× home হোম archive আগের ওয়েব সংখ্যা panorama ডুয়ার্স সম্পর্কে play_circle_filled ভিডিও file_download মুদ্রিত সংখ্যার পিডিএফ library_books আমাদের বইপত্র
people এখন ডুয়ার্স সম্পর্কে article শর্তাবলী security গোপনীয়তা নীতি local_shipping কুরিয়ার পদ্ধতি keyboard_return বাতিল/ফেরত পদ্ধতি dialpad যোগাযোগ
login লগইন
menu
ad01112021081913.jpg

নানা সমস্যায় জর্জরিত ক্ষুদ্র চা চাষিদের দীর্ঘমেয়াদী অতিমারিতে অস্তিত্ব রক্ষাই চ্যালেঞ্জ

সঞ্জয় রায়
Tea farmers’ existence in stake

বর্তমান গ্রামীণ মানুষের অস্তিত্ব সংকটের কারণ হিসেবে একদিকে যেমন অতিমারি প্রত্যক্ষভাবে জড়িত, অন্যদিকে তেমনই প্রাক-করোনা সময়ের ক্ষয়িষ্ণু বাজার-অর্থনীতিও পরোক্ষভাবে দায়বদ্ধ। নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত থাকলেও চা চাষকে কেন্দ্র করে উত্তরবাংলার গ্রামীণ ক্ষুদ্র চা চাষিদের গত দশক থেকে যেটুকু আর্থিক স্বচ্ছলতা এসেছিল, গত চোদ্দ মাসের কোভিড-লকডাউনের পরিস্থিতি তাদের পুরোপুরি পঙ্গু করে দিয়েছে বলা যায়। ‘চা শিল্প’ যেহেতু আমদানি-রপ্তানির ওপর নির্ভরশীল, সেহেতু বারংবার লকডাউন ও কোভিডের বিধিনিষেধে একদিকে যেমন কৃষকের জমি থেকে উৎপাদিত চা ফ্যাক্টরি পর্যন্ত পৌঁছতে পারে না, তেমনি অন্যদিকে ফ্যাক্টরি থেকে উৎপাদিত চা বিদেশে রপ্তানি করাও বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ফলত চা পাতার বাজার দরের ক্ষেত্রে মন্দা দেখা দেবেই, আর তাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সব ছোট মাঝারি চা-কৃষকরা।

পশ্চিমবঙ্গের অর্থকরী কৃষিজ ফসলের তালিকার নিরিখে ‘চা’ অন্যতম প্রধান হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। বিশ্বের যে কয়টি দেশে চা উৎপাদন হয়, ভারতবর্ষ তার মধ্যে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে রয়েছে এবং এখানের চা উৎপাদক রাজ্যগুলির মধ্যে অসমের পরেই পশ্চিমবঙ্গের স্থান। ভারতের মোট চা উৎপাদনের প্রায় ২৩ শতাংশ আসে পশ্চিমবঙ্গ থেকে। যেহেতু এ রাজ্যে উত্তর বাংলার হিমালয় সংলগ্ন দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার, কোচবিহার জেলার জলবায়ু চা চাষের পক্ষে অনুকূল, এই জলবায়ুর উপর ভিত্তি করেই ক্ষুদ্র চা চাষ এখানকার অন্যতম একটি কৃষিজ ফসল হয়ে দাঁড়িয়েছে। যার মধ্যে জলপাইগুড়ির জেলার অন্তর্গত তিস্তা নদী সংলগ্ন ময়নাগুড়ি ব্লক কোনো অংশে পিছিয়ে নেই।

পূর্বে এই অঞ্চলের প্রধান কৃষিজ ও অর্থকারী ফসল হিসেবে ধান, পাট, গম, রবিশস্য চাষ করা হত। কিন্তু পরিবর্তনশীল সময় ও সমাজে বংশ-পরম্পরাগত চাষাবাদ মানুষের অর্থনৈতিক চাহিদাকে পূরণ করতে পারত না। এই কৃষিজ ফসলগুলি শুধুমাত্র বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে চাষ করা হয় এবং এর বাজারগত চাহিদাও নির্দিষ্ট সময়কে ঘিরে থাকে। কিন্তু এজাতীয় ফসলের তুলনায় চা চাষ বেশি অর্থকরী এবং এর বাজারগত চাহিদা সারা বছর বেশি থাকে বলে, গ্রামের ক্ষুদ্র কৃষকেরাও চা চাষের দিকে ঝুঁকে পড়ে।

চা চাষ গ্রামীণ মানুষের অর্থনৈতিক সমস্যাকে লাঘব করেছে ঠিকই, কিন্তু তা কেবল একটি নির্দিষ্ট শ্রেণির  মানুষের জীবনের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। যাদের জমি আছে, যারা এতদিন ধান, পাট, গম ইত্যাদি ফসল বংশপরম্পরায় চাষ করে এসেছে, তাদের ক্ষেত্রে এই চা চাষ খুবই অর্থকরী ফসল হয়ে ওঠে। কিন্তু সমাজের যারা শ্রমজীবী মানুষ, তাদের জন্য চা চাষ শুরুর দিকে আশীর্বাদ হয়ে এলেও বর্তমান পরিস্থিতিতে তা অভিশাপ হয়ে নেমে এসেছে। কারণ যন্ত্রসভ্যতার উন্নতিতে, অত্যাধুনিক মেশিন একদিকে যেমন উৎপাদন শক্তিকে বৃদ্ধি করেছে, ঠিক তেমনি শ্রমিকের সংখ্যাকেও কমিয়ে এনেছে। একজন শ্রমিক যেখানে এক দিনে ৫০-৬০ কিলোগ্রাম চা পাতা তুলতে পারে, সেখানে একটি মেশিন একদিনে নিঃসন্দেহে ৬০০-৭০০ কুইন্টাল পাতা তুলতে পারে।

ফলত শ্রমজীবী মানুষ কর্মসংস্থানের জন্য সেই পরিযায়ী শ্রমিক হয়ে ভিন রাজ্যে পাড়ি দেয়। এমনকি যেসব ভূমিহীন চাষীরা এতদিন অন্যের জমিতে আধিয়ার হিসেবে চাষাবাদ করত, আজ তারা হতদরিদ্র হয়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও দিনমজুরি করে জীবন-যাপন করতে বাধ্য হয়। অন্যান্য কাজের মতো চা চাষের জন্য দক্ষ শ্রমিকের চাহিদা সবসময় বেশি থাকলেও শ্রমিকদের লিঙ্গ ভেদে মজুরি নির্ধারণ করা হয়। মহিলাদের ১৫০ টাকা ও পুরুষদের ২০০ টাকা হিসেবে হাজিরা করার জন্য সকাল আটটা থেকে দুপুর এক-টা পর্যন্ত নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করা হয়ে থাকে।

জমি থেকে চা পাতা তোলা এবং তা বাজারজাত করা অর্থাৎ ফ্যাক্টরি পর্যন্ত পৌঁছানোর ব্যবস্থাটি ‘সেন্টিগ্রেট’ ব্যবসা হিসেবে পরিচিত। এই ব্যবস্থায় দেখা যায় কৃষকেরা তাদের জমি থেকে উৎপাদিত চা পাতা বাড়ির একটি নির্দিষ্ট জায়গায় জমা করে রাখে। সেই চা পাতা গ্রামের একদল পাইকারি ব্যবসায়ী কিলো প্রতি মূল্য দরে কিনে গাড়িতে করে ফ্যাক্টরি পর্যন্ত পৌঁছে দেয়। যারা সেই চা পাতা নির্দিষ্ট মূল্যে ক্রয় করে ফ্যাকটরিগুলিকে বিক্রি করে, তারা ‘অ্যাকাউন্টার’ নামে বেশি পরিচিত। ক্ষুদ্র চা চাষীদের পাতার যোগান পরিমাণে স্বল্প হওয়ায় তারা সরাসরি ফ্যাক্টরি পর্যন্ত যেতে পারে না, ফলে ফ্যাক্টরির ন্যায্য মূল্যের হার থেকে তারা বঞ্চিত হয়। যেখানে পাইকারেরা কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি ১৫ টাকা কিলো দরে চা পাতা ক্রয় করে, সেটা তারা বিক্রি করে ১৮-১৯ টাকায় এবং সেই চা পাতা ফ্যাক্টরিতে বিক্রি হয় ২৩-২৪ টাকায়।

এই ‘সেন্টিগ্রেড’ ব্যবসায় অ্যাকাউন্টারদের হাতেই ক্ষুদ্র চা চাষীদের ভাগ্য নির্ধারণ হয়। শুধু অ্যাকাউন্টারদের কাছেই নয়, গ্রামের ক্ষুদ্র চাষীরা সরকারি বিভিন্ন অনুদান ও আর্থিক সহায়তা থেকেও বঞ্চিত হয় বারবার। ‘কেন্দ্রীয় টি বোর্ড’ ক্ষুদ্র চা চাষীদের যে ভরতুকি দেয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা চাষীদের কাছে পৌঁছায় না। কারণ টি বোর্ডের যারা সদস্য তারা বড় বড় চা শিল্পের দিকেই নজর দেন; ক্ষুদ্র চাষীরা তাদের সেভাবে এখনও দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে নি।

চা অর্থকরী ফসল হলেও নানা সীমাবদ্ধতার জন্য ক্ষুদ্র চা চাষীদের নানারকম ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়, এর জন্য বাজারদরই অনেকাংশে দায়ী। অন্যান্য ফসল বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে উৎপাদিত হলেও চা পাতা মোটামুটি ৩০ দিন পর পর তুলতে হয়। আবার মাঝে মাঝে প্রতিকূল আবহাওয়াবশত তা ৪০-৪৫ দিনে এসে দাঁড়ায়। বিঘাপ্রতি ৭-৮ কুইন্টাল চা পাতা উৎপন্ন হয়, যার বাজারদর কিলো প্রতি গড়ে ১৫-২০ টাকার মধ্যে থাকে। আবার এই বাজারদর সবসময় সমান থাকে না। আমদানি-রপ্তানির খারাপ পরিস্থিতিতে চা চাষীদের কিলো প্রতি ৪-৫ টাকা পর্যন্ত রেটেও চা পাতা বিক্রি করতে হয়। তাই অনেক সময় চাষীদের চা পাতা বিক্রি করার পর প্রায় কিছুই থাকে না। অর্থ সংকট এমন হয়ে দাঁড়ায় যে সাংসারিক নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রীর চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে সাধারণ দরিদ্র শ্রেণির কৃষকেরা হিমশিম খায়। কিন্তু তারা তাদের ইচ্ছা সত্ত্বেও অতীতের বংশ-পরম্পরাগত চাষাবাদে ফিরে আসতে পারে না। কারণ চা পাতা একটি দীর্ঘজীবী ফসল, যা একবার রোপণ করলে সেই জমিতে অন্যান্য ফসল চাষ করার সম্ভাবনা আর থাকে না।

করোনাকালীন লকডাউন পরিস্থিতিতে এমনও হয়েছে যে, জমি থেকে চা পাতা তোলার পরে শুধুমাত্র যানবাহনের অভাবে ফ্যাক্টরি পর্যন্ত পৌঁছাতে না পারার জন্য সেই চা পাতা চাষীরা মাঠে ফেলে দিতে বাধ্য হয়েছে। করোনার নির্দিষ্ট বিধি মেনে শ্রমিক সংখ্যা নির্ধারিত করায় জমি থেকে পাতা তোলার ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র চাষীদের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় এবং ফ্যাক্টরিতে কাজকর্ম পরিচালনার ক্ষেত্রেও বাধানিষেধের মুখে পড়তে হয়। ফলে ছোট ছোট চা চাষীদের অবস্থা শোচনীয় হয়ে দাঁড়ায়, কারণ চা পাতা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে জমি থেকে না তুলতে পারলে পাতার গুণাগুণ যেমন অনেকটাই কমে যায়, তেমনি অনেকসময় সেই পাতা কেটে ফেলে দিতে হয়।

একদিকে চা চাষীদের যেমন এই ক্ষতি স্বীকার করে নিতে হচ্ছে, অন্যদিকে চা গাছের পরিচর্যার জন্য প্রয়োজনীয় কীটনাশক, সার, স্প্রে মেশিন ও অন্যান্য দরকারি সামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধির ফলে চা-কৃষকেরা জমিতে সঠিক পরিমাণে তা প্রয়োগ করতে না পারায় তাদের উৎপাদন কমে আসছে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় আর্থিক দুরবস্থায় অনেক চা চাষীরা তাদের জমির পরিচর্যা করার সামর্থ্য না থাকায় তাদের আবাদি কৃষিজমি বন্ধক রাখতেও বাধ্য হচ্ছে। গ্রামীণ ক্ষুদ্র চা চাষীদের অস্তিত্ব আজ সংকটের মুখে, উন্নয়নমুখী সরকার বাহাদুরের কানে তাদের এই বিপদের কথা কে তুলে দেবেন? কে ভাববেন তাদের বাঁচানোর কথা?

করোনা কালের প্রতিবেদন ফ্রি রিডিং

Disclaimer: Few pictures in this web magazine may be used from internet. We convey our sincere gratitude towards them. Information and comments in this magazine are provided by the writer/s, the Publisher/Editor assumes no responsibility or liability for comments, remarks, errors or omissions in the content.
Copyright © 2025. All rights reserved by www.EkhonDooars.com

Design & Developed by: WikiIND

Maintained by: Ekhon Dooars Team