সুমন ভট্টাচার্য
দেবী দুর্গার আরাধনাকে কি আপনি নারীশক্তির জয় বলে দেখেন?
দুর্গাপুজো কি আসলে মহিলাদের ক্ষমতায়ন বলে মনে করেন?
যদি এই ভাবনায় আপনি জারিত হন, তাহলে এই দুর্গাপুজোয় আপনি কী দেখবেন? কোন সিনেমা বা ওয়েব সিরিজ আপনার পছন্দের হতে পারে? হাইকোর্ট যখন পুজো মন্ডপের সামনে নো এন্ট্রি বোর্ড ঝুলিয়ে দিয়েছে, তখন ওয়েব সিরিজ দেখাই তো সেরা বাজি হতে পারে।
আর দুর্গাপুজোর মুড, নারীর ক্ষমতায়ন ইত্যাদি যদি আপনার মাথার মধ্যে ঘুরপাক থেতে থাকে, তাহলে দেখে ফেলুন ডেনমার্কের ওয়েব সিরিজ বর্গেন। বর্গেন আসলে ডেনমার্কে তৈরি হলেও গোটা বিশ্বে দেখানো হয়েছে। ১২০টি দেশ নিজেদের নিজেদের ভাষায় অনুবাদ করে দেখিয়েছে| ইংল্যান্ডে বিবিসি দেখিয়েছে, মার্কিন মুলুকে একাধিক নেটওয়ার্ক দেখিয়েছে,অস্ট্রেলিয়া, জাপান কিংবা দক্ষিণ কোরিয়াতেও বর্গেন মারকাটারি হিট। এমনই সেই হিট যে স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম নেটফ্লিক্স তিন সিজনের ১০টা করে এপিসোড, অর্থাৎ তিরিশটা এপিসোড আবার করে গোটা বিশ্বকে দেখাচ্ছে। এখানেই শেষ নয়, এই সিরিজের নির্মাতা অ্যাডাম প্রাইসকে নেটফ্লিক্স দায়িত্ব দিয়েছে বর্গেন ৪ বা সিরিজ বানানোর জন্য। সেই আগামী সিরিজের জন্য ইতিমধ্যেই ইউরোপ এবং আমেরিকায় প্রবল উত্তেজনা। দর্শকরা উৎসুক।
আদতে যেটা ডেনমার্কের রাজনীতিতে একজন মহিলার প্রধানমন্ত্রী হয়ে ওঠার গল্প, তাই নিয়ে গোটা বিশ্ব জুড়ে এইরকম হইচই কেন? ২০১০ সালে প্রথমবার দেখাতে শুরু করার পরেই কেন গোটা দুনিয়ার দর্শক মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গেছেন? মার্কিন মুলুকের ওয়াশিংটন পোস্ট বা নিউইয়র্ক টাইমস যে সিরিজকে বলেছেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ, সেই বর্গেনকে নিয়ে আলাদা করে আলোচনা তো হবেই।
একটা কারণ অবশ্যই ডেনমার্ক-এ বর্গেন যখন দেখানো শুরু হয়, তখনও ইউরোপের এই দেশে কোনো মহিলা প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন নি। বর্গেন-এর প্রথম সিরিজ দেখানো হয় ২০১০ সালে, আর ডেনমার্ক তার প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী পায় ২০১১ সালে। তাই পর্দার প্রধানমন্ত্রী ব্রিজিট নাইবর্গ বাস্তবের রাষ্ট্রপ্রধান হেলে থরমিং স্কিমিটকে প্রভাবিত করেছেন না উল্টোটা, অর্থাৎ স্কিমিট-এর ছায়াতে টেলিভিশন সিরিজের মহিলা রাষ্ট্রনায়কের চরিত্রের নির্মাণ হয়েছে, তাই নিয়ে গত এক দশক ধরেই পশ্চিমের দেশগুলোতে তুমুল আলোড়ন। কারণ কোনো টেলিভিশন সিরিজই বোধহয় আগামী দিন সম্পর্কে বা নিকট ভবিষ্যত বিষয়ে এত নিঁখুত পূর্বাভাস দিতে পারে না। এতটাই যখন মিলে যায়, তখন রিল লাইফ আর রিয়েল লাইফ নিয়ে ধন্দ তৈরি তো হবেই।
ইতিহাস, রাজনীতি এবং বিনোদনের কী আশ্চর্য সমাপতন দেখুন, নেটফ্লিক্স যখন আবার বর্গেনকে সিরিজ হিসেবে ফেরাচ্ছে, তখনও ডেনমার্ক-এর মসনদে ফিরেছেন আরেকজন মহিলা, এবং প্রধানমন্ত্রী হিসেবেই। মেটে ফ্রেডরিকসনের কুর্সিতে বসা এবং সিরিজ হিসেবে চতুর্থবারের জন্য বর্গেন-এর ফিরে আসা রাজনীতিতে মহিলাদের ক্ষমতায়নের এক নতুন আখ্যান রচনা করে।
প্রিয়াঙ্কা গান্ধী বা মহুয়া মৈত্র, আজকের ভারতীয় রাজনীতিতে যাঁরা মহিলা মুখ, তাঁরা বর্গেন সিরিজ দেখেছেন কিনা জানি না। যদি তাঁরা নাইবর্গ নামে এক মহিলার ইউরোপের এক দেশে প্রধানমন্ত্রী হয়ে ওঠার আখ্যান দেখতেন, তাহলে হয়তো জানতে পারতেন পশ্চিমী গণতন্ত্র কী ভাবে আজকে মহিলাদের ক্ষমতায়নকে চিত্রিত করে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে আকর্ষণীয় হচ্ছে ক্ষমতার বৃত্তে নতুন নতুন সমীকরণ তৈরি করতে করতে নাইবর্গ-এর আনঅ্যাপোলোজেটিক হয়ে ওঠা, অর্থাৎ একটা সময়ে ক্ষমতাকে প্রয়োগ করতে গিয়ে যখন তিনি লজ্জাকে ঝেড়ে ফেলছেন। এরই চূড়ান্ত উদাহরণ হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রাজনীতির মারপ্যাঁচ দিতে দিতে, আড়াই চাল-এ ঘুঁটি এগিয়ে দিতে গিয়ে নাইবার্গ যখন জানতে পারছেন স্বামী ডিভোর্স দিতে চান। ডেনমার্ক-এর সিরিজ-এর প্রধানমন্ত্রী তখনও ভেঙে পড়েন না, বরং পার্লামেন্ট এ তাঁর সেরা বক্তৃতাটা দিয়ে ম্যাচ বার করে নিয়ে যান।
রাজনীতিতে উত্তুঙ্গ সাফল্য ধরে রাখতে গেলে স্বামীকে ছাড়তে হতে পারে, বর্গেন সিরিজে যত সহজে বলে দেওয়া হয়, তা আসলে এই উপমহাদেশে মহিলা রাজনীতিকদের, সফলদের মার্কশিটে চোখ বোলাতে সাহায্য করে।
বর্গেন সিরিজ হিসেবে যতটা সাড়া জাগানো, ততটাই আলোড়ন ফেলে দিয়েছেন নাইবার্গ-এর চরিত্রের অভিনেত্রী সিডসে বাবেট কুনসেন। কুনসেন এমন একজন অভিনেত্রী, যিনি স্ক্যান্ডিনেভিয়া থেকে উঠে এলেও পর্দায় কখনও নগ্ন হন না, অথচ আবার গার্ডিয়ান-এর মতো পত্রিকা তাঁর সম্পর্কে লেখে সেক্সিয়েস্ট প্রাইম মিনিস্টার অফ দ্য ওয়ার্ল্ড। নিজের সম্পর্কে যিনি সব জায়গায় বলেন অবিবাহিত, কিন্তু ১১ বছরের একটি সন্তানের মা ও, সেই কুনসেন নিজের অভিনয়, সংলাপ বলার ধরন দিয়ে নারীবাদ এবং আধুনিকতার এক নতুন নির্মাণ করেছেন। ডেনমার্কের এই তারকা গত এক দশক ধরেই ইউরোপের সবচেয়ে আলোচিত অভিনেত্রী, টম হ্যাঙ্কসের বিপরীতে ইনফার্নো-তে নায়িকা হয়েছেন, কিন্তু হলিউডে অভিনয় নিয়ে তাঁর কোনো উদগ্রতা নেই|
মহিলাদের ক্ষমতায়ন বুঝতে গিয়ে দুর্গাপুজোর মধ্যে যদি বর্গেন দেখেই ফেলেন, তাহলে আরেকটি বিষয় চমৎকার ভাবে উপলব্ধি করবেন। বুর্জোয়া গণতন্ত্র কী ভাবে চলে। এবং বিশ্বের অন্যতম ধনী দেশেও অনুপ্রবেশ, অভিবাসন বা রাজকোষের অর্থ ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার কতটা বড় রাজনৈতিক বিতর্ক তৈরি করতে পারে।
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team