× home হোম archive আগের ওয়েব সংখ্যা panorama ডুয়ার্স সম্পর্কে play_circle_filled ভিডিও file_download মুদ্রিত সংখ্যার পিডিএফ library_books আমাদের বইপত্র
people এখন ডুয়ার্স সম্পর্কে article শর্তাবলী security গোপনীয়তা নীতি local_shipping কুরিয়ার পদ্ধতি keyboard_return বাতিল/ফেরত পদ্ধতি dialpad যোগাযোগ
login লগইন
menu
ad01112021081913.jpg

উত্তরের নেশাপুরাণ : দিশি ফোরেন থেকে বাংলা-হাঁড়িয়া-ছাং-ভুটান শেষ হয় জুতোর কালিতে?

ধীমান সান্যাল
Addiction to liquor in North Bengal
Picture Courtesy - fight-addiction.com

এক বাঙালি নেশায় দুই বাঙালি। শুকনো আর ভেজা-র গল্প। শুকনো আপাতত মুলতুবি থাক। চলে আসি ভেজার কথায়। ভেজা মানে ঠিক সে অর্থে ভেজা নয়, আবার ভেজাও বটে। মানে একটা বায়বীয়, আরেকটা তরল। তরলের আবার নীট তরল। বোতল থেকে সোজা গলায়, কোনও ভ্যানত্যাড়ামি নেই। কোনো আয়োজনের প্রাচুর্য নেই। পুজো প্যান্ডেলে একলা প্রদীপ জ্বলছে। মৃদু আলোয় এক ঝটাকসে ছিপি খুলে সত্তরের নায়কের মতো... যেতে যেতে পথে হলো দেরি নয়, এ শালা পুরো মহল্লা জানিয়ে দিয়ে যাওয়া। হু হু বাওয়া এ পুরো ধ্বকের নেশা। কলজে থাকতে হয় বস। সারাদিনে কয়েকবার এরকম লুকোচুরি খেলে বাড়ি ফিরতে প্রায়ই বেসামাল দশা। তাতে অবশ্য ইজ্জত একটু আধটু খোয়া যায় কিন্তু পরদিন সকালে কলপাড়ে স্মৃতিসহ সব সাফ।

(২)

সেই মহাজাগতিক, মহাজ্ঞানী, দিব্যচক্ষুর অধিকারী বস্তুটি হল আইএমএফএল। ইন্ডিয়ান মেড ফরেন লিকর। অর্থাৎ পাতি বাংলায় বিলাতি। এই বিলাতকে দুভাগেভাগ করা যায়। এক ইন্ডিয়ান মেড, মানে ফর্মুলা সংশ্লিষ্ট কোম্পানির আর বটলিং এখানকার। আর দ্বিতীয়টা হলো ফর্মুলা ও বটলিং দুটোই সংশ্লিষ্ট দেশের। সে যাই হোক আমাদের আলোচ্য আইএমএফএল। কারণ বিদেশে বটলিংজাত সেইসব বোতল সাধারণের প্রায় ধরা ছোঁয়ার বাইরে। বিলাতি মদের অনেক ধরনের কনজিউমার, অনেক ধরনের খাওয়ার পদ্ধতি, অনেক ধরনের প্রকারভেদ, অনেক ধরনের আড্ডাঘর, এমনকি বিভিন্ন ধরনের ড্রিংকসের জন্য গ্লাসেরও রকমফের আছে।

(৩)

একজন গোটা মাস এমনকি গোটা বছর একটাই ব্র্যান্ড একই পরিমাণ জল একই ধরনের চাটের সঙ্গে নির্দিষ্ট সময়ে মেরে দেয়। মেরে দেয় বলছি কারণ এটাকে ঠিক পান করা বলে না। একটা পাঁইট কিনে, জলের বোতলে অর্ধেকটা ফেলে রাস্তার গলিঘুপচি-তে অথবা একটু আড়ালে মদটা মিশিয়ে প্রায় জলের মতো খেয়ে নেওয়া সহজে। একটু ছোলা অথবা আদাকুচি চিবিয়ে বাড়ির পথ ধরা। যেতে যেতে দুটো সিগারেট না হলে খৈনি। বাড়ি গিয়ে একদম স্পিকটি নট অথবা পরিমিত বাক্যালাপ। এদের দেখে বা কথা বলে সাধারণত বোঝার উপায় নেই এরা খেয়ে আছে, নাকি না খেয়ে আছে। সাতে পাঁচে না থাকা এরা সাধারণত রামনাম করে। ওল্ড মঙ্ক ম্যাচিওর্ড। 

(৪)

একার গল্প যেমন, তেমনি দলবাজিও আছে। তবে সেক্ষেত্রে সীমিত সংখ্যক গুণগ্রাহী। সবই নির্দিষ্ট। ঘর থেকে সপ্তাহের কোন দিন, সবটাই। ঘড়ির কাঁটা মেনে জনতা জমায়েত। স্কচ হুইস্কি একটু দামি। সাথে প্রচুর স্ন্যাক্স, জল, আইস কিউব, সোডা। অল্প আলোয় গুলাম আলি অথবা মেহেদী হাসান। গ্রিলড ফিস অথবা চিকেন মেয়োনিজে ডুবিয়ে একেকটা সিপ এমনভাবে ঠোঁট ছোঁবে, অমরত্ব মনে হবে তুচ্ছ। আলতো করে জিভ ছুঁয়ে যাবে মহার্ঘ পানীয়। রাত বাড়বে। কথার তুবড়ি ছুটবে শিলিগুড়ি থেকে শিকাগো। রায়ডাক থেকে রাষ্ট্রপুঞ্জ।

(৫)

এবার সংখ্যা নির্দিষ্ট নয়। অগোছালো ভাবের মানুষ। এদের দরকার একটা ফাঁকা বাড়ি। আগের গ্রুপের গড় বয়স যদি চল্লিশ হয়, এরা তবে পঁচিশ। মাংস রান্না হতে থাকবে সেখান থেকেই তুলে টপাটপ মুখে। অনির্দিষ্ট সবটাই। তবে একটু কম লেভেলের হুইস্কি প্রেফারেবল। কারণ পরিমানটাও মাথায় রাখতে হয়। দু-তিন পেগের পর অবধারিত বাওয়াল। পেগের হিসেবে রাখা যায় না। মাংস পড়ে থাকে একলা। শুকিয়ে যায় রুটি। বমির গল্পে জল ধোয়া চলে। কেউ কেউ গভীর রাতে হাওয়া খুঁজতে রাস্তায় হাঁটে। বন্ধুত্বের উষ্ণতায় মিশে যায় নিয়ন আলো। 

(৬)

ডুয়ার্সের জঙ্গলে বা পাহাড়ি পাদদেশে সব ঋতুতেই পিকনিকের আসর বসে। বড়োদের পিকনিকটা ঠিক পিকনিক নয়, একটু অন্যরকম। প্রায় সব সিজনেই হওয়া এই আউটিঙে গাড়িতে একে একে ডোডেয়াহাটের খাসি, মাছ, চিপসের প্যাকেট, কাজু, ভুজিয়াসহ হুইস্কি গ্লাস সোডা ওঠে। বিকেলের মধ্যে সব সেরে তথাকথিত ভদ্রবাবুরা বাড়ি ফিরে চায়ে চুমুক দেন। 

(৭)

আত্মসর্বস্ব মানুষেরাও বিরল নয়। অফিস ফেরত টুক করে একটা পাঁইট ব্যাগে ঢুকিয়ে সোজা বাড়ি। হাতমুখ ধুয়ে সাধনা করার মত যাবতীয় সরঞ্জাম নিয়ে বসবেন। নিজের সঙ্গে নিজেই সময় কাটাবেন। খাবেন। তারপর নাক ডেকে ঘুমোবেন। 

(৮)

বাংলায় পানশালা বললে অনেকে নাও চিনতে পারেন তবে বার বললে সহজেই চেনা যায়। আমাদের মত ছোটো শহরগুলিতে বারের সংখ্যা খুব কম। মেরেকেটে দুটো কি তিনটে। কম্পিটিশনেই তাই দামটাও বেশি। বড়ো বড়ো শহরে ড্যান্সিং-সিঙ্গিং বারের রমরমা। পয়সা, প্রচুর সময়, এবং একাকীত্ব এসব নিয়ে যাদের কোনো সমস্যা নেই তারা এখানে বসেন। গল্পগুজব করেন। খানাপিনা শেষে ঢুলুঢুলু চোখে বাড়ি ফেরেন। বাড়াবাড়ির উপায় থাকে না বারে।

(৯)

টলটলে তরল বাংলার আসল মুখ। চোয়াড়েদের কাছে বাংলু। পুরো আগুন। স্পিরিটের বাড় বাড়ন্ত বেশি বলে গলায় ঢালতেই ফুল টঙে। সঙ্গে একটু লংকা আর লবণ। খালাসিটোলায় সারাদিন পড়ে থেকে অনেকেই বাংলা খেতেন শুধু শক্তি হবেন বলে। কবিতা লেখা হোক আর না হোক। সেইদিক দিয়ে বাংলা হাল্কা রোমান্টিকও বটে। এর যাতায়াত আবার এলিটেও আছে বইকি। অবশ্য সেখানে নামটা লুকোনো থাকে। কান্ট্রি লিকার উইথ ডাবের জল। আহা হেভেনলি। 

(১০)

যে বাংলা বোতলের মুখ দেখেনি তিনি পাউচে। এক ছোবলেই ছবি। পুরো স্লিম এন ট্রিম। 

(১১)

তারপর চা বাগান এলাকার উপজাতিদের মধ্যে প্রচলিত ভাত পঁচিয়ে বানানো হাড়িয়া এখন প্রায় মিথ। বাগানগুলিতে সপ্তাহান্তে মজুরি দেবার নিয়ম। সেদিনই হাট বসে। হাটের শেষের দিকে একটু নির্জনে হাড়িতে হাড়িতে হাঁড়িয়া নিয়ে বসে থাকে মেয়ে মরদরা। সদ্য পাওয়া মজুরির বেশির ভাগটাই উড়িয়ে টলোমলো পায়ে উদগার তুলতে তুলতে এখনও বাড়ি ফেরে চা শ্রমিক। সারা সপ্তাহ আবার ধার বাকি। ডুয়ার্সের হাটগুলো তাই হয়তো এমন বিষণ্ণ সারাজীবন। আধুনিক হাঁড়িয়ায় নেশাতুর ট্যাবলেট মেশানোর ফলে নেশা থেকে বিষক্রিয়া বেশি হয়। বেশিরভাগ চা শ্রমিকদের গড় আয়ুও পঞ্চাশ মেরে কেটে ষাট। কজ অভ ডেথ সিরোসিস অভ লিভার। 

(১২)

হাঁড়িয়া যদি হয় ডুয়ার্সের কিং তবে পাহাড়ের রাজা অবশ্যই ছাং। যেন নেপালি যুবক কিন্তু হাবেভাবে খাপ খোলা খুকরি। এক্ষেত্রে বাঁশ একটা বড়োসড়ো উপকরণ। না না এই বাঁশ সেই বাঁশ নয়। ছাং আসলে দেশীয় লোকাল বিয়ার। অতোটা ষ্ট্রং নয় বরং একটা সফিষ্টিকেশন আছে। ঢুংরো নামক বড়ো মোটা বাঁশের পাত্রে বার্লি, বাজরা, চাল গরম জলে ভিজিয়ে রাখা হয়। সেগুলো ঠান্ডা হয়ে থিতিয়ে পড়লে তার মধ্যে অ্যালকোহল গ্যাঁজালে আবার গরম জল আস্তে আস্তে মিশিয়ে বাঁশের পাইপ বা ষ্ট্র-এর সাহায্যে পান করা হয়। পাহাড়ি ঠাণ্ডায় শরীর গরম রাখার অন্যতম উপকরণ এটি। তবে এটা একটা পন্থা যেটা তুলনামূলক সহজ। এর উৎপত্তি তিব্বত মনে করা হলেও বিভিন্ন পাহাড়ি জনজাতি যেমন লেপচা, নেপালি, লিম্বু, তিব্বতী, তামাং, শেরপা বিভিন্ন ভাবে বিভিন্ন মিশ্রণ সহযোগে পান করে থাকে। আসলে পাহাড়ের উচ্চতার উপর নিশ্চয়ই এর উপকরণ এবং নেশার ধরন বদলে যায়। তবে যাই হোক ডুয়ার্সের স্হানীয় মদ যতটা খুল্লম খুল্লা এ ততটা নয়। পাহাড়ি মানুষদের সরল জীবনযাত্রা আর নিজেদের সংস্কৃতির প্রতি দায়বদ্ধতা এই পানীয়কে অতটা সহজলভ্য করেনি হয়তো।

(১৩)

বীরপাড়া, কালচিনি, হাসিমারা, হ্যামিল্টনগঞ্জ, মাদারিহাট, বিন্নাগুড়ি, বানারহাট এইসব অঞ্চলে লোকাল দেশি বিদেশি হাঁড়িয়ার সঙ্গে আরেক ধরনের মদও পাওয়া যায়, যার আমদানি ভুটান থেকে। সোজা বাংলায় ভুটানি মদ। দাম কম। ফুল তুষ্টি। বিলাতি যারা অ্যাফর্ড করতে পারে না, আবার দেশীতেও নাক সিঁটকোয় তাদের জন্য ভুটানি। মদের রং টকটকে লাল। সে হুইস্কি হোক বা রাম। কোনও তফাৎ নেই। নেশা জমানোর জন্য বোতলে হাল্কা নেশার ট্যাবলেট মেশানো থাকে। উৎসব অনুষ্ঠানে চাহিদা বেশি থাকলে এ জিনিস কোচবিহার আলিপুরদুয়ার জেলা সদরেও পৌঁছে যায়। এর সঙ্গে অবশ্য ভুটানি বিয়ারও আছে। নব্বইয়ের দশকের ছেলেদের কাছে এ এক আলাদা নষ্টালজিয়া। বিয়ারের এত ভ্যারাইটি আর এত দোকানও তখন ছিল না। রাত্রিবেলা ভাঁড়ারে টান পড়লে অগত্যা খালাসিপট্টি আর অবধারিত ভুটানি বিয়ার। একই গল্প আবার শিবমন্দিরে ইউনিভার্সিটির দিনগুলিতে। সেখানে ভুটানির বদলে সিকিমের বিয়ার আর এলাচের গন্ধযুক্ত সিকিমের ব্র্যান্ডি। আহা, মরে গেলেও ভোলা যাবে না!

(১৪)

মদ ছাড়াও আরো অনেক রকমের নেশার কথা আমরা জানি, দেখি, দেখেও না দেখার ভান করি। আরেকটি ভয়ংকর নেশার মারাত্মক পরিণতি দিয়ে এই লেখা শেষ করব। আমরা অনেকেই ট্রেনে যাতায়াতের সময় এক ধরনে ছেলেদের দেখা পাই যাদের গড় বয়স চোদ্দ থেকে পঁচিশ। তারা বিভিন্ন ষ্টেশনে আসে। কোনোমতে কামরাটা ঝাঁট দেয় এবং যাত্রীদের থেকে টাকা তোলে। যে যা দেয়। কোনো জোর নেই। কোনো দাবি নেই, কিছু চাওয়া নেই, শুধু শুকনো ঘোলাটে দৃষ্টি। যা নোংরা জামাকাপড়ের সঙ্গে হয়তো সামঞ্জস্যপূর্ণ। ট্রেন ছাড়াও পথে ঘাটে ফুটপাতে রেললাইনের ধারে ঝুপড়ি বসতিতে এই বয়সী ছেলেদের চোখে পড়বে।

একটু লক্ষ্য করে দেখবেন এরা মাঝে মাঝেই বুকের বাদিকে অথবা ডানদিকে মুখটা গুঁজে খুব জোরে একটা শ্বাস নেয়। দূর থেকে দেখলে মনে হবে বুকের ভেতর রাখা কিছুতে বুঝি ফুঁ দিচ্ছে। আসলে গন্ধ নেয়। ডেনড্রাইটের গন্ধ, কোনো সময় জুতোর কালি মিশ্রিত। সারাদিন ধরেই এটা পর্যায়ক্রমে চলতে থাকে। খাওয়াদাওয়া যেখানে গৌণ। এর ফলে অল্পবয়সেই কিশোররা তীব্র শ্বাসকষ্ট, মাথা ঘোরা, দুর্বলতায় ভোগে। কিডনির কার্যক্ষমতা কমে যায়। অজ্ঞান হয়ে অসহায়ভাবে পড়ে থাকে। এর পেছনে কত বড়ো চক্র কাজ করছে তা আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু আশার কথা অনেক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা এদের নেশামুক্তির মাধ্যমে মূলস্রোতে ফেরানোর চেষ্টা করছে। তাদের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। 

পরিশেষে বলব মানুষ ভেদে বদলে যায় নেশার রকম ও মান। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নেশা স্বেচ্ছাকৃত। পরিমিতিবোধ জানা থাকলে ভালো সকলের।

 

ডিসক্লেইমার/বিধিসম্মত সতর্কীকরণ– মূলত লেখার নেশাতেই এই লেখা। লেখকের নেশা বলতে অক্ষরসাধনা। আর পাঠক যদি কোনো চরিত্র ও ঘটনার সঙ্গে মিল খুঁজে পান, তা নেহাত কাকতালীয় ও অনিচ্ছাকৃত বলে গণ্য করা হবে।

করোনা কালের প্রতিবেদন ফ্রি রিডিং

Disclaimer: Few pictures in this web magazine may be used from internet. We convey our sincere gratitude towards them. Information and comments in this magazine are provided by the writer/s, the Publisher/Editor assumes no responsibility or liability for comments, remarks, errors or omissions in the content.
Copyright © 2025. All rights reserved by www.EkhonDooars.com

Design & Developed by: WikiIND

Maintained by: Ekhon Dooars Team