চৈতালী দে (নাথ)
মাথার ওপর নীল আকাশ, ইতিউতি উঁকি মারা পেঁজা তুলোর মতো মেঘ আর বাতাসে হালকা শিরশিরানি জানান দেয় শরতের আগমন। টলটলে দীঘির জলে ফোটা পদ্ম, দিগন্ত জোড়া কাশ ফুলের সমারোহ আর ভোরের বেলা বৃন্ত থেকে খসে পড়া শিশিরে ভেজা শিউলি ফুল ওতঃপ্রোত ভাবে জড়িয়ে শরতের সাথে। উৎসব প্রিয় বাঙালির ভালোবাসার ঋতু শরৎ। এই ঋতুই দেবী দশভূজার মর্তে আগমনবার্তা নিয়ে আসে। মনে জাগায় আনন্দ-দোলা। চারিদিকে আলোর রোশনাই, ঢাকের আওয়াজ, মণ্ডপসজ্জা, কচিকাঁচাদের হুল্লোড় এক উৎসব মুখর পরিবেশের সৃষ্টি করে। এ বছর নীল আকাশ, কাশফুল, শিউলি, মায়ের আগমন সবই রইলো, কিন্তু উৎসব পালন একটু অন্য রকম ভাবে। পৃথিবী জুড়ে অতিমারীরূপী অসুর এই আনন্দ প্রকাশে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভীত-সংকুচিত আমরা অবাধ্য মনকে রাশ টেনে ধরার চেষ্টা করছি। বারে বারে স্মৃতিতে ফিরে আসছে বিগত বছরগুলোর দুর্গোৎসব।
ছেলেবেলায় বর্ষার ঘনঘটা সরিয়ে যখন নীল আকাশ দেখতে পেতাম, মনে মনে তখন থেকেই পূজার প্রস্তুতি শুরু করে দিতাম। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠেই ছুটে যেতাম শিউলি গাছের নীচে। প্রথম প্রথম একটি-দুটি, তারপর ধীরে ধীরে গাছ ডালপালা উজাড় করে ফুল ঝরিয়ে আমাদের উঠোনটাকে সাজিয়ে দিত। আর আমি একটা একটা করে বহু যত্নে সেই ফুল তুলে নিতাম সাজিতে। কখনো ছুটে যেতাম নদীর ধরে, কাশ ফুল দেখতে। পূজা মানেই এক ঝাঁক আনন্দ। পূজা মানেই নতুন জামা আর ছুটির ঘন্টা। পূজা মানেই বড়োদের প্রশ্রয় পাবার ছাড়পত্র।
'আশ্বিনের শারদ প্রাতে, বেজে ওঠে মঙ্গল শঙ্খ’ মহালয়ার দিন ভোরে এই ধ্বনি দিয়েই শুরু হয়ে যেত আমাদের পূজা। পুরোনো রেডিওটা, যেটাতে বছরভর ধুলো জমতো সেটা আগের দিন বের করে ধুলো ঝেড়ে ব্যাটারি ভরে চালিয়ে দেখে নেওয়া হতো ঠিকমতো কাজ করছে কিনা। তারপর সারা রাত জেগে ভোরের অপেক্ষা। ভোরের দিকে কচি দুচোখের পাতা কখন যেন বন্ধ হয়ে আসতো। আর ঠিক তখনি সেই সুরেলা কণ্ঠ বার্তা দিত পিতৃপক্ষের শেষে মাতৃপক্ষের আগমনের। 'বাজলো তোমার আলোর বেণু, মাতলো রে ভুবন'। প্রকৃত অর্থেই প্রভাতে সেই সুর শুনে আমরাও মন-প্রাণ খুলে সব পেয়েছির ডানা মেলে উড়ে বেড়াতাম।

আটলান্টায় লেখিকার বাগানে ফুটেছে স্থল পদ্ম
বাড়িতে নিয়ম ছিল ষষ্ঠীর সকাল পর্যন্ত বই-পত্র শিকেয় তোলা যাবে না। অতএব নিয়ম করে পড়তে বসতে হতো। তবে পড়ার ফাঁকে ফাঁকেই চলতো নতুন কেনা জামা-জুতো পরে আয়নার সামনে ঘুরে ফিরে দেখা। বন্ধুদের থেকে পূজায় উপহার পাওয়া ভীষণ প্রিয় চুলের ক্লিপ, চুরি বা কানের দুলগুলো নতুন জামার সাথে মিলিয়ে মিলিয়ে পরা। এভাবেই একদিন শুনতে পেতাম পাড়ার পূজার প্যান্ডেলে ঢাকের আওয়াজ। বাড়ির ছোট থেকে বড়ো সবার মুখে এক অনাবিল আনন্দ ফুটে উঠতো। তারপরের দিনগুলো কেটে যেত ঘোরের মধ্যে দিয়ে।
সকাল সকাল স্নান সেরে একটু কম ভালো নতুন জামাটা পরে, পায়ে নতুন জুতো গলিয়ে পৌঁছে যেতাম পাড়ার মণ্ডপে। সারাদিন ছুটোছুটি আর সেই সাথে ক্যাপ (টিনের তৈরী খেলনা বন্দুক) ফাটানো শেষে একবার বাড়িতে ঢু মারা খাবার জন্য। বিকেলে, আবার নতুন জুতোটা পায়ে গলাতে গিয়েই টের পেতাম ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটা ফোস্কা পড়েছে। কিন্তু তাই বলে তো আর পুরোনো জুতো পরা যাবে না। অগত্যা সেই নতুন জুতো পরে খোঁড়াতে খোঁড়াতে বিকেলে আবার প্যান্ডেলে উপস্থিত। একবার কেউ বলেছিলো দুপুরে একটু পাওয়ার ন্যাপ নিলে বিকেলে বেশ ফ্রেশ দেখাবে। ব্যাস, সেই থেকে চালু হলো সকাল আর বিকেলে প্যান্ডেলে ঘোরাঘুরির মাঝে একটু পাওয়ার ন্যাপ।
অবশেষে ক্লাস এইটে প্রথমবারের জন্য সুযোগ এলো বন্ধুদের সাথে ঠাকুর দেখার। সকাল বেলা এগারোটা নাগাদ এক বন্ধুর বাড়িতে সবাই জড়ো হলাম। তারপর সেখান থেকে বেরিয়ে রাজদীপ-এ (বহুদিন হলো রেস্তোরাঁটি বন্ধ হয়ে গেছে) বসে চিকেন ফ্রাইডরাইস খাওয়া হলো। বন্ধুরা কেউ কেউ অভিযোগ করলো চিকেনটা ভালোকরে রান্না হয় নি। আমি তখন প্রথমবার বন্ধুদের সাথে পূজায় বেড়ানো আর চিকেন খাওয়ার আনন্দে (চিকেনটা আমি কাঁচা ছাড়া আর যে কোনোভাবেই মহা আনন্দে খেতে পারি) ফ্রাইডরাইসএর কোন দোষ খুঁজে পেলাম না। খাওয়া শেষে রিকশা করে সোজা দুর্গা বাড়ী, যে ঠাকুর না দেখলে পূজা দেখা সম্পূর্ণ হয় না।

আটলান্টায় দুর্গাপূজা
রাতের বেলা বাড়ির সবাই মিলে হেঁটে হেঁটে সারা শহরের ঠাকুর দেখা। হেঁটে ঠাকুর দেখার যে মজা ছিল তা কখনো গাড়ি চেপে ঠাকুর দেখার মধ্যে পাইনি। নবমীর রাতে পাড়ার পূজার মণ্ডপে ধুনুচি নাচের প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করা আর একটা পুরস্কার নিয়ে মহা আনন্দে বাড়ি ফেরাটা একটা রুটিনের মধ্যে ছিল। অবশেষে দশমী। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠেই বুকের মাঝে একটা চিনচিনে ব্যথা। তবে সেটা কিছুক্ষনের মধ্যেই উধাও। আবার মণ্ডপে ছুট। মা-কাকিমাদের ঠাকুরকে সিঁদুর পড়ানো আর সেই সাথে পাড়ার জেঠু-কাকুদের নাগাড়ে তারা দেওয়া সব নিয়ে এক হুলুস্থুল কান্ড। একে একে সব মূর্তি ট্রাকে তোলা হতো। আর আমরা সেই সাথে ট্রাকের ভেতর। সাথে অবশ্যই বাবা অথবা কাকা।
প্রবাসে প্রথম পূজার স্মৃতি ছিল বড়ই বেদনাদায়ক। দুচোখ ফুলিয়ে কেঁদে সারাটা পূজা কেটেছিল। তারপর ধীরে ধীরে এই প্রবাসের পূজার সাথে এমনভাবে জড়িয়ে গেলাম যে এই সময় অন্য কোথাও গিয়ে কাটাবার কথা মনেই আসে না। এখানে পূজা বলতে শুক্রবার সন্ধে থেকে রোববার সন্ধ্যে পর্যন্ত, সে পঞ্জিকা মতে পূজার নির্ঘন্ট যাই হোক না কেন। আসলে এখানে তো আর দেশের মতো পূজার ছুটি বলে কিছু নেই, তাই আমরা শুক্রবার অফিস-কলেজ-ব্যবসার কাজ মিটিয়ে তারপর পূজার আয়োজনে মেতে উঠি। ষোলকলা বাঙালিয়ানা বজায় রেখে খাওয়াদাওয়া, ঝলমলে শাড়ী -সাজসজ্জা, আড্ডা, ঢাকের তালে নাচ আর নানা রকম সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে পূজার দিনগুলো যেন এক আশ্চর্য জাদুবলে বড্ড তাড়াতাড়ি পেরিয়ে যায়। অবশেষে রোববার প্রতিমাকে প্রণাম জানিয়ে বাক্সবন্দী করে রেখে দেয়া হয় পরের বছরের প্রতীক্ষায়।
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team