টেরেস্ট্রিয়াল পদ্ধতিতে অর্থাৎ অ্যান্টেনার মাধ্যমে সম্প্রচারের দিন শেষ। এসেছে ডিজিটাল প্রযুক্তি। এই অজুহাতে জলপাইগুড়ি দূরদর্শনের আধ ঘন্টার কৃষিভিত্তিক অনুষ্ঠান এবং আধঘণ্টার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়ার নির্দেশ এসেছে সম্প্রতি। বিষয়টা নিয়ে তীব্র ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে উত্তরের শিল্পী এবং কলাকুশলী মহলে। এর পরিবর্তে কেন্দ্রীয় তথ্য-সম্প্রচার মন্ত্রক কৃষি বিষয়ক সম্প্রচারের ক্ষেত্রে ২৪ ঘন্টা ব্যাপী হিন্দি কৃষি চ্যানেল চালু করতে চলেছে এবং জলপাইগুড়ি দূরদর্শন কেন্দ্র থেকে সম্প্রচারিত কৃষিবিষয়ক আধঘন্টার আঞ্চলিক অনুষ্ঠান বন্ধ করে দিয়েছে। এই নিয়ে প্রতিবাদ জানালে তারা হিন্দিতে ক্যাপসুল আকারে ছোট ছোট অনুষ্ঠান পাঠাতে বলেছে আঞ্চলিক ভাষার অনুষ্ঠানের বদলে। আধঘণ্টার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান যেটুকুও বা চলছিল সেটুকুও গত মাসে একটি চিঠির মাধ্যমে বন্ধ করে দিতে বলা হয়েছে। অথচ আশ্চর্যের ব্যাপার হল, তামাম উত্তরবঙ্গব্যাপী কেন্দ্রীয় শাসক দলের নির্বাচিত সাংসদরা এবং উত্তরবঙ্গের সব নির্বাচিত বিধায়কেরা উভয় পক্ষই নিশ্চুপ। এ কী তবে কোনও গোপন বোঝাপড়া?
কেন্দ্রীয় তথ্য এবং সম্প্রচার মন্ত্রী তখন অজিত কুমার পাঁজা। উত্তরবঙ্গের আঞ্চলিক সংস্কৃতি সম্প্রচারের প্রয়োজনে উত্তরবঙ্গে একটি দূরদর্শন কেন্দ্র স্থাপনের প্রয়োজনীয়তার কথা অজিতবাবুকে জানান জলপাইগুড়ির তৎকালীন বিধায়ক দেবপ্রসাদ রায়। আবেদন গৃহীত হয়। কিন্তু দূরদর্শন কেন্দ্রের নাম হয় শিলিগুড়ি দূরদর্শন কেন্দ্র। জলপাইগুড়ির বৃহত্তর সুশীল সমাজ দেবপ্রসাদবাবুর কাছে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানালে সামগ্রিকক বিষয়টি দেবপ্রসাদবাবু প্রতিবাদ আকারে কেন্দ্রীয় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী অজিত পাঁজাকে জানালে সংশোধিত আকারে কেন্দ্রটির নাম হয় জলপাইগুড়ি দূরদর্শন কেন্দ্র। যাত্রাপথের সেটাই ছিল সূচনালগ্ন। রিলে সেন্টার হিসেবেই তখন অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হত। পরবর্তীকালে দেবপ্রসাদ রায়ের তৎপরতাতেই এটিকে পূর্ণাঙ্গভাবে দূরদর্শন কেন্দ্র হিসাবে রূপ দান করেন কেন্দ্রীয় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী থাকাকালীন প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি।
২০০৬-২০১২ সাল পর্যন্ত জলপাইগুড়ি দূরদর্শনের প্রোগ্রাম ইনচার্জ এর দায়িত্বে থাকা তপন রায় প্রধান বললেন, মিনি ভারতবর্ষ এই উত্তরবঙ্গের প্রান্তিক এলাকা রাজবংশী এবং আদিবাসী অধ্যুষিত হবার ফলে এই অঞ্চলে একটা দূরদর্শন কেন্দ্র গড়ে তোলার জন্য নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছিল কেন্দ্রীয় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রক। আজ আচমকা কেন্দ্রীয় সরকার কেন জলপাইগুড়ি দূরদর্শন কেন্দ্রটি বন্ধ করে দিতে চাইছে এই প্রশ্নের উত্তরে তপনবাবু জানান, ব্যক্তিগতভাবে তিনি মনে করেন প্রসার ভারতীর বরাদ্দ দিনে দিনে কমে যাচ্ছে। ২০০৯ সাল থেকে যখন আঞ্চলিক এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শুরু হয়েছিল সেই সময়ে সোম থেকে শুক্রবার এই পাঁচ দিন সাড়ে চারটা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত কৃষিভিত্তিক অনুষ্ঠান এবং পাঁচটা থেকে সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত শিক্ষা, সংস্কৃতি, সাহিত্য বিষয়ক বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠান পরিবেশিত হত। সেই সময়েই বাজেট বরাদ্দ ছিল বছরে প্রায় দশ লক্ষ টাকা। স্থানীয় শিল্পীরা অনুষ্ঠান করে সঙ্গে সঙ্গে সাম্মানিক পেয়ে যেতেন। কিন্তু আঞ্চলিক অনুষ্ঠানের জন্য বাজেট বরাদ্দ কমিয়ে মেট্রো অনুষ্ঠানের জন্য অধিক পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ করাই মূল লক্ষ্য বলে তপনবাবুর মনে হয়।
কিন্তু যেহেতু একটা অজুহাত খাড়া করতে হয় তাই ২০২০ সালের জুলাই মাসে প্রসার ভারতী একটি চিঠি দিয়ে আঞ্চলিক সম্প্রচার বন্ধ করার কথা জানিয়ে দেয় টেরেস্ট্রিয়াল পদ্ধতিতে অর্থাৎ অ্যান্টেনার মাধ্যমে কেউ সম্প্রচার দেখে না এই অজুহাতে। অথচ জানা গিয়েছে, জলপাইগুড়ি দূরদর্শন কেন্দ্রে আর্থস্টেশন আছে এবং ভবিষ্যতে কোনদিন অ্যান্টেনা বন্ধ হয়ে গেলে যাতে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা যায় সেই উদ্দেশ্য নিয়েই এই আর্থস্টেশন স্থাপিত হয়েছিল। উত্তরবঙ্গের প্রতি ভালোবাসা থাকলে কেন্দ্রটাকে আরও শক্তিশালী করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেত। এর বদলে উত্তরবঙ্গকে আরো অন্ধকারে ঠেলে দেওয়া হল। উত্তরবঙ্গের কলাকুশলী এবং শিল্পীরা বঞ্চিত হলেন বলে মনে করছেন তপনবাবুর মত আরও অনেকে।
দেবপ্রসাদবাবুর বক্তব্য, কেন্দ্রের শাসকদল করোনা আবহে এমনসব জনবিরোধী কাজ করছে যেগুলো রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করা সম্ভব হচ্ছে না। সংসদ যেহেতু বন্ধ তাই সংসদকে গোপন রেখেই এই ধরনের কাজকর্ম প্রশাসনিকভাবে কড়া হচ্ছে। এটা অন্যায়। উত্তরবঙ্গের সংস্কৃতির প্রতি এই আঘাতের বিরুদ্ধে স্থানীয় সাংসদ এবং বিধায়কেরা নিশ্চুপ দেখে তিনি বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। তাঁর পরিষ্কার বক্তব্য উত্তরবঙ্গের লোকসভার সমস্ত সাংসদেরা বিষয়টাকে মন্ত্রীর কাছে তুলে ধরলেই এবং বিধায়করা দলমত নির্বিশেষে বিধানসভায় বিষয়টি নিয়ে সোচ্চার হলে জলপাইগুড়ি দূরদর্শন কেন্দ্র বন্ধ হবার আশঙ্কা দূর হবে। তাঁদের সকলের উদ্যোগী হওয়া একান্তই প্রয়োজন। দেবপ্রসাদবাবু জানিয়েছেন উত্তরবঙ্গের সংস্কৃতি, ভাষা, সংগীতের যেভাবে কণ্ঠরোধ করার প্রচেষ্টা চলছে তাতে তিনি মর্মাহত।
তপনবাবুর মত আরও অনেকের বক্তব্য, উত্তরের মানুষকে তাদের নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। এই ব্যাপারে কেউ কোনওরকম প্রতিবাদ করছে না এটাই আশ্চর্যের। এই অসচেতন মনোভাব এবং দাবি আদায়ের ক্ষেত্রে গয়ংগচ্ছ ভাব থাকলে কোনওমতেই উন্নয়ন সম্ভবপর হতে পারে না। উত্তরবঙ্গের একমাত্র সরকারি সম্প্রচার মাধ্যম নীরব হয়ে যেতে বসেছে, অথচ কোনও মহল থেকে কোনও জোরালো প্রতিবাদ নেই! উত্তরের ক্ষমতা দখলে যুযুধান দুই পক্ষ ছোট ফুল ও বড় ফুল, দুপক্ষই ওয়ার্ম আপে নেমে পড়েছে মাঠে, অথচ অবাক কান্ড উত্তরের স্বার্থ নিয়ে কারও কোনও মাথাব্যথা নেই?
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team