নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে উত্তরবঙ্গ এক্সপ্রেস সবে ঢুকছে, ঘুম ভাঙার শব্দের ভেতর ভেসে আসছে চায়ের ডাক... ধীরে ধীরে চোখের সামনে থেকে সরে যেতে থাকে একের পর এক দোকান। সেখানে হাওয়া বালিশের পাশেই আনারসের বৈঠক। তারপরেই দেখি ভাজা হচ্ছে পরোটা। ডিমের ওমলেটের গন্ধ নাকে এল বুঝি। ট্রেন ধীরে ধীরে গতি কমিয়ে আনছে। দরজায় দাঁড়িয়ে মনে মনে ভাবছি একটা স্টলের সামনে দাঁড়ালেই হয় এবারে। টক করে নামব। খুব করে চাই এক কাপ চা। গত রাতে কখন খেয়েছি রাতের খাবার, বর্ধমান পেরোতে না পেরোতেই। ট্রেনে বাড়ির মতো গাবিয়ে খাওয়া যায় না। একা থাকলে একটু সাবধানে থাকতেই হয়। অগত্যা চায়ে মন। ধন্য ধন্য এ জীবন...
প্রতিটি স্টেশনের যেমন আলাদা গন্ধ থাকে, তেমনি থাকে চায়ের মৌতাত। এক যাত্রায় চায়ের ভেতর এমন ডুবে গিয়েছিলাম, ট্রেন দিয়েছে ছেড়ে। চলে যেতে থাকা ট্রেন দেখে মনে হয়েছিল দাঁড়িয়ে থাকি এই ছবির মতো জায়গায়। না, সহযাত্রীর চিৎকার, দোকানির আন্তরিকতায় পা চালিয়ে ধরে ফেলেছিলাম তাকে, যার টিকিট কাটতে গেলে অবধারিতভাবে খুঁজে নিতাম চায়ের দোকান। লাইনের ঠিক আগে থাকা ব্যক্তিকে বলতাম—একটু চা খেয়ে আসছি। আমি কিন্তু আপনার পেছনে আছি। আগুপিছু জীবনে এমন এক অসুখ এল, চা আর ঠোঁটের দূরত্ব বেড়ে গেল অনেকটাই। মাঝেমাঝে ঘুমের ভেতর কিষাণগঞ্জ থেকে কেটলি আর ভাঁড় নিয়ে উঠে আসে এক নবীনকিশোর... আমি তাকে ডাকতেই থাকি কিন্তু সে শুনতেই পায় না!
(২)
প্রতিটি চায়ের দোকান যেন ভারতীয় উপমহাদেশ—কে লিখেছিল জানি না। লাইনটি খুঁজে পেয়েছিলাম আমার ডাইরির ভেতর। মানুষ দেখা যাদের শখ, তারাই বুঝি আড্ডা জমায় ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ। একটা চিনি দিয়ে লাল চা, দাদা আমার চিনি ছাড়া দুধ চা, আমার সব চলবে, হে হে সুগার আছে যদিও তবু চিনি ছাড়া চা খাওয়ার কথা ভাবতেই পারি না। কত কত কথা ভেসে বেড়াত উনুনের ধার ঘেঁষে, কয়লার আঁচে, পুরোনো ক্যালেন্ডারের গায়ে, মা কালীর ছবির ধুলোয়, ডিমের ঝুড়িতে। দোকানের বেঞ্চিতে বসেই ঢকঢক করে জল খেয়ে নিতেন যে ফেরিওয়ালা, তাঁর কথা মনে পড়ে মাঝেমাঝে। বিস্কুট নিয়ে কুকুরদের খাওয়াতে ভালোবাসতেন যে কাকু, তিনি ইদানীং বাড়ি থেকে বেরোচ্ছেন না। ভোটের আগে বেশ সরগরম ছিল এই অঞ্চল। রঙের দোলায় নতুন নতুন পেপার পড়ার ধুম। পরিসংখ্যানের কচকচি। আপনি আমার থেকে বেশি জানেন একথা গায়ে মাখত না কেউ। নিন, আরেক কাপ চা নিন, উত্তেজিত হয়ে গেছেন আপনি। উল্টোদিকের মেজাজ জল হয়ে যেত চায়ের কাপ আসার আগেই।
(৩)
ভোটের পর দুয়ারে সরকার এল। করোনা গেল না। মানুষ গণতন্ত্রের উৎসবে ভুলে যেতে বসেছিল করোনা আছে না নেই। সমবেত এই দ্বিধা-বিস্মৃতির মধ্যে ভাইরাস তার দ্বিতীয় ইনিংস শুরু করল। এবার আরো ভয়ঙ্কর। আরো মারকুটে। খবর কাগজে, ফেসবুকে ঘুরতে লাগল মৃতদেহ আর চিতার ছবি। যেন সব দোষ যোগীর। আবার ভোগীরা লকডাউন ঘোষণার ঠিক আগে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে রইল; বাজার সে ছবি আনন্দে ছাপল। কেউ মনে করিয়ে দিল রাজস্ব যার, লাইন তার।
এই দেখুন বলছিলাম চায়ের কথা, এসে যাচ্ছে চাটের প্রসঙ্গ। অবশ্য চা আর ইয়ের মধ্যে দিল মাঙ্গে মোর ব্যাপারটা কমন বইকি। বেকারির বিস্কুট আর মেটে চচ্চড়ির মধ্যে হাইফেন হয়ে বেঁচে থাক বাবা জীবনকাকু।
আজ আছি এবং কাল চলে যেতে পারি দুটোকেই সমানভাবে গ্রহণ করার জন্য চা দোকানে যাওয়ার দরকার হত। বিধি বাম, নিধি রাম। এই মাসের মাঝামাঝি লকডাউনের নয়া অবতার এল। জমায়েত এড়াতে পুলিশ হল সক্রিয়। যে দোকানে চা খেতাম, ঝাঁপ বন্ধ হয়ে গেল। পুলিশ ফ্লাস্ক নিয়ে গাড়িতে উঠল। পরে পাত্রটিকে ফেরত পাওয়া গেল অবশ্য। কিন্তু কাচ ভেঙে গেছে তার, মনও!
সকালে নিয়ম করে বেরোই আর বন্ধ চা-দোকানগুলির সময় কুড়োই। কানুদা এবার আলু পেঁয়াজের দোকান দেবার কথা ভাবছে। দু-একজন বন্ধুরা মিলে কিছু সাহায্য করব ঠিক করেছি। যতটুকু পারা যায়। কানুদা এখনও মন থেকে এই পরিবর্তনকে মানতে পারছে না। বন্ধ দোকানের সামনে সাইকেল নিয়ে রোজ দাঁড়িয়ে থাকে। আমরা সবাই বলেছি কদিন এভাবেই চালিয়ে নিন। আবার না হয়...
পূর্বাভাস বলছে ঝড় আসতে চলেছে। ভীষণ। আশঙ্কারা কখনোই মিথ্যে হচ্ছে না আর। শুধু ভাবছি কানুদার চায়ের দোকানটা কবে খুলবে আবার। আমরা আগেরমতো আবার আড্ডা জমাতে পারব? দোকানে ভিড় করা সব মানুষগুলো বেঁচে থাকবে? আমাদের সব রূপকথারা যে চায়ের কাপ হাতে প্রজাপতির অপেক্ষা করছে!
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team