নন্দিতা বাগচী
হ্যাঁ দেবীপক্ষের সূচনা হয়ে গিয়েছে। আকাশ-বাতাস সলা-পরামর্শ শুরু করেছে। নীল আকাশের সাদা মেঘের পরিযায়ী ভেলারা এসে হাজির হয়েছে। ভোরের বাতাসে সুরভি ছড়াচ্ছে শিউলি ফুলের দল। শহরতলির খালেবিলে কুমুদিনীরাও কুঁড়ি মেলেছে।
প্রকৃতির আয়োজন সম্পূর্ণ হলেও দেশবাসীর মনে আনন্দ নেই। এক ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জীবাণুর ত্রাসে আতঙ্কিত হয়ে আছেন আবালবৃদ্ধবনিতা। সর্বদাই মনে ভয় এই বুঝি ছুঁয়ে দিল জুজুবুড়ি আর ‘আউট’ হয়ে গেলেন এই ধরাধাম থেকে। এ যেন পুরানের সেই বক রাক্ষস। রোজ যার প্রয়োজন হতো মনুষ্য-শরীর।
তাই এ বছর ঢাকে কাঠি পড়বে কিনা জানি না আমরা। জানি না শিশুদের গায়ে নতুন জামা উঠবে কিনা। নতুন জুতোর ফোসকাতেও যে কী সুখ জানবে না হয়তো তারা।
তবে ঘরে বসে স্মৃতিচারণ করতে তো মানা নেই। এই আমি যেমন আজকাল প্রায়ই কাকভোরে ফুল চুরি করতে যাই ডুয়ার্সের তাসাটি চা বাগানের বড় সাহেবের কুঠিতে। কখনও মাঝরাতে ঘুরে আসি কলকাতার মহম্মদ আলি পার্ক, সুরুচি সঙ্ঘ কিংবা একডালিয়া এভারগ্রিন থেকে। অষ্টমীর দুপুরে পাত পেতে খেয়েও আসি দিল্লি কালীবাড়ি থেকে। আবার সন্ধি পুজোর সন্ধিক্ষণে কয়েক হাজার মাইল ডিঙিয়ে গিয়ে হাজির হয়ে যাই নাইজেরিয়ার যস শহরে। শনি-রবিতে বস্টন কিংবা সানফ্রান্সিসকোর কোনও স্কুলে গিয়ে কাটিয়ে আসি ষষ্ঠী-সপ্তমী-অষ্টমী-নবমী-দশমী।
হ্যাঁ, দেশে-বিদেশের নানা শহরের দুর্গাপুজোয় উপস্থিত থেকেছি আমি। তবে এ বছর কোনও পুজো মণ্ডপে যাবো না সেকথা নিশ্চিত। তাই ঘরে বসেই নয়তো মনের পর্দায় দেখি সেসব দৃশ্য। স্থান-কাল আলাদা হলেও পাত্র একজনই। নেই কোনও কুশীলবও।
প্রথম দৃশ্য : ডুয়ার্সের তাসাটি চা বাগান। ছ’য়ের দশক।
তখন আমার পুজোর গন্ডি ছিল তাসাটি চা বাগান, বীরপাড়া প্রাইমারি স্কুলের মাঠ, বানারহাটের মেলা, মাকড়াপাড়া কালীবাড়ির বাহান্নটা সিঁড়ি ও ফালাকাটার মুজনাই নদীর বিসর্জন। আর ছিল জলপাইগুড়ি শহরের ডিবিসি রোডের ‘আবরণী’র জামা ও বীরপাড়া প্রিয়া শু স্টোর্সের জুতো। ব্যস, এটুকুই ছিল আমার স্বপ্ন, এটুকুই ছিল আমার পৃথিবী।

ছবি - দিব্যেন্দু ভৌমিক
দ্বিতীয় দৃশ্য : কলকাতা শহর। সাতের দশকের প্রথম দিক।
কলকাতায় এসে জানলাম পুজো কাকে বলে! যেমন ঠাকুর, তেমনি মন্ডপ সজ্জা, তেমনি আলোর বাহার। সারারাত জেগে প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে ঘুরে ঠাকুর দেখার যে কী মজা, উপলব্ধি করলাম তখন। এখনকার মতো প্রতিযোগিতা তখন ছিল না ঠিকই, তবে আন্তরিকতা ছিল ষোলো আনা। পাড়ার পুজোয় অষ্টমীর অঞ্জলি, ভোগের খিচুড়ি প্রসাদ, বিজয়ার সিঁদুর খেলা মাতিয়ে রাখত আমাদের।
তৃতীয় দৃশ্য : নিউ দিল্লির বেঙ্গলি মার্কেট। সাতের দশকের প্রথম দিক।
তখন দিল্লিতে এত বাঙ্গালি ছিলেন না। তাই হাতেগোনা পুজো হতো। আমরা থাকতাম কনট প্লেস লাগোয়া বেঙ্গলি মার্কেটে। নামে বেঙ্গলি হলে হবে কী, বাঙ্গালি মোটে ছিলনা আশেপাশে। সেই ঠেঙ্গিয়ে যেতে হতো কমলানগরে কিংবা মন্দির মার্গের বাঙালি কালীবাড়িতে। তবে একবার সেখানে পৌঁছে গেলে আর বাড়ি ফেরার তাড়া থাকত না। কেননা সেখানেই ধুনুচি নাচ নেচে, ভোগের প্রসাদ খেয়ে, মেলায় ঘুরে, বাংলা নাটক দেখে মাঝরাত্তির নাগাদ বাড়ি ফিরতাম। আর বিজয়া দশমীর দিন যেতাম রামলীলা ময়দানে রাবন বধ দেখতে।
চতুর্থ দৃশ্য : পশ্চিম আফ্রিকার নাইজেরিয়া। সাতের দশকের মাঝামাঝি।
আরব সাগর ডিঙিয়ে যে শহরে গিয়ে পৌঁছলাম সেখানে আমরা তখন একমাত্র বাঙালি। একমাত্র ভারতীয়ও। বেশ কিছু পাকিস্তানি পরিবার ছিল সেখানে। ছিল ব্রিটিশ, স্কটিশ, পোলিশ, ইজিপশিয়ান, ফিলিপিনো পরিবারও। কিন্তু তারা কী করে জানবে দুর্গাপুজোর মাহাত্ম্য! তাই পাঁচশো মাইল ড্রাইভ করে আমরা গিয়ে হাজির হতাম যস শহরে। সেখানে বেশ কিছু বাঙ্গালি পরিবার ছিল। আর দুটি বাঙালি পরিবার পৃথিবীর যে শহরে থাকেন, সেখানে একটা দুর্গাপুজো হবেই। তবে যসের পুজোয় মৃন্ময়ী প্রতিমা থাকত না। থাকবেই বা কী করে? কলকাতা থেকে পাঁচবার প্লেন বদলে সেখানে পৌঁছবার হিম্মত তো মৃন্ময়ীদের থাকে না। তাই একজন বাঙালি আর্ট টিচার মোটা প্লাইউডের ওপরে মা দুর্গার সাঙ্গোপাঙ্গ সহ একটি প্রকান্ড ছবি আঁকতেন। তারপর করাত দিয়ে নিপুন ভাবে কেটে চমৎকার কাট আউট তৈরি করতেন। পূজারী ব্রাহ্মণও কেউ না কেউ জুটেই যেতেন পুরোহিত দর্পন সহ। তিনি হয়তো আদতে কোনও উচ্চশিক্ষিত ডাক্তার বা ইঞ্জিনীয়ার।
যসের পাশেই ছিল বাউচি শহর। সেখানকার চিফ আর্কিটেক্ট মৈত্রদা ও অরুন্ধতী বৌদি বিজয়ার দিনে চমৎকার বিচিত্রানুষ্ঠানের আয়োজন করতেন। রবি ঠাকুরের নানা নৃত্যনাট্য করেছি আমরা সেখানে। তারপর থাকত এলাহি ভোজের ব্যবস্থা। পোলাও-মাংস ছাড়াও পাঁচ-সাতশো রসগোল্লা, চমচম, রাঘবসাই, কাঁচাগোল্লা ইত্যাদি তৈরি করে ফেলতাম আমরা নিজেরাই। ‘হ্যাবিটাট’ রচনায় পারদর্শী বাঙালি চিরকালই।
পঞ্চম দৃশ্য : মার্কিন মুলুক। বর্তমান কাল।
এখন আমরা পুজোটা কাটাই আমেরিকার সানফ্রান্সিসকো কিংবা বস্টন শহরে। আমাদের পুত্র-কন্যার বাস সেখানে। সেসব শহরে পঞ্জিকা অনুযায়ী পুজো করার উপায় নেই। একে তো পুজোর ছুটি নেই, তার ওপরে মন্ডপ বাঁধার অনুমতি নেই। কিন্তু বাঙালি কি কখনও দুর্গা পুজোর সঙ্গে কোনও আপোশ করেছে? তাই পুজোর কাছাকাছি কোনও একটা সপ্তাহান্তে একটা স্কুলবাড়ি ভাড়া করে পুজোর ব্যবস্থা করা হয়। শনি-রবিতেই বোধন থেকে বিসর্জন। মাত্র দুটো দিনে পাঁচটি তিথি উদযাপনেও কোনও আক্ষেপ নেই। বেশ নিয়ম মেনে পুজো হয়। মৃন্ময়ী প্রতিমা নিয়ে যাওয়া হয় কুমোরটুলি থেকে। তবে বিসর্জন শুধু ঘটেই সমাপন করা হয়। প্রতিমা থাকেন বাক্সবন্দী হয়ে। পরের বছর আবার প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয় তাঁর।
বাঙালি মহিলারাই কোমর বেঁধে কয়েক হাজার পুণ্যার্থীর জন্য রেঁধে ফেলেন নানা সুখাদ্য। তাঁদের কেউ হয়তো নামজাদা ডাক্তার, কেউ মস্ত বিজ্ঞানী, কেউ ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কার। কলকাতা থেকে নানা শিল্পীদেরও উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয় অনুষ্ঠানের জন্য। বিদেশে আছেন বলে কি বাঙালিয়ানা খুইয়ে ফেলেছেন তাঁরা? নৈব নৈব চ।

ছবি - সত্যম ভট্টাচার্য
যবনিকা পতনের আগে :
আরও একটা কথা বলতে ইচ্ছে করছে। আমেরিকাতেও কিন্তু শরৎকালে কাশফুল ফোটে। আমি নিজের চোখে দেখেছি। সেবার অক্টোবর নাগাদ আমরা বেড়াতে গিয়েছি জর্জিয়া আর সাউথ ক্যারোলাইনা রাজ্যে। আমাদের পাঁজি অনুযায়ী দেবীপক্ষ চলছে তখন। হিলটনহেড আইল্যান্ড থেকে হাইওয়ে ধরে চলেছি সাভানা শহরের দিকে। হঠাৎ দেখি রাস্তার দুপাশে চামর দোলাচ্ছে যেন কারা। চোখ দুটো রগড়ে নিয়ে দেখি বিশুদ্ধ কাশফুলেরা হাতছানি দিয়ে ডাকছে আমায়। তাদের দেখামাত্র আবেগে উদ্বেল হয়ে উঠি আমি। চোখের সামনে নেচে বেড়ায় তিস্তা চরের কাশফুলেরা, কানে এসে ধাক্কা মারে ঢাকের বাদ্যি আর হাওয়ায় ভাসতে থাকে ধুনোর গন্ধ।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা হয়তো বলবেন, সে ছিল আমার হ্যালুসিনেশন, কিন্তু তাঁরা তো জানেন না শিকড় উপড়ে ফেলতে না পারার যন্ত্রণা কাকে বলে!
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team