দেবায়ন চৌধুরী
(১)
আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম... স্বপন বসু গাইছিলেন পুজো মণ্ডপে। আমি খানিক আনমনা হয়ে ভাবছিলাম পুরোনো সেই পুজোর কথা। জীবন দিয়েই যে বুঝেছি দিন হতে দিন আসে কঠিন। প্রথম যখন পড়তে গিয়েছিলাম যাদবপুরে, পুজোয় ফিরেছিলাম পঞ্চমীতে। বড়ো একটা দল একসঙ্গে টিকিট কেটে হইহই যাত্রা। এক যুগ কেটে গেলেও মনে হয় এই সেদিন। উত্তরবঙ্গ এক্সপ্রেসে বর্ধমান, বোলপুর থেকেও উঠেছিল বন্ধুরা। আমাদের ঘরে ফেরার উৎসাহে সেবার সহযাত্রীদের রাতের ঘুম উবে গিয়েছিল। সময়ের তাগিদেই ধীরে ধীরে সেই বড়ো দলটি ছোটো হতে শুরু করল। প্রথাগত পড়াশুনোর পর আমাদের কয়েকজন চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিল, কেউ প্লেসমেন্ট পেয়ে চলে গিয়েছিল সুদূর দক্ষিণে। কেউ ফিরে এসেছিল বাড়িতেই। পুজোয় বাড়িতে থাকতেই হবে এই আন্তরিক বাধ্যবাধকতা ছাপিয়ে আরো কিছু চিন্তা মস্তিষ্কে দ্রুত থাবা বসাচ্ছিল। তবু আমরা ফিরতাম। চেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখতাম না। আগে থেকে ট্রেনের টিকিট পেলে ভালো নাহলে তৎকাল সংকল্প, আর হরি হে দীনবন্ধু জেনারেল কামরা তো ছিলই। কবে এলি আর কবে ফিরবি-র মধ্যে কেটে যেত পুজোর কয়েকটা দিন। সপ্তমীতে সিনেমা, অষ্টমীতে রামকৃষ্ণ মিশন, নবমীতে সাগর দিঘিকে সাক্ষী রেখে রিইউনিয়ন; দশমীতে তোর্ষার তীরে ক্যামেরা নিয়ে ঘোরাফেরা করবার সেই দিনগুলি মনে পড়ে।
মৃন্ময়ীকে ভাসিয়ে দিয়ে আমরা ফিরে আসতাম ক্লাবে। নিশ্চুপ প্যান্ডেলে ঘটের জল হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন পুরোহিত। শান্তিবারি মাথায় ঢেলে জড়িয়ে নিতাম পরস্পরকে। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এই পুজোয় সামিল হয়েছিলেন যেসব মানুষজন, উষ্ণতার স্পর্শে পেতে চাইতেন আত্মীয়তার অনুভব। স্পর্শ নিজেই এক ম্যাজিসিয়ান। লোহাকে সোনা করবার রসায়ন যার হাতের মুঠোয়।
(২)
গত বছর আসতে পারিনি পুজোয়। এবছর এলাম। ঘুরে বেড়ালাম চেনা রাস্তায়। চিলাপাতার জঙ্গলে মাস্ক খুলে প্রাণ খুলে নিতে চাইলাম বাঁচার রসদ। মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েই জীবনকে চেনা যায় সবচেয়ে ভালো। রাতের পর রাত উৎকণ্ঠায় কাটিয়েছি গত মার্চ মাস থেকে। নিউ-নর্মালের মধ্যেই উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ সঙ্গী হয়েছে আমার। ডাক্তারের পরামর্শ মতোই খবর দেখা ছেড়ে দিয়েছি। কিন্তু সব ভয়কে দূর করব এমন সাধ্য আমার নেই। স্পর্শদোষের কথা ভাবতে ভালো লাগে না। কিন্তু কিছু করার উপায় রইলে তো! এবছর বিজয়ার পর প্রণাম করতে গেলেও অনুমতি নিতে হবে নাকি? আর হ্যাঁ, কোলাকুলি নৈব নৈব চ। এটা কোরোনা ওটা কোরোনা—রোগটার নামই যে করোনা!
মাস্কবাদী জনতার ভাবগতিক নিয়ে কত লেখালেখি চলছে। সাবধানের মার নেই আর মারেরও সাবধান নেই। মা দুর্গা বাপের বাড়িতে এসে শান্তি পেলেন না। বাল্যসখীরা মাস্ক পরে দেখা করতে এলে কার ভালো লাগে! ছেলেমেয়েদের কত আর সতর্ক করবেন... হাত না ধুয়েই টপাটপ নাড়ু খেয়ে ফেলছে গণেশ।
(৩)
পুজোয় যে ঘরে ফিরতে পারব মাত্র তিন মাস আগেও ভাবতে পারিনি সেকথা। তবু তো এলাম। দেখলাম প্রিয়জনদের, এটাই কম কীসের। তাই চাষার মতোই আশা নিয়েই বাঁচতে চাই। ভার্চুয়াল পৃথিবীতে কত কাণ্ডই না ঘটছে প্রতিদিন। মাউসের এক ক্লিকে যদি মায়ের পায়ে অঞ্জলি দেওয়া যায়, তাহলে কোলাকুলিই বা বাদ যাবে কেন? রসগোল্লার পাত্র আর শুভ বিজয়া লেখা মেসেজে আমাদের ইনবক্স ভরে যাবে শীঘ্রই। সেখানে আলিঙ্গনের ছবিও নিশ্চয়ই থাকবে। এবছর পরস্পরকে ভালোবেসে দূরে দূরেই থাকি আমরা। ছন্দে ফিরুক জীবন। কোনো কিশোর পরের বার নিষ্পাপ মনে নিশ্চয়ই জিজ্ঞেস করবে — মেয়েদের সঙ্গে কোলাকুলি করা যাবে না?
অসুর শক্তির বিরুদ্ধে জয়ের উদ্যাপনই হল বিজয়া। যেদিন করোনাসুর জব্দ হবে, সেদিন থেকে আমরা মেতে উঠব প্রাণের উৎসবে। বুকে টেনে নেব ডাক্তার, স্বাস্থ্যকর্মী, পুলিশসহ সমস্ত করোনা যোদ্ধাদের। জীবনের উষ্ণতায় নিশ্চিত হারিয়ে দেব অসুখের শৈত্যকে।
শুভ আর বিজয়া হাত ধরে ঘুরতে বেরোবে আবার...
পুনশ্চ—আমার হাত বান্ধিবি, পা বান্ধিবি, মন বান্ধিবি কেমনে/ আমার চোখ বান্ধিবি, মুখ বান্ধিবি, পরান বান্ধিবি কেমনে?... সাহানার গলায় কতবার যে এই গানটি শুনেছি মনে নেই। গান যখন জীবনভাষ্য হয়ে যায়, তাকে জড়িয়ে ধরা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে বলুন?
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team