না, আমাদের নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে ঘুরতে যাবার কোনো ধারণাই ছিল না। যখনই শুনতাম কোন জায়গায় কেউ ঘুরতে গেছে শুধু মনে মনে সেই জায়গাটার একটা ছবি আঁকার চেষ্টা করতাম। মনে চাপা একটা কষ্ট, আর তাতেই সাইকেলের প্যাডেলে চাপ। চাকা ঘুরতে ঘুরতে ডুয়ার্সের পিচের রাস্তায়। বিস্তীর্ণ ধানক্ষেত অথবা পাটক্ষেত, মাথার ওপর উদার নীলাকাশ, দূরে নীলচে সবুজ পাহাড়ের রেখা, পুরুষ-রমণীরা মাঠে কাজে লেগে আছে। আমার চিৎকারে বেসুরো গান “কোথাও আমার হারিয়ে যাবার নেই মানা…মনে মনে”। মন ভালো হয়ে যেত, বাড়ি ফিরে আসতাম। সিঁড়িতে বসে সন্ধেতে মাথার ওপর মেঘমুক্ত তারাভরা আকাশ, মা-র তুলসীমঞ্চে সন্ধ্যা দেওয়া, দূরে দূরে ঝোপেঝাড়ে অজস্র জোনাকি তারা জ্বলছে নিভছে। সন্ধের পর লন্ঠনের আলোয় পড়তে বসেছি। বহুদূর থেকে গান ভেসে আসছে, হয়তো তিস্তাবুড়ি হয়তো হুদুমদেও, যা দেখতে গিয়ে রাতের অন্ধকারে জীবন বিপন্ন প্রায়। কান পাতলে শোনা যাচ্ছে জলঢাকা বা তিস্তার জলের আওয়াজ। একটু রাত হলেই ঘরের পাশে শেয়ালের তীব্র চিৎকারে ভয়ে বিছানা থেকে নামতে পারছি না। তখন বুঝতে পারিনি আসলে আমরা সকলেই সবসময়ই একটা ঘোরার একটা ঘোরের মধ্যেই আছি বা থাকি। একটা খেদহীন ছোটবেলা-শৈশব, কৈশোর।
পরেরটা আসছে। সকাল হলেই বেরিয়ে পড়ছি হাঁটতে। বাঁ দিকে সূর্য উঠছে মাঠ ধানক্ষেত পেরিয়ে আর ডানদিকে কাঞ্চন। যেন রাজকীয় ঐশ্বর্যে সর্বদা মন্ডিত। যার সামনে দাঁড়ালে সবসময় মাথা নিচু করে দাঁড়াতে হবে। কত ক্ষুদ্র দীন তুচ্ছ আমরা। আর দূরে ঝমঝম করে ট্রেন চলে যায় বাড়িঘর কাঁপিয়ে রেলব্রীজ পেরিয়ে। তার এমন আওয়াজ যেন ঘরের পাশে।
ঘুরে বেড়ানো আসলে সংখ্যায় থাকে না। থাকে না কটা জায়গায় ঘুরতে গেছি তার তথ্যে আর বুড়ি ছুঁয়ে ছুঁয়ে বেড়ানোতে। ঘুরে বেড়ানো মনের ভেতর। আমারই তো জায়গা, আমিই তো ঘুরব। শুধু অনুভূতিতে মেখে নিতে হবে তার পরশ। বুকের ভেতর সে সবসময় ডাকে মেঘ ডাকার মতো করে। শ্রান্ত ক্লান্ত কর্মস্থল থেকে ফেরার পথে বাস দেখি চলে যায় বিভিন্ন প্রান্তে। কত কত দূরে-তার কত কত জায়গা-কত কত নাম। মনে হয় চলে যাই তাতে চেপে। চলেও গেছি কত দিন কোথায় কোথায়। হ্যাঁ, যেতে পারি নি হিল্লী দিল্লী। ঘরের পাশে তো গেছি। আর হিল্লী দিল্লীর গল্প শুনেছি সবার কাছে। গল্প শুনেই অর্ধেক ঘোরা। চোখের সামনে বায়োস্কোপের ছবি সরে সরে যায়। ছোটবেলার হাটে, মাথা ঢুকিয়ে দেখা। ঐ যে কুতুবমিনার ঐ যে চারমিনার ঐ যে ভিক্টোরিয়া। আমার ওতেই হবে। আমি তো অনেকক্ষণ রাস্তার ধারে গাছের নিচে মা এর সাথে বসে থেকে উঠে পড়েছি বাসে। সংকীর্ণ রাস্তার দুপাশের গভীর অরণ্যের মধ্য দিয়ে বাস চলে বিস্তীর্ণ চা-ভূমির দিকে। আমি ইঞ্জিনে আর সামনে লাল লাইট। ড্রাইভার ব্রেকে পা দিলেই জ্বলে। চা ভূমিতে পৌঁছতে পৌঁছতে সন্ধে। তাড়াতাড়ি পা চালাতে হবে। না হলেই ভয় আছে। বাবারা সব নামবে পাহাড় থেকে তখন। আরো কত কী যে সেখানে।
সেখানে চা বাগানের একদিকের সিঁড়ি দিয়ে উঠে আর একদিকে নেমে যাওয়া। সরু পথ, দুধারে আদিগন্ত বিস্তৃত ঘন সবুজ ঢেউ খেলানো চাদরের গালিচা। মাঝে পড়ে জল যাবার নালা, চিতাবাঘের প্রসবস্থান। দেখে দৌড়তে দৌড়তে পালানো বন্ধুদের সাথে। মিটারগেজ রেল লাইনে ট্রেন যায় সারাদিনে অল্প কটি। তার ওপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কথায় কথায় মশগুল। যৌবনের গল্প যেন প্রকৃতির সান্নিধ্যে উতলানো দুধের মতো ফুলে ফুলে ওঠে। গুলে গুলে গুলজার। হঠাৎ পেছনে ভোঁ, কয়েক মিটার পেছনেই ট্রেন, এসে যেন দাঁড়িয়ে আছে। রেলিঙহীন রেলব্রীজ থেকে অনেক নিচে শুকনো নদীতে সরু নীল জলের রেখা। তাতে কখন যে নেমে আসবে হড়পা বান, ভূমিপুত্রেরা তার আওয়াজ পায়। মেঘমুক্ত দিনে স্পষ্ট দূরের পাহাড় শৃঙ্গেরা সব, যেন হাতছানি দিয়ে ডাকে- আয়, আয়। আর উৎসব হয়- দুর্গাপূজা, পাব্লিসিটি, সবই উৎসব। উৎসবের সময় তারা সব আসে। হাতে লাঠি, কাঁধে টাঙ্গি। রক্তবর্ণ চোখ, ঠিক যেন “কানে তাদের গোঁজা জবার ফুল”। তারা সব একসাথে বলে-“একো রুপিয়া, ঢেউসিরে। দেনে পড়েগা, ঢেউসিরে।”
দুদিকে চা বাগানের মধ্যেই বসে সাপ্তাহিক হাট। কী না মেলে সেখানে। চুড়ি-ফিতা-আয়না-সিঁদূর—তেল-ব্যবহৃত শাড়ি-জামা-প্যান্ট-ভাতের হোটেলে কড়কড়ে ভাজা মাছে গরগরে লাল ঝোল, দূরেই কাটা শূয়োর, সাথে ঘুগনী-গোপ্পো। বাড়ির নিষেধের তোয়াক্কা না করেই হারিয়ে যাওয়া সেই হাটে। এককোণে মহিলারা বসে আছে হাঁড়িয়ার হাড়ি আর বাটি নিয়ে, ঝকঝকে সব। চাইলে দেয় না-বাবুঘর। বড় হিংসা। অনেকেই এদিক ওদিক চরম বেসামাল। আমরা কজন শুধু পাথরের ওপর বসে লোলুপ। আমাদের কি কোনোদিন ওরকম হওয়া হবে না? হবে না মাটির সাথে মিশে যাওয়া? বাড়ির পাশের হাট কিন্তু অন্যরকম। সেখানে বিস্তীর্ণ চত্বর জুড়ে সন্ধেতে কুপি জ্বলে ওঠে সারি সারি। এ যেন সাপ্তাহিক দেওয়ালি। সপ্তাহে দুদিন। সেই অল্প অল্প আলোয় সে চত্বর যেন হয়ে ওঠে এক মায়াময় স্বপ্নপুরী। তাতে কত কত কালো শরীর হেঁটে চলে বেড়ায়। সেই অল্প আলোতেই তারা সব জেনে বুঝে কিনে নেয়, সওদা করে। সেখানে ভিড় জমে দুপুর থেকেই। চারিদিক জুড়ে ছড়ানো গরু হাটি-মুরগী হাটি-পাইকার-মাল কেনাবেচা-হাঁকডাক- দালালের দরদামে ভরে ওঠা চত্বর। কেনাবেচা সারা হলে এক কোণের দিকে চলে যায় সকলে। সেদিকে বাংলার গন্ধে ম ম চত্বর। গ্লাস চাকনা মেলে পাঁচ টাকা- দশ টাকা। টলতে টলতে তখন সাইকেল গান ধরে অন্ধকার রাস্তায় - “মৈষাল বন্ধু রে…”
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team