সাগরিকা রায়
তিস্তাবঙ্গের বিস্তীর্ণ অঞ্চল, যা ডুয়ার্স নামে অভিষিক্ত, সে যেন এমন এক ভূমি, যেখানে বাইরের বাতাসের প্রবেশ নিষিদ্ধ। এই অঞ্চলের বাইরে এক বিশাল বহির্জগতের কথা ডুয়ার্সের মানুষ শুনতে চাইতো না। এমনকি সে “আছে” বলেও খানিকটা বিশ্বাস করতো। নার্সিসিজম ডুয়ার্সের বিশেষত্ব। আমার শৈশবের ডুয়ার্সের মানুষ বন কেটে বসত করেছে। পাঁচজনে মিলে একটি দুর্গামন্ডপ গড়ে তুলেছে। আমার বাবা শ্রীরণজিত দাস এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন। দুর্গামন্ডপের ধারে কাছে কেউ যেতে পারত না। কেয়ারটেকার ফ্যামিলি নিয়ে থাকতো। আমরা জানতুম দুর্গাবাড়িই হল কৈলাশ। দুর্গাঠাকুরের বাসস্থান। সেখানে ইচ্ছে হলেই যাওয়া যায় না। কিন্তু জুনমাসের হাফ ইয়ার্লি পরীক্ষা শেষ হতে হতে হাতে গোনা মাত্র তিনটি মাসের দিকে তাকিয়ে চন্ডীদাসের খুড়োর মত পড়াশোনা চালিয়ে যেতাম। ওদিকে কেউ কি জানে, কৈলাসে তিনি বাক্স পেঁটরা গুছিয়ে রাখছেন। অল্প অল্প করে নীল সাদা মেঘ ঢুকিয়ে রাখছেন বাক্সে। রাখছেন শিউলি, পদ্ম, অপরাজিতা…! আর রাখছেন সোনার দম্ভথলি ভরে একরাশ আনন্দ। তাতে আবার হীরেকুচি সেট করা। দিন এগিয়ে আসতে থাকে। বর্ষার জলে ভিজে থাকা বনচর, ঘন জঙ্গল ফের একরাশ রোদের জন্য আকাশ দেখে।
ক্রমে ডিপ্রেশনের মেঘ বিদায় নিতে থাকে। ঘরবাড়ি ঝাড়পোঁছ হয়। গুচ্ছের নারকেল পাড়ার জন্য বরাবরের মত হুসলুরডাঙা থেকে নিতাই মন্ডল এসেছে হিলহিলে রোগা শরীরটি নিয়ে। প্রত্যেকবারের মত বাবা এবারেও জিগ্যেস করে, “দেশ ছিল কোথায়?” নিতাইচরণ গাছে ওঠার জন্য দুপায়ের গোড়ালি ঘিরে দড়ি বেঁধে নিতে নিতে বলে, “আইজ্ঞা বরিশাল জিলা, সুন্দরকাঠি গিরাম।” এই শব্দটুকু শোনার জন্য বাবা উৎকর্ণ হয়ে থাকে। সে-ই কবে তাঁর খুড়োমশাই-এর হাত ধরে এই দেশে চলে আসা। বয়স তখন দশ। আস্তে আস্তে এখানেই বেড়ে ওঠা। বরিশাল থেকে বাইরে পা ফেলে আরেকটি জন্মভূমির খোঁজ পাওয়া। তারপরে বন কেটে বসত গড়ার কাজে হাত লাগানো। সংসার বেড়ে উঠল এই মাটির বুকেই। দেশের মাটির লোক দেখলে বাবার বুকের ভেতরে কেন যে ঢাক বাজে, তখন বুঝতে পারি নি। এ হল জন্মভূমির টান। দেবীও জানেন। তাই তো বাপের বাড়ি আসার জন্য সারা বর্ষাকাল কেঁদে ভাসালেন।
পুজোর একমাস আগেই শিরশিরে ঠান্ডা পড়তে শুরু করেছে। ভোরবেলায় বিছানায় শুয়ে শুয়ে ঠান্ডা পড়ার আভাস মেলে। টুপটাপ শিশির পড়তে শুরু করেছে টিনের চালে। উঠোন জুড়ে শিশিরে ভেজা মাটির বুকে রাতচরা কীটের পায়ের ছাপ। সেই সময় আসাম থেকে আসেন পাল মশাই। হাতে একখান গামলা। বাইরে থেকে জোরে হাঁক পাড়েন, “মা জননী গো, উঠেন। আইয়া পড়সি। নতুন গামলা দ্যান। মায়ের মূর্তি গড়ন শুরু হইব।” আহা হা…। সেই আওয়াজ ডুয়ার্সের কোনে কোনে, নদীর জলের স্রোতে, বনভূমি, পাহাড় ডিঙিয়ে, আকাশ ছুঁয়ে প্রাইমারী স্কুলের বেঞ্চে বেঞ্চে পৌঁছে যায়। মুরারী স্যারের হাতের বেতটা কেমন নড়বড়ে, নেলনেলে লাগে। পুজো…পুজো। তাহলে গণেশ ধরের দোকানে নতুন জামা আসতে শুরু করেছে? মায়ের শাড়ি, দাদার জামা, দিদির… জন্য শ্যামলাল, হারান দাস, সিং সনস-এ যাব কবে?
এই বঙ্গের সর্বত্র যে পুজো হবে, বঙ্গ ছাড়িয়ে আরও আরও কোথায় যে পুজো হবে, কুমোরটুলির মূর্তি রওনা দিয়েছে জাহাজে চেপে, সে খবর কাগজওলারা রাখুক, ডুয়ার্সের মানুষের তাতে কিচ্ছু হেলদোল নেই। দুর্গাবাড়ির ঠাকুর বেশি ভাল হল, নাকি স্টেশনপাড়ার ঠাকুর? নাকি শরৎ চ্যাটার্জী কলোনির ঠাকুর? এসব নিয়ে ঝগড়া হত। প্রত্যেকবার দুর্গাবাড়ির ঠাকুর বরমাল্য পেতেন। ইস্কুলে যাতায়াতের সময় একবার করে উঁকি দিয়ে মূর্তি গড়ার কাজ কতটা এগোলঁ, দেখে রঙ চড়িয়ে বাড়িতে এসে বলাও একটা বড় কাজ ছিল। আর লিস্ট করতে বসতে হত। পুজোয় কী কী কিনব। আনন্দ তো কেবল আমার একার নয়। আসমুদ্রহিমালয় জুড়ে সকলে খুশি।
দেখেছি, চা বাগানের শ্রমিক বোনাস পেয়েছে। বোনাস পাওয়ার খবর রাখার জন্য ব্যবসায়ীরা আড়কাঠি রাখে। তারা খবর দিতে রাতারাতি জিনিসপত্রের দাম আকাশ ছোঁয়া হয়ে যেত। তাই বাগানে বোনাস হওয়ার আগেই আমাদের কেনাকাটা কমপ্লীট করে ফেলা হত। নইলে কে না জানে যে এরপরে বোনাসের বাজারে কেনাকাটা করতে গেলে দোকানদার “গলা কাটা” দাম নেয় ? ভয় মুখ শুকিয়ে যেত থুম্বোমুখো শ্যামলালকে দেখলে। সে পকেটেই ছুরিটা রাখতো কিনা জানি না। বাগানের শ্রমিকরাও জানতো না। আর সেইজন্য দেদার খরচ করে টাকা উড়িয়ে দিত। হাটবারে মদ খেয়ে টলতে টলতে বাড়ি কোনদিকে ভুলে যেত। বড় শালতলায় দাঁড়িয়ে হেড়ে গলায় গান গায় “কাহা গেলি মনকা অন্দর বান্দর মুখিয়া… পিও পিও পিও এ বান্দর মুখিয়া…।” ঘোষবাবু বিরক্ত হয়ে তেঁতুলগোলা জল নিয়ে ঘাড় চেপে খাইয়ে দিতে, “এ শালো হামার নিশাটা খা লিয়া রে…পইসা চল গিয়া রে’’ বলে সে কি কান্না। এটাই চলতো। বোনাস হাতে পেয়ে দুইচারদিন কাজে যাবে না। খেয়ে শুয়ে ফুর্তি করে টাকা শেষ করে…। তার পুরো রস টেনে নিত বেওসা বোঝে যারা। একটা কটকটে হলদে ডেক্রনের শাড়ি, সিন্থেটিক শার্টের পকেটে টুনি বাল্ব জ্বালিয়ে দিয়ে বিক্রি হল চারগুণ দামে। তরাই-ডুয়ার্সের স্বাভাবিক ছবি এটাই।
কিন্তু আস্তে আস্তে ছবি পালটে যাচ্ছিল। বীরপাড়া চা বাগানের বুধু ওঁরাও বোনাস পেয়েই একমণ চাল কিনে ফেলল। সেদিন যখন ঘোষবাবু বুধুর বুদ্ধির প্রশংসা করলেন, হাফপ্যান্ট পরা জুতো পরা বুধুর নাক ফুলে উঠল বুদ্ধির গর্বে। ওর দেখাদেখি বাকিরাও একই পন্থা নিল। হাটের নেশার প্রলোভনের দিকে অনেকেই গেল না। হাড়িয়া বানাল বাড়িতে। ২০০২ সালে দেখেছি, পুজোর বোনাস পেয়ে পরের দিনই হান্ড্রেড পারসেন্ট শ্রমিক কাজে এল। বাগানকে বাঁচিয়ে রাখতে চায়।
লকডাউনে পাঁচমাসেরও বেশি বন্ধ থাকার পরে পুজোর আগেই ডুয়ার্সের সৌন্দর্য উন্মুক্ত হওয়ার আশ্বাস পেয়েছে টুরিস্ট। গরুমারা, চাপড়ামারি, রাজাভাতখাওয়া স্যাংচুয়ারি ডাকাডাকি করে। শরতের রূপ দেখে যাও। ট্রাকে করে ঠাকুর আসছে প্যান্ডেলে। একাদশীর দিন পুজোমন্ডপে বিষাদের সুর বাজে। দেবীকে মিষ্টিমুখ করিয়ে, পান্তা খাইয়ে, সিঁদুর পরিয়ে বিদায় জানিয়ে দেওয়া হল। শূন্য প্যান্ডেলে থাকে শুধু একখানি প্রদীপ অল্প একটু আলো আর তাপ নিয়ে। দেবী তখন জাঁকজমকের মন্ডপ ছেড়ে কটাদিন শান্তিতে থাকতে চাষীর মাটির ঘরে বিশ্রাম নিতে গিয়েছেন ভাণ্ডানী দেবী হয়ে। লৌকিক দেবী সংস্কৃতির মিশ্রণে কবে যেন দেবী দুর্গা হয়ে উঠেছেন। ডুয়ার্স জুড়ে এমন রূপকথারা ঘুরে বেড়ায়। শস্যে ভরা মাঠের ওপর দিয়ে ঢাকি দুজন যাচ্ছিল। ছুটে গিয়ে জিজ্ঞাসা করি, “কোথায় যাও গো?” তারা হাসে সাদা কাশফুল ছড়িয়ে। ঢাকে দুটো তাল তুলে একটা দিক দেখিয়ে দিল। তাকিয়ে দেখি বড়ই নীল সে আকাশ। বরফ কলের অল্প অল্প সাদা আইসক্রিম কে যেন ছিটিয়ে দিয়েছে নীলের আশেপাশে। বাজনদারেরা যাচ্ছে ভাণ্ডানী দেবীর পুজোয়।
ডুয়ার্সের পাঁচালী শব্দ সংখ্যায় বাঁধা যায় না। এ এক অমৃত কথা। দুর্গার পায়ের নূপুর দুর্গাবাড়িতে মধ্যরাতে বেজে ওঠে। পালমশাই চাদর মুড়ি দিয়ে সে গল্প করেন, “যেদিন আর সে শব্দ পাব না, বুঝব দেবী এইবারে আসেন নাই।”
আসেন দেবী। নূপুরের শব্দ যে শোনা যায় ডুয়ার্স জুড়ে !
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team