যূথিকা আচার্য্য
দুঃখের কথা কী আর বলব মশাই! ভাবলেও কষ্ট হয়। কত স্বপ্নই না দেখেছিলাম গতবার পুজোয়। হ্যান করেঙ্গা, ত্যান করেঙ্গা। নারকেল নাড়ু বানাবো। লালপেড়ে শাড়ি পরে ধুনুচি নাচ নাচবো। বাঙালী রেস্তোরাঁতে সবাই মিলে একসঙ্গে পাত পেড়ে বসে খাব। কিস্যু হল না। লক্ষ্মীছাড়া কোভিডের জ্বালায় সবকিছু গোলমাল হয়ে গেল!
মেলবোর্নে এটা আমার সেকেন্ড পুজো। গতবছর নতুন ছিলাম বলে তেমন কিছু করে উঠতে পারিনি। সিডনি থেকে তল্পিতল্পা গুটিয়ে মেলবোর্নে এসেছিলাম অগাস্টে। একটু থিতু হতে না হতেই পুজো চলে এল। কাছাকাছি খুব বেশী বাঙালীদের তখন চিনতাম না। তাই গতবার পুজোটা যেমন তেমন করে কেটেছিল। কিন্তু এখনকার ব্যাপার আলাদা। একবছরে বেশ কজন নতুন বন্ধু বানিয়েছি। তাই আশা করেছিলাম যে এবারের পুজোটা অন্যরকম হবে। তা অন্যরকমই বটে। প্যানডেমিক পুজোর রকমসকম দেখে বঙ্কিমচন্দ্রকে কোট করতে বাধ্য হচ্ছি, “কী দেখিলাম! জন্মজন্মান্তরেও ভুলিব না।”
সত্যিই ভোলবার নয়। লকডাউনে বাড়ির মধ্যে আটকে আছি। শরৎ প্রকৃতির শোভা দেখছি কাঁচের জানালার এপার থেকে। আহা শিউলি আর কাশফুল নাই বা রইল। সোনা ঝরানো নীল আকাশ তো আছে। ওয়াটল আর ম্যাপল গাছে নতুন পাতা এসেছে। জাকারান্দা আর মোম ফুলের গাছ ঝাঁপিয়ে ফুল ফুটেছে। জুলজুল চোখে তাকিয়ে দেখি তাদের।
অস্ট্রেলিয়ার ঋতু, প্রকৃতি, জলবায়ু, জীবজগৎ সবকিছুই বাকী পৃথিবীর অন্যান্য অংশের চেয়ে অনেকখানি আলাদা। এখানে অক্টোবর মাসে বসন্ত ঋতুর শুভাগমন হয়। মুখ গোমড়া করে বসে থাকা শীতকালের ক্যানভাসে শিশু ড্যান্ডেলিয়ন আর সাদা ডেইজি ফুলেদের উঁকিঝুকি দেখতেও বেশ মজা লাগে। অতএব তাই দেখছি। পুজোয় আনন্দ করার কথা তো ছেড়েই দিলাম, বাড়ির চৌহদ্দি থেকে বেরোনো অবধি বারণ।
অষ্টমীর সকালে বাগানের সামনে মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে ছিলাম। মা দুর্গা এবার সত্যিই আমাদের ওপর রাগ করেছেন। অবশ্য তাঁকেও দোষ দিতে পারি না। প্রকৃতির ক্ষতি ভিন্ন উপকার তো আমরা কিছু করিনি। গ্লেসিয়ার গলিয়েছি, স্বচ্ছতোয়া নদীর জল দূষিত করেছি, নিরীহ জীবজন্তুর নিধন যজ্ঞে মেতেছি, যুদ্ধ করে একে অপরের বুকে ছুরি বসিয়েছি। পরমেশ্বরী ক্রুদ্ধ হবেন, সেই তো স্বাভাবিক। তিনি মহামায়া। তিনি আদ্যাশক্তি। তিনি সর্বভূতে মাতৃরূপে সংস্থিতা। সমুদ্রসম্রাট নীল তিমি থেকে অতিক্ষুদ্র নেংটি ইঁদুরটিও তার সন্তান। সন্তানকে আঘাত করলে মা রাগ করবেন না! মহিষাসুরের জায়গা নিতে আমরা যখন দুবার ভাবিনি, তখন ত্রিশূলের আঘাতও মাথা পেতে নিতে হবে বৈকী!
সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে দুচোখ বেয়ে কখন জলের ধারা নেমেছে, টের পাইনি। হঠাৎ গ্রাউন্ড ফ্লোরের জানালা থেকে তাকাসাকি সানের গলা শুনে চমকে উঠলাম,
“অ্যাই মেয়ে, কী হয়েছে! একা একা বাগানে দাঁড়িয়ে কাঁদছো কেন?”
ভাবনার সুতো ছিঁড়ে যাওয়ায় একটু অপ্রস্তুত হলাম। তাকাসাকি দম্পতি আমাদের বিল্ডিং-এর গ্রাউন্ড ফ্লোরে থাকেন। বয়স্ক, স্নেহময় মানুষদুটির ব্যবহারে মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই। বলতে গেলে বিল্ডিং-এর সবার গার্ডিয়ান ওঁরা দুজন। বিপদে আপদে আমরা সবাই ওঁদের পরামর্শ নিই। বাংলায় যেমন পূর্ণবয়স্ক মানুষের নামের শেষে মহাশয় বা মহাশয়া যোগ করা হয়, ইংরিজিতে যেমন নামের পূর্বে মিস্টার বা মিস যোগ করা হয়, তেমনি জাপান দেশে নামের শেষে “সান” শব্দ যোগ করে সম্মানজ্ঞাপন করা হয়। আবাসনের সবাই তাই তাদের তাকাসাকি সান বলেই ডাকে।
জামার হাতা দিয়ে চোখের জল মুছে তাড়াতাড়ি বললাম,
“না, না কিচ্ছু হয়নি। আসলে আজকে আমাদের ফেস্টিভাল তো। এবছর কিছুই করা যাবে না। তাই একটু মন খারাপ। তেমন কিছু না।“
তাকাসাকি সান জানালা থেকেই বললেন,
“বন্ধুদের ফোন করনি?”
বললাম,
“করেছি।”
“তাহলে মন খারাপ কেন? ইট উইল বি অলরাইট নেক্সট্ ইয়ার। দেখে নিও।”
পুজোর সঙ্গে জড়িয়ে থাকা বাঙালী নস্ট্যালজিয়া কী অমনি এককথায় কাউকে বোঝানো সম্ভব! আমি গাঁয়ের মেয়ে। আমাদের গ্রামে একটাই পুজো হত। কাজেই পায়ে হেঁটে মন্ডপ দর্শনের সুযোগ তেমন ছিল না। কিন্তু তাই বলে যে আনন্দের ভাঁড়ার খালি থেকে যেত, তা কিন্তু নয়। আমাদের কাছে পুজো মানে ছিল চন্ডী মন্ডপ থেকে ভেসে আসা ড্যাম কুড়কুড় ঢাকের বাদ্যি। পুজো মানে শরৎকালের আলো ভরা আকাশ। পূজো মানে বাতাসে শিউলি ফুলের গন্ধ।
মাসখানেক আগে থেকেই প্রস্তুতি পর্ব শুরু হয়ে যেত। ঘরদুয়ার, উঠোন, গোয়াল ঘর, বাড়ির কালীমন্দির সবকিছু ধুয়ে মুছে ঝকঝকে করে তোলা হত। বাড়ির সবার জন্য জামাকাপড়, জুতো কেনার পালা। এরপর শুরু হত গোছগাছ। মা, কাকিমা, পিসিমা সবাই মিলে উঠোনে, বাড়ির দুয়ারে আল্পনা দিতেন। এখনকার মতো ফ্যান্সি সাতরঙা রঙ্গোলির চল তখন ছিল না। স্টিকারের তো প্রশ্নই ওঠে না। সাদামাটা পিটুলি গোলা দিয়ে আঁকা হত মঙ্গল চিহ্ন। মাঝে মধ্যে লালচে গিরি মাটির ছোঁয়ায় আল্পনার ডিজাইনে আসতো নতুনত্ব। শঙ্খলতা, পদ্মলতা, খেজুর ছড়ি, ধানের শীষ কী অপূর্ব নাম ছিল একেকখানা প্যাটার্নের। দুয়ারে কচি ডাব ও আম পল্লব সহযোগে রাখা হত মঙ্গল ঘট। গ্রামের দিকে দুর্গাপুজোয় শো অফ কোনোকালেই ছিল না। আমাদের কাছে দুর্গোৎসবের অর্থ ছিল বৎসারান্তে ঘরের মেয়ের ঘরে ফিরে আসা। পুরো পৃথিবীর কাছে হবে হয়তো তুমি কৈলাসবাসিনী, ত্র্যম্বকজননী, মহেশ্বরী। কিন্তু মাগো, বাঙালীর চোখে তুমি ঘরের মেয়ে উমা। তুমি আসবে বলেই সারা বছর হা পিত্যেশে অপেক্ষা করি সবাই। দুর্গোৎসব মানে আনন্দোৎসব। পরিবারে প্রতিটি সদস্য এবং কর্মচারীরা তো বটেই, এমনকি বাড়ির পোষ্য গরু, কুকুর এবং বেড়ালছানারাও সেই আনন্দের ভাগ থেকে বঞ্চিত হত না। বেড়ালছানাদের ভাগে কদিন দুধ জুটতো একটু বেশী। টমির জন্য কেনা হত নতুন বকলস। গরুদেরও ধুয়ে মুছে স্নান করিয়ে দেওয়া হত। তেল মাখানো হত তাদের শিং-এ এবং খুরে। আলো আর আনন্দ যেন থইথই করত চারদিকে।

প্রবাসে গতবারের দুর্গাপুজো
আমাদের ছোটদের সেকী উত্তেজনা। বাড়িতে আত্মীয়পরিজন সবাই আসবেন। ভাই বোনেরা আসবে। সেই আনন্দে রাত্রিবেলা ঘুম হত না কারোর। বারবার আঙুলের কড়ে গুনতাম কতগুলো জামা হল। হাসি ঠাট্টায় গমগম করত পুরো বাড়ি।
তখন খাওয়াদাওয়াও ছিল সাবেকী। পাস্তা, পিৎজা, শোয়ারমা-র তো নামই শুনিনি। মোগলাই, চাইনীজ, কন্টিনেন্টাল শুনলেও ভাবতাম ওসব অন্য গ্রহের লোকজন খায়। সকাল বেলা লুচি আলুর দম আর সন্দেশ দিয়ে জলখাবার সারা হত। তারপর চটপট স্নান সেরে, নতুন জামাকাপড় পরে ছুট ছুট ছুট চন্ডীমন্ডপে। পুজোর সময় বেশীর ভাগ দিনই হত নিরামিষ রান্না। ফুরফুরে তুলাইপাঞ্জি চালের ভাত, অমৃতসম ছানার ডালনা, কাজু-কিসমিস-নারকেল কুচি দিয়ে সোনামুগের ডাল, ফুলকপি আর আলুর তরকারি, ইলশেগুড়ি বৃষ্টির মতো ঝিরঝিরে আলুভাজা, সরষে আর মৌরি ফোড়ন দেওয়া টম্যাটোর চাটনি খেয়ে পেট ভরে যেত, কিন্তু মন ভরতো না। নবমীর ব্যাপার অবশ্য আলাদা। সেদিন প্রসাদী পাঁঠার মাংসই মেইন হিরো। বিজয়ার দিন ঘরে বানানো ক্ষীরের চন্দ্রপুলি, নারকেল নাড়ু, তিলের নাড়ু, মুড়ির মোয়া, মুড়কি, ফিনফিনে নারকেলের তক্তি, মুচমুচে ভাজা নিমকি দিয়ে অতিথি আপ্যায়ন করা হত। বড়রা বড়দের মতো আনন্দ করতেন, আর আমরা ছুটোছুটি করতাম আমাদের মতো।
তাকাসাকি সানের প্রশ্নে বাক্যহারা হয়ে গিয়েছিলাম আমি। বাঙালীর দুর্গাপুজো হল একটা র সেন্টিমেন্ট। মুখে বলে কি বোঝানো যায় যে কেন মিস করছি!
উনি ঘরের ভেতর থেকে একখানা ছোট বেতের টুল এনে বাগানে এসে বসলেন। আমি ওঁর পাশে ঘাসের ওপর বসলাম।
“ওকে, টেল মী মোর অ্যাবাউট ইয়োর ফেস্টিভ্যাল।“
ওঁকে তখন বললাম মহালয়ার গল্প। অন্ধকারের ওপর আলোর জয়ের গল্প। দেবী দুর্গার দশ অবতারের গল্প। উনি মন দিয়ে গল্প শুনলেন। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রশ্ন করলেন অনেকগুলো। যেমন মহিষাসুরের বরপ্রাপ্তির কথা শুনে হেসে বললেন,
“দ্য ওল্ড গড (ভগবান ব্রহ্মা) ওয়াজ রিয়েলি ক্লেভার। উনি ইচ্ছে করেই লুপহোল রেখেছিলেন।”
তারপর দুর্গার দশভুজের গল্প শুনে বললেন,
“ব্যাপারটা সিম্বলিক আমি জানি। কিন্তু মিথ্যে তো নয়। সমাজে বা সংসারে মেয়েদের দায়িত্ব চিরকালই অনেক বেশী। সো টেন হ্যান্ডসের উপমা বুঝতে এমন কিছু কষ্ট হয় না।”
ওঁর সঙ্গে গল্প করতে করতে হঠাৎ দেখি মন খারাপটা কোথায় যেন উধাও হয়ে গেছে। তাকাসাকি সান হেসে বললেন,
“বাহ্! এই তো সুন্দর হাসছো। ফিলীং বেটার?”
আমি মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বললাম।
“ফিলীং বেটার তো বটেই। কিন্তু কী করে হল?”
“নিজের দেশ থেকে কয়েক হাজার মাইল দূরে বসে অন্য দেশের একটি মানুষকে তোমার গডেস্ মাদারের গল্প শোনাচ্ছো। এটাও কী অফারিং (অঞ্জলি) নয়? ফুল দিয়ে অঞ্জলি দিতে পারনি তো কী হয়েছে, শব্দ দিয়ে অঞ্জলি দিয়েছ তুমি। তোমার গডেস্ মাদার উইল হ্যাপিলি অ্যাকসেপ্ট ইট।”
তখন মনে হল কথাটা তো ঠিক। দুর্গা আবাহন মন্ত্রের অর্থ যেন মা এবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন,
“আবাহনম্ ন জানামি, ন জানামি বিসর্জনম্।
পূজাচৈব ন জানামি, ক্ষম্যতাম পরমেশ্বরী।।
মন্ত্রহীনম্, ক্রিয়াহীনম্, ভক্তিহীনম্ সুরেশ্বরী।
য়ৎপূজিতম্ ময়া দেবী পরিপূর্ণম্ তদস্তু মে।।
অজ্ঞানাদিস্মৃতেভ্রান্ত্যা য়ৎ ন্যূনম্ অধিকম্ কৃতম্।
তৎ সর্ব ক্ষম্যতাম্ দেবী, প্রসীদ পরমেশ্বরী।।”
তোমার আবাহন, বিসর্জনের নিয়ম নীতি কিছুই জানি না। আমার এই অজ্ঞানতা বা বিস্মৃতির কারণে পূজায় যা কিছু নূন্যাধিক হবে, হে পরমেশ্বরী, তুমি তা নিজগুণে ক্ষমা করো। আমি নির্গুণ, আমি মন্ত্রহীন, ক্রিয়াহীন, ভক্তিহীন। মা তুমি নিজগুণে আমার পুজো গ্রহণ করে আমায় তুমি পরিপূর্ণ কর।
মানছি মন খারাপ হচ্ছে। লালপেড়ে শাড়ি, নারকেল নাড়ু, বাঙালী খাওয়াদাওয়া কিছুই হল না এ বছর। দুহাজার কুড়ি বছরটাই যাচ্ছেতাই। লক্ষ্মীছাড়া, খাপছাড়া, ছন্নছাড়া! নো প্রবলেম মা! এই বিচ্ছিরি সময়গুলোকে বিস্মৃতির চিলেকোঠায় ঢুকিয়ে তালাবন্ধ করে রাখব। নিজেদের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়েছি আমরা। কথা দিচ্ছি মা, নিজেরাও ভালো হব আর আগামী জেনারেশানকেও মানুষ হওয়ার শিক্ষা দেব। দুর্গা দুর্গতিনাশিনী মা! আমাদের ভুলভ্রান্তি ক্ষমা কর। মনের অন্ধকার দূর কর। লোভ, হিংসা, ঘৃণার বদলে আশা, করুণা, সমবেদনা দাও। ফুলের অঞ্জলি দিতে পারলাম না মা এবার। তার বদলে আমাদের আনন্দ, আমাদের দুঃখ, আমাদের ভালো, আমাদের মন্দ, আমাদের জ্ঞান, আমাদের অজ্ঞান সব কিছু তোমার পায়ে তুলে দিলাম। গ্রহণ কর পরমেশ্বরী। এবছর গেছে যাক। আশায় বুক বেঁধে রাখলাম। আসছে বছর আবার হবে!

এখানে কাশবন নেই, তবে ঘাসবন আছে
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team