রত্নদীপা দে ঘোষ
অক্ষরের মহাকাশ দিয়ে গড়া নিপুণ এক সূচিশিল্পের অনুরণনই দুর্গাপূজা।
স্বয়ং দেবী মায়ের কলমে লেখা আনন্দগ্রন্থ। নীল আকাশের কলম। হাল্কা মেঘের দ্যুতি। পয়ার ছন্দের কমলিনী প্রকৃতি, লাল পাড় সাদা বাতাস তুখোড় চন্দ্রমা। মা আসেন ধ্রুবতারার দেশ থেকে মাটির মৃগশিরায়। নক্ষত্রের আভরণে সেজে তিনি আসেন অমিতজ্যোতি লাবণ্যের রথে চড়ে আসেন এই শ্রেয়সী বসুধার স্নিগ্ধকুলায়।
খুব ছোটবেলায় আমার পুজো শুরু হত দাদুর হাত ধরে। দাদুর সঙ্গে ঠাকুর দেখতে যাওয়া। ষষ্ঠীর বিকেল থেকে থেকে। অষ্টমীর দুপুর মানেই বাবার সাথে কোচবিহার দেবীবাড়ি। এই পুজো রাজার আমলের। আমার শিশুচোখে সেই দেবীমূর্তি করালবদনা। মা মোটেও হাসিখুশি নয়কো, বরং একটু রাগীমতো। নামতা ভুল হলে, যোগ অংক, বিয়োগের হাতেখড়ি ভুল হলে আমার মা যেমন চোখ গোলগোল। ইনিও ঠিক অইরকম।
দেবীমণ্ডপের সামনেই মেলা বসতো। আমার বাবা কল্পতরু। যা চাইতাম তাই ভাগ্যে জুটে যেতো। নানা রকমের চকলেট লজেন্স… প্যাঁ পু বাঁশি… সব চাইতে বেশী লোভনীয় ছিল জলবেলুন। নানা রঙের বেলুন, আর তার ভেতরে জলভরা… কী যে দারুণ মজাদার ছিল সেইসব দিন… নিজেকে মহারানী ভিক্টোরিয়ার চাইতে কম কিছু মনে হত না যখন বাড়ি ফিরতাম…
ওই সময় পুজো মানে নতুন জামা আর জলবেলুন।
আরেকটু বড় হতেই পোশাকের দিকে মন গেল। পুজোর এক দেড় মাস আগে থেকে শুরু হত বায়না। মা নিজের হাতে কয়েকখানা জামা সেলাই করে দিতেন। স্কার্ট টপ। কখনো একটি দুটি কেনাও হত।
উপহার পেতাম মাসী পিসীদের কাছ থেকে। আমার ছোটমামা থাকতেন কলকাতায়। পড়তেন মেডিকেল কলেজে। হাত খরচের টাকা বাঁচিয়ে তিনিও জামা কিনে পাঠাতেন আমার আর মাসতুতো দাদার জন্যে।
পুজোর আরেকটা মজার ব্যাপার ছিল পুজোর বাজার করতে যাওয়া। সন্ধেবেলায় মা বাবার সঙ্গে। সেদিন বিকেল হতে না হতেই পড়াশুনো করে নিতে হত। স্কুলের হোমওয়ার্ক। কোচবিহারের লক্ষ্মী নারায়ণ বস্ত্রালয় বিখ্যাত শাড়ির দোকান। মনে আছে, পিসীদের শাড়ি যখন কেনা হত… মা খুব সাবধানে শাড়ি পছন্দ করতেন। ঠাকুমার কড়া নির্দেশ ছিল, সধবাদের শাড়ির পাড়ে কোনোভাবে কালো রং থাকা চলবে না…
পিসীদের শাড়ি পিসেমশাইদের জন্যে শার্টপিস, প্যান্টপিস। পিসতুতো বোনদের জন্যে জামার কাপড়।
দাদুর ধুতি। ঠাকুমার এবং দিদার জন্যে লাল চওড়া পাড়। মা বাবার মাঝখানে বসে এইসব কেনাকাটার মধ্যে পুজোর ঘ্রাণ টের পেতাম। বাজার করা শেষ হলে টুক টুক করে হাঁটতে হাঁটতে আমরা যেতাম পুরনো বাজারের পেছন দিকে। সেখানে একটা দোকানে পাওয়া যেত রসমালাই। কী অপূর্ব স্বাদ ছিল তার। এখন নানা রকমের রসমালাই খাওয়া হয়, সেই স্বাদ আর পাই না। পাওয়া যায় না বলেই স্বাদবৃদ্ধি হয় দিনে দিনে।
বাবার বুকে মাথা মায়ের কোলে পা, ঘুম চোখে ঢুলতে ঢুলতে রিক্সা চড়ে বাড়ি ফেরার নাম দুর্গাপূজা।
ঠিক এইসুরেই পুজো বেজে উঠতে থাকে আমার জীবনে। জামার ডিজাইন বদলে যায়। ফুলকারির ঢল আসে জোয়ারে। পাখি-পাখি সালোয়ার, কামিজ পালকের। ওড়না জুড়ে ঢেউ। সুতির কলমকারি। ঝর্নাজলের সেতার। পুজো মানেই গানগুচ্ছ তানগুচ্ছ কুহুগুচ্ছ, অজস্র সরগমের তানপুরা।
স্কুলজীবন শেষ হলে ভর্তি হই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। শুরু বাড়ি ছেড়ে মা বাবা বোনকে ছেড়ে হোস্টেলে থাকা। গরমের ছুটিতে দেড় মাসের জন্যে বাড়ি আসা হতো। সেই ছুটি ফুরিয়ে যেত দেখতে দেখতে। এক ফু-তে নিভে যেত সকল আনন্দের আয়োজন। ফিরতে হত কলকাতায়। সেই সব মুহূর্তে মনে আর প্রাণে শক্তি যোগাতো পুজো। চোখ মুছতে মুছতে বাবা বলতেন… এই তো মাঝে মাত্র তিনটা মাস! দেখতে দেখতে পূজা আইসা যাবে। তুইও আইসা পড়বি বাড়ি…
বাবার এই দুটি বাক্য হারকিউলিসের শক্তি দিত। ভাবতাম। বেশী দিনের ব্যাপার তো নয়। মাত্র তিনটা মাস। আবার পুজো। দেবীমা বাড়ি ফিরবেন… আমিও…
ট্রেনের নাম তিস্তাতোর্সা! বারোটা পাঁচ। নিউ কোচবিহার স্টেশন থেকে যাত্রা শুরু। কলকাতার দিকে।
মা-বাবা। ট্রেনের জানলা। হাত নাড়া। চোখ মোছা। বাবার কণ্ঠ কেঁপে ওঠে, মেয়ে কণ্ঠ দুলে ওঠে।
এই তো পুজা আসতেছে আবার! মাত্র তিনটা মাস মাঝখানে। বেশী দিনের ব্যাপার না! আইসা পড়বি আবার… তিস্তাতোর্সার কণ্ঠে উঠলে ওঠে দৈবীমুহূর্তরা! পূজা আসতেছে পূজা… বেশী দিন বাকী নাই আর… মাত্র তিনটা মাস! মাত্র তিনটা…মাস…
বাহির থেকে ঘরে! বাহির থেকে অন্দরে বার বার ফিরে আসার নামই দুর্গাপূজা!

Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team