বিশ্ব পরিবেশ দিবসে এবার ডুয়ার্সের বনাঞ্চলে গিয়েছিলাম, করোনা কালের এই নিথর চরাচরে অরণ্য কেমন আছে তার খোঁজ নিতেই। জলদাপাড়ার অরণ্যের বৃষ্টিমুখর রূপ মোহময় করে তুলেছিল সামনের ঘন জঙ্গলকে, এপারের বনবসতিতে বসে চায়ের আমেজ নিতে নিতে মন ভালো হয় যে খবরে তা হল-- খাদ্যের সন্ধানে বসতিতে পোষা হাঁস মুরগির লোভে আর এখন জঙ্গলের বাইরে নাকি খুব একটা বেরোয় না লেপার্ড, কারণ জলদাপাড়ার জঙ্গলে চোরাশিকারের উপদ্রব কমে যাওয়ায় ইদানীং বাড়ছে চিতল হরিণের সংখ্যা, অতএব খাবার এখন জঙ্গলেই মেলে। বনকর্মীর অভাব রয়েছে বটে, গ্রামবাসীরাই নাকি এখন জঙ্গল পাহারা দেয়, দৈনন্দিন জীবন যাপনের ফাঁকে কড়া নজর রাখে জঙ্গলে বাইরের কেউ ঢুকছে কিনা। আপ্লুত হওয়ার মত খবর হলেও চিতল হরিণ বাড়বার আরেকটি কারণ হল গত এক দশকে জঙ্গলের চরিত্র খানিক বদলে দিয়েছে বনদপ্তর, ঘাসজমি বেড়েছে, ফলে ইকোসিস্টেমের খাদ্য-খাদকের চেইন মেনে বেড়েছে চিতল হরিণ, বেড়েছে লেপার্ড। অর্থাৎ আশা করাই যেতে পারে সিস্টেমে ও ছন্দে ফিরছে জলদাপাড়া জাতীয় উদ্যান। তার আগে দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে বনসম্পদ বাড়াবার উদ্দেশ্যে সেগুন গাছ বাড়াবার যে সরকারি নীতি ধ্বংস করে দিয়েছিল ডুয়ার্স জঙ্গলের ঘাসভূমি, অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছিল একেকটা প্রজাতি তার থেকে উল্টোদিকে ফেরা শুরু হয়েছে বলেই মনে হয়।
আসলে আমাদের উত্তরবঙ্গের পরিবেশ বলতে সবার প্রথমে আসে অরণ্যের কথাই। কারণ ৫০০০ বর্গকিমি গাছে ঢাকা এই অঞ্চলের ৩০০০ বর্গকিমি অরণ্যাঞ্চল বলে চিহ্নিত। উত্তর ভাগের হিমালয় আর দক্ষিণ ও পূর্ব ভাগের ডুয়ার্স-তরাই অঞ্চলে পরিবেশ সুরক্ষার চ্যালেঞ্জ কিন্তু তাই বাকি সমতল বা উপকূলীয় বঙ্গের চাইতে খানিকটা আলাদা। এখানে পরিবেশ রক্ষা মানে ফ্যাকটরি থেকে নির্গত বর্জ্য ও ধোঁয়া নয়, গাড়িঘোড়ার ধোঁয়া বা আওয়াজ নয়, নদীর জলে দূষণ নয়, বরঞ্চ এখানে সমস্যা তার থেকেও অনেক বড়, যার সবটাই মনুষ্য সৃষ্ট না হলেও সবটা আর মানুষের নিয়ন্ত্রণে নেই। বেশ কয়েক দশক ধরে পাহাড়-তরাই-ডুয়ার্সে জনসংখ্যা বেড়েছে লাফিয়ে লাফিয়ে। রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতায় ও প্রশ্রয়ে এই জনস্ফীতি ঘটলেও এই বৃদ্ধিকে শৃঙ্খলায় আবদ্ধ করবার প্রচেষ্টা যেমন হয় নি তেমনই দশকের পর দশক ধরে অবহেলিত এই মৃগয়াভূমিতে মানব সম্পদ উন্নয়নের ন্যুনতম প্রচেষ্টা চোখে পড়ে নি। যার ফলশ্রুতি এই নিয়ন্ত্রণহীন বেড়ে চলা মানুষ উন্মত্তের মত ধ্বংস করেছে অরণ্য। গত কয়েক দশকে এই শীতল স্যাঁতসেঁতে ভূমির আবহাওয়ায় উষ্ণতা বেড়েছে কতটা তার সঠিক মাপ বিজ্ঞানীদের কাছে থাকুব বা না থাকুক, স্থানীয় মানুষের চামড়ায় তা অনুভূত হয় ঠিক।
একটা সময় চা বাগান পত্তনের জন্য হলেও ডুয়ার্সে অরণ্য ধ্বংসের আর একটি বড় দায় কিন্তু পাহাড় থেকে নেমে আসা নদীগুলির উপর বর্তায়। পাহাড়ি ঢাল বেয়ে নেমে আসা নদীগুলি হঠাৎ এসে সমতলে পড়ায় নদীর সঙ্গে বয়ে আনা পাথর-নুড়ি-বালি এসে ছড়িয়ে পড়ে, রিভার বেড উঁচু হতেই থাকে, একেক জায়গায় জমে গিয়ে নদীগুলির গতিপথ বদলে দিতে থাকে। প্রবল বৃষ্টিতে পাহাড় থেকে নেমে আসা জলস্রোত প্লাবন ঘটালেই প্রকট হয়ে ওঠে নদীর পরিবর্তিত গতিপথ, তখন বিস্তীর্ণ জঙ্গলভূমি তথা অরণ্যসম্পদ চলে যায় নদীর গর্ভে, প্রতি বছর। নদীর গতিপথ পরিবর্তন প্রাকৃতিকভাবে নতুন কিছু না হলেও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেড়ে চলা মানুষের চাপে ভূমি ব্যবহারের ধরণ বদলে গিয়েছে। অকাতরে গাছ কেটে কংক্রিটের উন্নয়ন ও চাষ জমির বিস্তার, পথঘাট নির্মাণে ও বক্সাইট খননে পাহাড়ে ক্রমাগত ব্লাস্টিং ইত্যাদির জন্য যে বিপুল অস্বাভাবিক ভূমিক্ষয় হয়েই চলেছে তা বদলে দিয়েছে অরণ্য ও নদীর চরিত্র গতি ও পথ। বলাই বাহুল্য তার সরাসরি প্রভাব পড়ছে উত্তরের প্রাকৃতিক ভারসাম্যে।
আর এই ভারসাম্যহীনতার ছবিটা আরও করুণ হয়ে ধরা দেয় দার্জিলিং পাহাড়ে। ক্রমাগত জনসংখ্যা বৃদ্ধি এখানে পাহাড়ের ঢাল থেকে কেটে সাফ করে দিয়েছে জঙ্গল, সেইসঙ্গে পরিকল্পনাহীন ড্রেনেজ ব্যবস্থা, অপরিকল্পিত উপায়ে চাষাবাদ ও বাড়িঘর নির্মান দার্জিলিং পাহাড়ের ভূমিক্ষয়কে এক অস্বাভাবিক পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছে। এমনিতেই প্রাকৃতিকভাবে প্রতিকূল গঠনের উপত্যকাহীন এই পাহাড় অঞ্চলে সামান্য পরিকল্পনার অভাবেই যে কোনও নির্মাণমূলক কাজের পরিণাম ভয়াবহ হতে পারে, তার উপর দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে চলতে থাকা অভিভাবকহীন ও সরকারি নীতিবিহীন শাসনে এই লাগামছাড়া সভ্যতার বিস্তার যে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে বাংলার পাহাড়কে, তা আজ রীতিমত উদবিগ্ন করে তুলেছে এখানকার আদি ও সাবেকি বাসিন্দাদেরও। বহু পাহাড়ি মানুষ যেমন তার নতুন প্রজন্মকে পাহাড়ে ফিরতে উৎসাহিত করছে না, তেমনই বহু মানুষ নেমে আসছে সমতলে। দার্জিলিং-কালিম্পং-এর শিক্ষিত বন্ধুবান্ধবরা প্রায়শই বলেন, পাহাড়ের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে পাহাড়ি ইকোলজির ভারসাম্য রক্ষা যে কতটা ওতপ্রোতভাবে জড়িত, আর তার পরোয়া না করে কতটা ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে, তা সম্যক অনুধাবন করতে পেরেছেন পাহাড়ের সাধারণ মানুষ। অথচ কোনও শাসক গত কয়েক দশকে তা বুঝতে পারেননি বা বুঝবার চেষ্টা করেছেন বলে মনে হয়নি।
আজ তাই পাহাড়ের মানুষদেরকেই বলতে শুনি, ব্রিটিশ আমলে শতাধিক চা বাগান গড়ে ওঠার জন্য অরণ্য ধ্বংস হয়েছে, ঠিক কথা, কিন্তু এটাও সত্যি যে দার্জিলিং পাহাড়ের সত্তর হাজার পরিবারের সরাসরি সংস্থান ও আরো হাজার হাজার পরিবারের পরোক্ষ সংস্থান হয়েছে, রাজ্যের প্রাকৃতিক সম্পদের ভান্ডারে ধনবৃদ্ধি ঘটেছে এই চা বাগান থেকেই। অনিয়ন্ত্রিত ভূমিক্ষয় রোধের প্রশ্নেও কখনই আজকের মত আশঙ্কাজনক ভারসাম্যহীনতায় পৌঁছয় নি পাহাড়। পূর্বের পাওয়ার হাউস হওয়ার স্বপ্নে তিস্তার মত নদীর নির্মম পাহাড়ী লাঞ্ছনার কথা আজ আর নাই বা তুললাম, কিন্তু ভূমিক্ষয় নদীর গতিধারাতে যে বিপদজনক পরিবর্তন নিয়ে এসেছে আর তা নিয়ে ভাবনা ও পদক্ষেপের সময় পার হয়ে যাচ্ছে-- এই কঠিন বাস্তবটি আজ স্বীকার করবেন কোন সরকার? পাহাড়-তরাই-ডুয়ার্সের চা বাগানে ও কৃষিতে দীর্ঘকাল ধরে যথেচ্ছ রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার যে নদীগুলির জলের গুণমান এবং বায়োডাইভার্সিটির দফারফা করে দিয়েছে তা নিয়ে আইনকক্ষে গলাবাজি করবেন কোন এমপি বা এমএলএ? তাঁরা তো সব ব্যস্ত বিভোর মন্ত্রী-উপমুখ্যমন্ত্রী-মুখ্যমন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার বাসনায়।
বিশ্ব পরিবেশ দিবস উপলক্ষে আজকের এই নিবন্ধে নতুন কিছু লিখিনি, এই রকম নিবন্ধ এর আগেও নানা ভাষায় নানা জার্নালে ম্যাগাজিনে বহুবার লেখা হয়েছে, আগামীতেও বারবার একইরকম লেখার পুনরাবৃত্তি ঘটবে। অনেকেই তাই প্রশ্ন করেন, এইসব লিখে কি আদৌ কিছু হয়? সত্যিই হয়ত কিছু হয় না। উত্তরবঙ্গের নদী-বন-বন্যপ্রাণ তথা ইকোলজি নিয়ে লেখা অজস্র গবেষণা পত্র পড়ে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের আলমারিতে, তোরসা-মানসাই-কালজানি কিংবা শাহু-মহানন্দার বিবিধ সংকট নিয়ে লেখা বহু স্টাডি রিপোর্ট ধুলো খাচ্ছে আমলাদের কাবার্ডে। বাংলার নানা প্রান্তে নদীর চরিত্র যেমন আলাদা আলাদা তেমনই ভিন্ন ভিন্ন তার সমস্যার রূপ। সুন্দরবনের নদী বা রাঢ় বাংলার নদীর সঙ্গে সীমান্ত বাংলার নদীর বা উত্তরের পাহাড়ী নদীর নাব্যতা-পেয়তা জাতীয় কিছু ম্যানমেড কমন ইস্যু থাকলেও প্রাকৃতিক সংকটগুলি একেবারেই পৃথক। ‘নমামি গঙ্গে’ আর ‘নমামি তিস্তা’— একটি বাস্তব ও একটি কাল্পনিক— দুটি প্রকল্প কখনোই তো এক হতে পারে না। নদীর জন্য কাজ করা তো অনেক পরের ব্যাপার, আপনিই বলুন তো, নদী নিরিখে ডিটেইলস বুঝবার মত সঠিক যোগ্যতা বা অধিকার রয়েছে ঠিক কোন মন্ত্রকের— জলশক্তি? নাকি সেচ? বন? নাকি পরিবেশ? সবাই জানি নদীই পরিবেশ রক্ষায় নাটের গুরু, কিন্তু নদীগুলি রক্ষার জন্য কি কোনও অভিভাবক আদৌ আমাদের কাছে আছে?
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team