ে মাথা তুলে দাঁড়ানো পাহাড়ের সারি। নীচে সরু খরস্রোতা কল্লোলিনী এঁকেবেঁকে ছুটে চলেছে। যেন সদ্য কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পা রাখা চঞ্চলা বালিকা। প্রেমিকের স্পর্শে শিহরিত হয়ে খিলখিলিয়ে হেসে ছুটে পালাচ্ছে। আবার তেমনি তিস্তা, তোর্সার মতো নদী, যার রূপ কখনো পরিণত নারীর মতো স্নিগ্ধ। আবার বর্ষার জলে পরিপূর্ণ হয়ে কখনো কাল সাপের মতো ফনা তুলে আছড়ে পড়ছে পাড়ে, ভাঙছে নদী বাঁধ, ভাসিয়ে নিচ্ছে দুকূল।
আমার সুন্দরী ডুয়ার্স ছেড়ে একসময় দুরুদুরু বুকে পাড়ি দিয়েছিলাম সাত-সমুদ্র তেরো নদীর পারে। এসে পৌঁছেছিলাম মার্কিন যুক্তরাষ্টের শহর আটলান্টাতে। মার্কিন মুলুক সম্পর্কে বিশাল জ্ঞান ভান্ডার না থাকলেও বেশ কয়েকটা শহরের নাম অনেক আগে থেকেই জানতাম। তাদের মধ্যে একটি ছিল আটলান্টা। তার একটা কারণ অবশ্য ১৯৯৬ সালে গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকের আসর এই শহরে বসেছিল বলে। যখন এই শহরে পৌঁছলাম তখন ডিসেম্বর মাস। চারিদিকে শীতের রুক্ষ-শুষ্ক রূপ। মন ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। কোথায় আমার সবুজে ঘেরা রূপমতী চির যৌবনা ডুয়ার্স, আর কোথায় এই ধূসর হিম শীতল শহর। এখানে মন টিঁকবে কী করে!
কিছু দিন ঘরে বসেই যতটা সম্ভব বিভিন্ন কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করলাম। ঘরে বসেই, কেন না গাড়ি চালাতে জানতাম না যে! আর গাড়ি চালাতে না পারলে এদেশে একপ্রকার গৃহবন্দী থাকা ছাড়া উপায় নেই। তবে এর মধ্যেই আশ্বাস পেয়েছি যে কিছুদিন বাদেই ধূসর রূপের খোলস ছেড়ে এই শহর সুন্দর করে সেজে উঠবে। মন যদিও মানতে চায় নি সেই স্তোক বাক্য। তবে এই আশার বাণীর সাথে সাথে অনেকটা ডিসক্লাইমারের মতো সাবধান বাণীও শুনেছি যে গাছের পাতা সবুজ হবার সাথে সাথে রাস্তাঘাট, বাড়ি-গাড়িও হলদেটে সবুজ হয়ে উঠবে। আর সেই সাথে নিয়ে আসবে পলেন এলার্জি। সে যে কী বিষম ব্যপার তা টের পেলাম কিছু দিন পরই। নাক বন্ধ, মাথা ভার, বাইরে বেরোলেই অসম্ভব চোখ চুলকানি। দেশে থাকতে জানতাম আমার ডাস্ট এলাৰ্জি আছে। এই দেশে এসে বুঝলাম শতকরা সত্তর ভাগ জিনিসেই আমার এলার্জি। থাক সে কথা। সে নিয়ে না হয় আর একদিন মহাকাব্য লেখা যাবে।

তবে শীতের প্রকোপ কমতে ধীরে ধীরে দেখলাম আমার এই নতুন শহর জরা কাটিয়ে দ্রুত গতিতে তার যৌবন ফিরে পাচ্ছে। সবুজে ঢেকে যাচ্ছে। আমার বাড়ি ঘিরে রাখা আকাশ ছোঁয়া ন্যাড়া মরুদল সবুজে সবুজে ছেয়ে যাচ্ছে। আমার মধ্যেও যেন প্রাণশক্তি ফিরে আসছে ক্রমে। অবশেষে আটলান্টার গায়ে যখন পুরোমাত্রায় গ্রীষ্মকাল এলো, তখন যেদিকে তাকাই গাছপালা আর নানা রকম ফুলের বাহার। এতো বড়ো, এতো উন্নত একটা শহর, অথচ কী দারুণ সবুজ। ঝকঝকে তকতকে রাস্তাঘাট। আর তার দুপাশে ঘন সবুজ গাছের সারি। মাঝে মাঝে ফুলের বাগান। সেই সাথে ছোট, খরস্রোতা পাহাড়ি নদী, আমার বাড়ির ঠিক পেছনেই এমনই এক খরস্রোতা বয়ে চলেছে। আটলান্টার গঙ্গা (আমরা ভারতীয়রা মজা করে মাঝে মাঝে এই নামে ডাকি) চ্যাটাহুচি।
সে না হয় হলো, কিন্তু পাহাড় কোথায়? তারও হদিশ পাওয়া গেলো কাছেই। স্টোন মাউন্টেন, বিশ্বের সর্ব বৃহৎ মনোলিথিক স্টোন এবং এ্যাপালেশিয়ান পর্বতশ্রেণীর অন্তর্গত। যদিও সেটিকে ডুয়ার্সের মেয়ে হয়ে পাহাড় হিসেবে স্বীকৃতি দিতে আমি যারপরনাই নারাজ। আমার আশেপাশের চাহনি বোঝালো, রোসো, আরো আছে তো! অবশেষে আমার মনের মতো পাহাড় পেলাম একে একে। এমিকোলোলা ফলস, কেনেসও মাউন্টেন, রেড টপ মাউন্টেন। পাহাড়ী ঝর্ণার জল লাফিয়ে নিচে খাদে নেমে আসছে, আর তার ওপর সূর্যের আলো প্রতিফলিত হয়ে রামধনু রং ছিটকে পড়ছে। পাহাড়ী সরু আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে হাইকিং এর ব্যবস্থাও আছে।
আর আছে খুব সুন্দর করে সাজানো ছোট্ট শৈল শহর হেলেন। দেখছি আর ভাবছি এতো আমার সেই ডুয়ার্স। আমার বহুদূরে ছেড়ে আসা সেই ভালোবাসার স্থান। দেখছি আর একটু একটু করে আবার প্রেমে পড়ছি। যেই প্রেম এতকাল ছিল শুধু মাত্র ডুয়ার্সের জন্য, বুঝতে পারছি সেখানে এখন ধীরে ধীরে আটলান্টাও ভাগ বসাচ্ছে। আমি একটু একটু করে আবার ভালোবাসতে শুরু করেছি।
ভালো আছি ডুয়ার্স। তুমিও ভালো থেকো। আর মাঝে মাঝে আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো আমাকে ।
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team