“দিনে একবার খেলেও চলবে স্যর, কিন্তু ঘুরতে না পেলেও মাইরি বলছি অক্কা পাবো।“
আমাদের অবস্থাটা এখন দাঁড়িয়েছে অমনি। অস্ট্রেলিয়া আর নিউজিল্যান্ড দুটিই অ্যাইল্যান্ড কান্ট্রি। দুই দেশেরই চারদিকে থইথই করছে লবণাক্ত সমুদ্রের জল। দুই দেশেরই সীমানার যে কোনো অংশে দাঁড়ালে চোখ যাবে যতদূর, দেখবেন শুধু সমুদ্দুর আর সমুদ্দুর। এবং কেনা জানে যে সমুদ্র ব্যাপারখানা শুধু থিয়োরিতেই রোম্যান্টিক। আদতে তেমন ইয়ে কিছু নয়। তাছাড়াও এখানকার জীবনের একটা অতি আবশ্যিক অংশ হল ভ্রমণ। প্রথম বিশ্বে ট্র্যাভেল ব্যাপারটা বিলাসিতা নয়, বরং প্রায় প্রয়োজনের পর্যায়ে পড়ে, এবং এই ব্যাপারটা নিজে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা না করলে বোঝানো মুশকিল।
ভারতবর্ষ, পাকিস্থান, বাংলাদেশ, চীনের মতো এশিয়ান দেশগুলিতে ভ্রমণ ব্যাপারটা অপশনাল। এর কারণ এই যে রোটি-কাপড়া-মকানের মতো বেসিক প্রয়োজনগুলিই যেখানে মেটে না, সেখানে ভ্রমণের কথা ভাবাই হাস্যকর। অন্যদিকে প্রথম বিশ্বের দেশগুলির শক্তপোক্ত অর্থনীতির কারণে ওই তিনখানি শর্তপূরণের অভাব সচরাচর হয় না।
নিতান্ত অলস না হলে এদেশে কেউ বিনা চাকরিতে থাকে না। বরং উল্টোটা হয়। অর্থাৎ একই মানুষের দু-তিনখানা চাকরি এমন আকছার হয়। সতেরো বছর বয়স থেকে রোজগার শুরু করে ছেলেমেয়েরা। নিতান্তই হোমলেস অথবা ভিক্ষুক শ্রেণীর যারা তাদের জন্যও সরকার মাসিক ভাতার ব্যবস্থা করে রেখেছেন। কাজেই বুঝতেই পারছেন যে খাওয়া-পরার অভাব অন্তত এখানে কারোর নেই। অভাব তবে কোথায়? এদেশে অভাব রয়েছে সম্পর্কে। মা-বাবার সঙ্গে দেখা করতে হলেও অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিতে হয়। উৎসবে অনুষ্ঠানে মাথা গুণে গুণে নেমন্তন্ন করা হয়। অতিথির সংখ্যা দশের বদলে এগারো হয়ে গেলেই গৃহকর্তা বিব্রত বোধ করেন। অনেক জায়গায় এমনও দেখেছি যে বিয়ে শাদির অনুষ্ঠানে পরিস্কার বলে দেওয়া হয়, বাচ্চাদের সঙ্গে আনবেন না। রাস্তায় অপরিচিত মানুষকে আঙ্কল-আন্টি বলে ডাকলে তারা ভুরু কুঁচকে তাকায়।
আমাদের দেশগুলির মতো আত্মীয়স্বজন, ভাই-বোন, মা-বাবা সব্বাইকে নিয়ে একসঙ্গে বেঁচে থাকার কনসেপ্টটার অস্তিত্বই নেই এদেশে। তাই প্রাচুর্য্য থাকলেও, পরোয়া করার লোকের অভাব বড় বেশী। নিজের জীবন নিজ দায়িত্বে রাখুন, এই নীতিই মেনে চলি আমরা সবাই। তাই নিজের প্রাইভেসির বাবলটাই যে কখন শূন্যতার দৈত্যের মতো ঘাড়ে চেপে বসে তা বোঝা মুশকিল। ভ্রমণ এই নিত্যকার গ্লানিটুকুই কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করে, এবং তাই ভ্রমণের অভাবে এখানে মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়াটাও অস্বাভাবিক কিছুই নয়।
তাই মাস দেড়েক আগে যখন অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডের মধ্যে যাতায়াত শুরু হল তখন বেশ খুশিই হয়েছিলুম। অজি এবং নিউজি, আমরা হলুম গে এখন পালটি ঘর। পালটি ঘর বোঝেন তো? গাঁয়েগঞ্জে এই কনসেপ্টখানা আজও রয়েছে। পালটি ঘর, অর্থাৎ সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ভাবে মোটামুটি একই অবস্থার। সেই সূত্রে এবাড়ির সঙ্গে ওবাড়ির নির্দ্বিধায় একসঙ্গে ওঠাবসা, খাওয়াপরা চলে। গাঁয়ের বাকি পরিবারগুলির সঙ্গে সম্পর্ক যেমন তেমন হলেও ক্ষতি নেই, কিন্তু পালটি ঘরের সঙ্গে মাখামাখিটা হয় চোখে পড়ার মতো। কোভিডের কল্যাণে পৃথিবীর এই দক্ষিণ গোলার্ধে অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ড-এর মধ্যেও ঠিক তেমনি একখানা সম্পর্ক তৈরি হয়েছে।
অতএব অমনি সময়ে দুজন দুজনকে কিউয়ি আর ক্যাঙ্গারু বলে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করলেও এখন বিপদে পড়ে দুটিতে বেশ মিতালি পাতিয়েছেন তা বোঝাই যাচ্ছে। এখন তাই দুজনের মধ্যেই শুধু যাওয়া আসা চলছে। আমরা হলুম ওই যাকে বলে কোভিড কুলের কুলীন, এবং বাকী দেশগুলি আমাদের চোখে অচ্ছ্যুৎ। এ ব্যাপারে প্রতিবেশী রাজ্য নিউ সাউথ ওয়েলস্ বা সাউথ অস্ট্রেলিয়ার থেকেও আমাদের স্টেট ভিক্টোরিয়ার নিয়মকানুন আরোও অনেক বেশি কড়া। কথায় কথায় সরকার বাহাদুর এখানে লকডাউন ডেকে ফেলেন। আমরা সেই ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকি।
তবে সরকারের দোষ দেব না। পুরো পৃথিবী জুড়ে যে কোভিডের ক্রাইসিস চলছে, তার হাত থেকে যে অন্তত ফিজিক্যালি আমরা বেঁচে আছি, তার কারণও তো ওই একই, লকডাউন। মানসিক এবং অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি সবাই সেকথা ঠিক, কিন্তু তখনি আবার ভাবছি যে থ্যাঙ্ক গড, অ্যাটলিস্ট আমরা প্রাণে তো বেঁচে রয়েছি। ইন্ডিয়ার কথা ভাবলেই ভয়ে বুক শুকিয়ে আসছে। মা-বাবা-দিদিভাই ছাড়াও কাকু-কাকিমা, মাসি-পিসি, দাদু, দিদা সব্বাই তো রয়েছে ওখানে। আমাদের একার অস্তিত্ব ঠিক কতখানি যদি ভালোবাসার মানুষগুলি বিপদে থাকে! অতএব আতঙ্কে সিঁটিয়ে থাকি সবসময়। কবে যে কী হয়ে যাবে কে জানে? লকডাউনে আটকে থাকতে থাকতে বুকের ভেতরটাও কেমন যেন শূন্য হয়ে গেছে। হাসি, কান্না, অভিমান কোনোটাই তেমন করে ছোবল মারে না এখন। ভালো বই পড়লে বা ভালো সিনেমা দেখলে আনন্দ হয় না এখন। ভালো কিছু খেলেও দেখেছি তেমন স্বাদ পাই না।
ভারতীয় এবং বাংলাদেশী বন্ধুদের সবার চোখে মুখে দুশ্চিন্তার ছায়া। দেশে সবারই বুড়ো মা-বাবা রয়েছে। চেষ্টা করলেও ভেতর থেকে অপরাধবোধটাকে তাড়াতে পারি না আমরা। পরিবারের লোকজন ওদেশে বিপদে পড়ে আছে, আর আমরা এখানে বসে অসহায়ের মতো দেখছি। বর্ডার বন্ধ। হাজার এমার্জেন্সি হলেও যাওয়ার উপায় নেই। কোনোভাবে যাওয়ার ব্যবস্থা যদি হয়ও তাহলে ফেরার রাস্তা বন্ধ। একেক সময় দম বন্ধ হয়ে আসে। একে অপরের সঙ্গে রাস্তাঘাটে দেখা হলেই ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞাসা করি, “বাড়িতে সবাই...?”
সৌভাগ্যবান যারা, তারা তৎক্ষণাৎ উত্তর দেয় “সো ফার সো গুড।” কেউ কেউ শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে রাস্তার দিকে। আমরা যা বোঝার বুঝে নিই। চুপ করে যাই। প্রাচ্যে শোকের প্রকাশ বড় তীব্র। পাশ্চাত্যে নিয়ম অন্যরকম। চীৎকার করে কাঁদা, বুক চাপড়ানোর কথা আমরা চিন্তাও করতে পারি না। ভারি পাথরের মতো নৈঃশব্দের নীচে চাপা পড়ে থাকে বুকফাটা কান্না। বন্ধুদের হাত ধরে ভা্রি গলায় বলি তখন, “স্যরি ফর ইয়োর লস্!”
কিন্তু সত্যিই কি কখনো কেউ কারো লস্ বুঝে উঠতে পারে? ও শুধু মুখেই বলা যায়। সেটুকুই সান্ত্বনা। একেকটা সম্পর্ক মানে তো একেকখানা দ্বীপ। দ্বীপের মাটি ভাগ করে বেঁচে থাকে মানুষ। একজন হারিয়ে গেলে সেই দ্বীপটাও বিস্মৃতির সমুদ্রে তলিয়ে যায় একসময়। সম্পর্কগুলো বেঁচে থাকে শুধুই তখন ছবির ফ্রেমে। এখন বুঝি যে অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে থেকে প্রিয়জনদের যেতে দেখার চাইতে বড় যন্ত্রণা আর কিছুই নেই। এখন মনে হয় দুঃখ-কষ্টে যেমনই হোক না কেন, বেঁচে থাকাটাই যথেষ্ট। আগামী সকালের সূর্য্যোদয় দেখতে পাব একসঙ্গে, এই আনন্দও কম নয়। এখন বুঝি নশ্বর মানুষের মুখে প্রাণের চাইতেও প্রিয় এর থেকে বড়ো মিথ্যে কথা আর কিচ্ছু হয় না।
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team