‘গ্রাম’ শব্দটি উচ্চারণ করলেই কেমন মনটা শান্ত হয়ে যায় না? চোখের সামনে ভেসে ওঠে সবুজ ছায়া ঘেরা শান্তির নীড়। আমার গ্রামটিতে প্রবেশ করলেই আপনাকে স্বাগত জানাবে রাস্তার পাশে কদম, সেগুন, ইউক্যালিপ্টাস গাছের সারি। মাঠ জুড়ে সবুজ ফসলের মনোরম দৃশ্য সব ক্লান্তি শুষে নেবে চটজলদি। পৃথিবীর গভীরতর অসুখে, পরিবর্তিত সময়ে, এই গ্রামের জীবনকেই ফিরে ফিরে দেখতে ইচ্ছে করে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গ্রামীণ জীবনেও পরিবর্তন এসেছে কোনও সন্দেহ নেই। গ্রামের অনেকেই পরিযায়ী শ্রমিক হিসেবে পাড়ি দিয়েছে বাইরে, তারা রোজগারের সঞ্চয় পাঠায় দেশে। সরকারি ভাতা-অনুদান-রেশনও গ্রামের দরিদ্র মানুষের হাতে নগদ অর্থ এনে দিয়েছে। স্বভাবতই গ্রামীণ জীবনেও ভোগবাদের ছোঁয়া লেগেছে। কৃষিকেন্দ্রিক অর্থনীতিতে বছরভর চালিয়ে দেওয়ার কথা ভাবতেই পারে না আর গ্রাম, ফলে কেউ কেউ যোগ দিচ্ছে নানা শহুরে পেশায়, কেউ কেউ বা জড়িয়ে পড়ছে অবৈধ কারবারে। কিছু মানুষ অবশ্য বিভিন্ন পেশা থেকে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে ফিরে আসছে গ্রামেই, যদিও সংখ্যায় তারা কম।
করোনাকালে গ্রাম থেকে শহরে রোজগার করতে যাওয়া এইসব প্রচুর মানুষ কাজ হারিয়েছে। অতিমারি বহু মানুষকে ঘরে ফিরতে বাধ্য করেছে। শহরের বিভিন্ন কলকারখানা থেকে ফেরা এই বিপুল সংখ্যক শ্রমিকদের সকলের পক্ষে কৃষি জমিতে নিযুক্ত হওয়া সম্ভবপর নয়। একে মাথাপিছু চাষের জমি নগণ্য, তার উপর নানা উন্নত প্রযুক্তি কৃষিকাজে শ্রমিকের ব্যবহার কমিয়ে দিয়েছে। কৃষকরা ফসল ফলালেও এসময় অতিমারি লকডাউনে হাট-বাজার পুরো খোলা না থাকায় বিক্রির সুযোগ কমে গেছে। যাদের কৃষিজমি নেই, বিকল্প পেশার সন্ধান না পেয়ে তাদের জীবনযুদ্ধ কঠিনতর হয়েছে।
এই অতিমারি পরিস্থিতিতে গ্রামের মানুষের অসহায়তার সুযোগ নিয়ে দৌরাত্ম্য বেড়েছে কিছু অসাধু মহাজন, ব্যবসায়ীদের। মহাজনদের লোলুপ দৃষ্টি যেন পড়েছে সাধারণ মানুষের শেষ সম্বল ঘটি-বাটির উপর। ছেলেমেয়ের বিয়েসাদি, নানা রোগভোগের চিকিৎসা অপারেশন ইত্যাদির খরচ তুলতে গিয়ে অনেকেই কম দামে কৃষিজমি বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে। যাদের কিছু গবাদি পশু আছে তারা অভাবের তাড়নায় ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করতে চাইলে বাজার মন্দার নাম করে প্রায় অর্ধেক দামে কিনে নিচ্ছে। যে গরুর দাম একসময় দশ হাজারের উপরে ছিল তা নেমে দাঁড়িয়েছে ছয় হাজার টাকায়। গ্রামের যে ছেলেমেয়েরা পড়াশুনার মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে শহরে থাকে তাদের অনেক শিক্ষার্থী ঘরে ফিরতে বাধ্য হচ্ছে। কর্মসংস্থান না থাকায় অসৎ পথে উপার্জন ও নেশা করবার প্রবণতা বেড়েছে আগের থেকে অনেক বেশি। স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় কিশোর-যুবকরা অনেকেই আসর জমিয়ে মদ ও জুয়ার নেশায় মেতে উঠেছে। করোনা আবহে সব মিলিয়ে এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির সামনে গ্রামের পর গ্রাম।
সরকারের দয়ায় ভাতের অভাব না থাকলেও গ্রামেও সুস্থ জীবন নির্বাহ করা আজ রীতিমত কষ্টসাধ্য হয়ে উঠেছে, সংস্থানহীন মানুষ আজ অসহায় অলস দিন কাটায় সুদিনের অপেক্ষায়। তবু এই দুর্দিনে গ্রামের স্বনির্ভর গোষ্ঠী যেটুকু আশার আলো জাগিয়ে রেখেছে, সরকারি কৃষিকল্যাণ সমিতির পরামর্শে ছাগল হাঁস মুরগি পালন করে তাদের সামান্য হলেও সংস্থান হচ্ছে। এই মহা সংকটের কবল থেকে কবে কীভাবে গ্রামের মানুষদের রেহাই মিলবে তা ভবিষ্যতই বলবে। বিজ্ঞান একদিন ভাইরাসকে পরাজিত করবে, জীবন ছন্দে ফিরে আসতে চেষ্টা করবে। কিন্তু গ্রামজীবনে তার প্রভাব থেকে যাবে দীর্ঘকাল।
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team