লকডাউনে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত মিষ্টির দোকান খোলা রাখা নিয়ে নানা মস্করা ছড়িয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়, বহু তথাকথিত শিক্ষিত মধ্যবিত্তদের হাস্যকর মন্তব্য শেষ অব্দি মিষ্টির কারিগরদের কানে গিয়েছে কিনা বলা কঠিন, তবে কানে গেলেও মিষ্টির দোকানি বা কারিগর-মজুরদের তা নিয়ে মাইন্ড করবার উপায় নেই। কারণ সওয়াল পাপী পেট কা। মিষ্টি বানানো বন্ধ থাকা মানে কেবল ময়রাদেরই নয়, সংকট নেমে আসে ডেয়ারি শিল্পেও। তার চেয়েও বড় কথা হল, সংক্রমণ আটকানোর জন্য অন্যান্যদের সাথে ডেয়ারি ও মিষ্টি শিল্প বন্ধ করে রাখা গেলেও, গোরু মোষের রোজকার দুধ উৎপাদন আর তো বন্ধ রাখা যায় না। হাজার হাজার লিটার দুধ অব্যবহারে রোজ নর্দমায় ফেলে দেওয়া হচ্ছে, এছবি আর যাই হোক দুনিয়ার সামনে সুস্থ ইমেজ তুলে ধরে না।
বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে মিষ্টির দোকান খোলা রাখার কারণ ও উপযোগিতা নিয়ে রচনা বা ভাষণ দীর্ঘায়িত না করে এটুকু বলা যায় গ্রামীণ ময়রাদের অবস্থা খারাপ থেকে আরও খারাপ হয়েছে। অনেক পরিবার বংশানুক্রমিক ব্যবসা বন্ধ করে, দোকান-ঘর ভাড়া দিয়েছে কিন্তু সেখানেও কোন ফল মেলেনি। তাদের মাসিক ভাড়াও ঠিক সময়মতো মিলছে না। কম পয়সায় বা বিনা পয়সায় রেশন পেলেও বর্তমান পরিস্থিতিতে তারা বুঝে উঠতে পারছে না তাদের পেশার কী ভবিষ্যৎ? শহর জীবনে ডায়াবেটিসের প্রাদুর্ভাব থাকলেও তা গ্রাম জীবনে নেই, তবু গ্রামীন ময়রাদের কেন এই বিপন্ন পরিস্থিতি তা নিয়ে একটু খোঁজ নেবেন না?
গ্রামীণ সংস্কৃতি ও শহুরে সংস্কৃতি সমাজের দুই মেরুতে অবস্থান করলেও এদের মধ্যে একটি যোগসূত্র অবশ্যই বর্তমান। দিনবদলের ধারায় মানব সমাজ নিজেদের শহুরে সংস্কৃতির টানে ভাসিয়ে দিয়েছে। ফলত গ্রামীণ জীবনে অনেক মানুষকে জীবন সংগ্রামে পরাজয় স্বীকার করে নিতে হয়েছে। বর্তমান বাজার-অর্থনীতিতে মিষ্টি শিল্পেও রাঘব বোয়ালদের তাণ্ডবে ছোট ব্যবসাদারদের বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে। যেমন গ্রামে আগে অনেক ময়রার দোকান দেখা যেত, যা বিলুপ্ত হতে হতে এখন প্রায় নেই বললেই চলে। গ্রামের মানুষেরাও এখন শহরের নামকরা দোকান থেকেই মিষ্টি কিনতে বেশি পছন্দ করে। শহরের বিখ্যাত ব্র্যান্ডের ঝাঁ চকচকে বিপণির সঙ্গে পেরে উঠছে না গ্রামের নিরাভরণ মিষ্টির দোকানগুলো।
সাধারণত এই সমস্ত গ্রামীণ দোকানগুলিতে কাঠের জ্বালানি ব্যবহার করা হয়ে থাকে, কেননা অতি চড়া দামের গ্যাস ব্যবহারে তারা নিজেদের মানিয়ে নিতে পারে না। চুলার আগুনের ঝুল দোকানের বিভিন্ন স্থানে লেগে থাকায় অনেকেই সেই দোকানকে এড়িয়ে যায়। গ্রামীণ ময়রারা আর্থিক স্বচ্ছলতার অভাবেই মার্বেল-টাইলস, দামি চেয়ার, মিষ্টি দ্রব্য রাখার স্টিলের বাক্স, রেফ্রিজারেটর, এসি, কুলার, গ্যাস ইত্যাদি ব্যবহার করতে পারছে না। ফলে পিছিয়ে পড়ছে প্রতিযোগিতায়। মিষ্টি সংরক্ষণ করতে পারছে না। আগে গ্রামে মিষ্টির দোকানে প্রচুর লোক কাজ করত। ক্রেতাও ছিল প্রচুর। কিন্তু ব্যবসার সে রমরমা এখন আর নেই। গ্রামের কারিগরেরাও পাড়ি জমিয়েছে শহরে। কেননা সেখানে মাসিক বেতনের পরিমাণ বেশি এবং কাজের নিরাপত্তা আছে।
সাধারণত গ্রামের ময়রার দোকানগুলিতে সকালে পুরি-সবজি, দুপুরের দিকে পরোটা, সন্ধ্যায় সিঙারা, নিমকি জাতীয় ঝাল খাবারের পাশাপাশি বিভিন্ন রকমের মিষ্টি (রসগোল্লা, চমচম, সন্দেশ, কালোজাম, দই, ক্ষীর, জিলিপি ইত্যাদি) পাওয়া যায়। একই মিষ্ট দ্রব্য এবং একই স্বাদযুক্ত খাবার মানুষের কাছে প্রভেদ নিয়ে আসে শুধুমাত্র অবস্থানগত বিচারে। সাধারণত গ্রামীণ ময়রার ডাক পড়ে শুধুমাত্র নির্দিষ্ট কিছু বিয়ে, শ্রাদ্ধ, অন্নপ্রাশন ইত্যাদি অনুষ্ঠান বাড়িতে। যদিও ভালো করে দেখলে স্পষ্ট হয়ে ওঠে সেই আনুষ্ঠানিক যোগানের বেশির ভাগই দরিদ্র সাধারণ পরিবারের কল্যাণে। একদিকে টাকার পরিমাণের বিচারে এবং অন্যদিকে সু-সম্পর্কের খাতিরের জন্যই হয়তো তারা গ্রামীণ ময়রার দোকানে যায়।
এদিকে, গ্রামীণ ময়রারা নিজেদের টিকিয়ে রাখতে পাশাপাশি অন্য ব্যবসা খুলে বসেছে। ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে গিয়ে কেউ কেউ চোলাই মদের ব্যবসাতেও নিজেদের নিযুক্ত করেছে। একদিকে নিজের বংশানুক্রমিক ব্যবসা ধ্বংস হয়েছে, অন্যদিকে নতুনপথে রোজগার করতে গিয়েও ময়রাদের বিভিন্ন রকম সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। যার পরিণতি স্বরূপ ময়রার সংসার আজ ছন্নছাড়া, এমনকি পরিবারের মানুষেরা নিজেদের বাঁচিয়ে রাখতে গিয়ে বিভিন্ন জায়গায় কাজের অনুসন্ধান করছে, কিন্তু কোথাও কোনো সুরাহা পাচ্ছে না। কিন্তু বংশানুক্রমিক পেশা ছেড়ে নতুন পেশায় থিতু হওয়া কি রাতারাতি সম্ভব? প্রতিদিন বেঁচে থাকাটাই এখন তাদের চ্যালেঞ্জের মুখে। বাংলার তাঁত বা হস্তশিল্পের মতই সাবেক পল্লী সংস্কৃতির অঙ্গ হিসেবেই এই লুপ্তপ্রায় মফস্বল ও গ্রামীণ ময়রাদের অস্তিত্ব নিয়ে বোধহয় সরকারি স্তরে ভাবার সময় এসেছে।
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team