"একদিন একটা গাছের ডালে উঠিয়া বসিলাম। সে-আনন্দের তুলনা হয় না। আমার মাথার উপরে বিশাল বনস্পতিদলের ঘন সবুজ পাতার রাশি, তার ফাঁকে ফাঁকে নীল আকাশের টুকরো, প্রকাণ্ড একটা লতায় থোকা থোকা ফুল দুলিতেছে। পায়ের দিকে অনেক নিচে ভিজা মাটিতে বড় বড় ব্যাঙের ছাতা গজাইয়াছে। এখানে আসিয়া বসিয়া শুধু ভাবিতে ইচ্ছা হয়। কত ধরনের কত নব অনুভূতি মনে আসিয়া জোটে। একপ্রকার অতল-সমাহিত অতিমানস চেতনা ধীরে ধীরে গভীর অন্তঃস্তল হইতে বাহিরের মনে ফুটিয়া উঠিতে থাকে। এ আসে গভীর আনন্দের মূর্তি ধরিয়া। প্রত্যেক বৃক্ষলতার হৃৎস্পন্দন যেন নিজের বুকের রক্তের স্পন্দনের মধ্যে অনুভব করা যায়।"
মনে পড়ে বিভূতিভূষণের "আরণ্যক"? পাহাড়ের কোলে লবটুলিয়া, পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসা চেরা সিঁথির মতো পথ, বয়ে চলা পাহাড়ি ছোট নদী, সেখানে কোন এক যুগলপ্রসাদ নদীর ধারে চারাগাছ লাগায়। স্বপ্ন দেখে যুগলপ্রসাদ সেখানে একদিন ফুল ফুটবে। অরণ্য ধ্বংস করে সভ্যতার অগ্রগতির বিরুদ্ধে অরণ্যের অধিকার নিয়ে নীরবে প্রশ্ন তোলে যুগলপ্রসাদ, সেই সাথে নিরুচ্চার প্রতিবাদ।
১৯৩৯ সালে প্রকাশিত হয়েছিল "আরণ্যক"। তারপর কালের প্রবাহে পিছনে সরে গেছে দীর্ঘ আট দশকেরও বেশি সময়। কিন্তু আমরা কি বিভূতিভূষণের ভাষায় - প্রত্যেক বৃক্ষলতার হৃৎস্পন্দনকে নিজের বুকের রক্তের স্পন্দনের মধ্যে অনুভব করতে পেরেছি আজও? আজ পরিবেশ দিবসে এই প্রশ্নটাই বড় অস্বস্তির।
আজ তাই প্রশ্ন উঠে আসবে স্বাধীনতার ৭৪ বছর পরেও পরিবেশ বিদ্যাকে আমরা কতটা গুরুত্ব দিয়ে পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত করেছি, ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে শুধু পাশের পড়া বাদ দিয়ে পরিবেশ নিয়ে কাজের পড়ার প্রতি আগ্রহ কতটা জাগিয়ে তুলতে পেরেছি, কতটা পরিবেশবান্ধব করে তুলতে পেরেছি আগামী প্রজন্মের প্রযুক্তিনির্ভর জীবন ও যাপনকে? পোষ্ট কোভিড যুগের 'আজ আছি কাল নেই'-এর ঘোর তমসাচ্ছন্ন পৃথিবীতে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজাই কোভিড পরবর্তী প্রকৃতি আমাদের কাছে জানতে চায়। নিজে বিদ্যালয় শিক্ষার কাজে যুক্ত থেকে এটুকু জানি বিদ্যালয় শিক্ষায় পরিবেশবিদ্যার গুরুত্ব ছোট ক্লাসে সংস্কৃত শিক্ষার মতো। কোনওক্রমে ক্লাস এইট টা উৎরে দিতে পারলেই ওঁম শান্তি, ওঁম শান্তি।
উচ্চমাধ্যমিক স্তরে পরিবেশবিদ্যা আবশ্যিক ছিল ২০০৭ থেকে ২০১২ পর্যন্ত। ২০১৩ সাল থেকে এই বোঝা ছাত্রছাত্রীদের কাঁধ থেকে নামিয়ে দিয়ে আমরা হয়তো ছাত্রবান্ধব হলাম ঠিকই, কিন্তু পরিবেশ নিয়ে কতটা দায়িত্বসচেতন করলাম নব্যপ্রজন্মকে? বিদ্যালয় শিক্ষায় পরিবেশবিদ্যা বই-এর পৃষ্ঠার বাইরে বৃহত্তর প্রকৃতির ক্যানভাসে ডানা মেলতে পারল কই?
নদীমাতৃক বাংলাদেশে নদীর পাড়ের বাসিন্দাদের কাছে এক আতঙ্কের নাম ভাঙন। কেউ হারাচ্ছেন পরিবার, কেউ জীবিকা। একের পর এক নদীর চর দখল হয়ে মনুষ্যবসতি গড়ে উঠছে। অবরুদ্ধ নদীর স্রোতে ভাসে পুতিগন্ধময় মনুষ্য বর্জ্য। দূষণ এবং দখলে অনেক নদীই নাব্যতা হারিয়ে এখন নালা মাত্র। অবৈধ বালি খননে নদীর বুকের তীব্র যন্ত্রণার শব্দ আমাদের বধির কানে পৌঁছয় না। নদীর সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তুলতে না পারলে নদীর কথা শুনবো কী করে আমরা? নদীর কথা ভাবতে হবে, নদীকে নিয়ে বাঁচতে হবে যেমন ভেবেছিলেন সিন্ধু, মিশরীয়, মেসোপটেমিয় সভ্যতার লোকেরা।
নদীর সঙ্গে মানুষের ছন্দোময় সুখী যাপনের কথা শুধু সিলেবাসের পাতায় সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না, আপন বেগে পাগলপারা নদীকে জড়িয়েই বেঁচে থাকতে হবে, বেড়ে উঠতে হবে। নদীর গতি রুদ্ধ করে নিজস্ব পরাক্রম জাহির করব, আবার ঘটা করে পরিবেশ দিবস পালন করব-- দুটো একসাথে হতে পারে না। ছাত্রছাত্রীদের নিয়ম করে নদীর কাছে নিয়ে যেতে হবে। তারা সেখানে সময় কাটাক। নদীর বুকে কান পেতে শুনুক স্রোতস্বিনীর বয়ে যাওয়ার কুলুকুলু ধ্বনি। গল্প শুনুক নদীর কাছে - নদীমাতৃক সভ্যতার গল্প, সিন্ধুসভ্যতার গল্প, গল্প শুনুক অফুরান ফসলের পসরা নিয়ে নাও কিভাবে পাড়ি দিত এক নদী থেকে আরেক নদীতে, প্লাবনের পর নদীর রেখে যাওয়া পলির বুকে কীভাবে কৃষক স্বপ্নের বীজ বুনত। আর সেই সাথে তারা এটাও ভাবুক কেন দু-কূল ছাপানো নদী আজ ক্ষীণতোয়া। বিশ্ব পরিবেশ দিবসে নদীকে তার জল ফিরিয়ে দেওয়াই হোক আজকের সভ্যতার চ্যালেঞ্জ।
প্রকৃতির সাথে সংঘাত নয়, প্রকৃতির সাথে সহাবস্থানই পৃথিবীতে মানুষের বেঁচে থাকার একমাত্র শর্ত। প্রকৃতির সুবিশাল ক্যানভাসে মানুষ জায়গা পেয়েছিল নিজগুণেই। প্রাকৃতিক উপাদানে সমৃদ্ধ এই গ্রহকে নিজের মতো করে সাজিয়ে নিয়েছিল মানুষই। যে মানুষ দু হাত ভরে নিয়েছে প্রকৃতির কাছ থেকে, সেই মানুষই প্রকৃতির বুকের উপর বসে প্রকৃতির শ্বাসরোধে তৎপর।
আজ একটু অক্সিজেনের জন্য হাহাকার সারা দেশ জুড়ে। একটা অনুজীবের ভয়ে থরথর কাঁপছে সারা বিশ্ব। যার শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, কোভিড নেগেটিভ হওয়ার পরেও এই ভাইরাস আবার তাকেই আক্রমণ করছে। একা রামে রক্ষা নেই, ব্ল্যাক ফাঙ্গাস দোসর। প্রকৃতিদত্ত রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তাহলে এত ভঙ্গুর হয়ে গেল কেন? প্রশ্ন করেছি কখনো?
আমরা যদি জেনেশুনে বিষ পান করি, প্রকৃতির কি কিছু করার আছে? ক্ষতি হবে জেনেও আমরা মাছে ফর্মালিন, শাকসব্জিতে ক্ষতিকারক রাসায়নিক মেশাচ্ছি। অধিক উৎপাদনের জন্য জমিতে কীটনাশক, রাসায়নিক সার প্রয়োগ করছি। শিল্পায়ন, নগরায়নের নামে নির্বিচারে গাছ কাটছি, আবার একটু অক্সিজেনের জন্য বাইপ্যাপ নাকে নিয়ে কৃত্রিম উপায়ে অক্সিজেন স্যাচুরেশন লেভেল বাড়াচ্ছি। যে বনজ সম্পদ, প্রকৃতির দানকে গ্রহণ করে সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকে মানুষ নিজের অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম চালিয়ে আসছে, আজ কালিদাসের মতো আমরা সেই পরম আশ্রয়ের মূলেই কুঠারাঘাত করছি। এরপরেও প্রকৃতি আমাদের ক্ষমা করবে?
আজ বিশ্ব পরিবেশ দিবসে আমরা না হয় একটু ভাবি, ভাবা প্র্যাকটিস করি। ভাবি, কী করে প্রকৃতির সাথে সহাবস্থান করে বিকাশের চাকাকে সচল রাখা যায়, কী করে আমাদের বিপুল বনজ সম্পদকে কাজে লাগিয়ে আমরা প্রকৃতি সংলগ্ন জীবন ও যাপনে আরও বেশী প্রকৃতি নিবিড় হতে পারবো, প্রযুক্তি নির্ভর হয়েও কী করে প্রযুক্তি নির্গত বিষবাস্প থেকে আমাদের ছেলেমেয়েদের রক্ষা করতে পারবো, কী করেই বা নদী আর মানুষের চিরন্তন ভালোবাসার স্রোতকে বইয়ে দিতে পারবো রুখাশুখা টুটিফাটা মাটির অভ্যন্তর!
দেখাই যাক না কেন, যদি ফিরিয়ে নিয়ে আসা যায় সেই লবটুলিয়ার বনস্পতিদলের ঘন সবুজ পাতার রাশি, তার ফাঁকে ফাঁকে নীল আকাশের টুকরো! যদি অনুভব করা যায় নিজের বুকের রক্তের স্পন্দনের মধ্যে প্রত্যেক বৃক্ষলতার হৃৎস্পন্দন!
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team