‘সমাজ’ বড্ড নিরীহ তিনটে শব্দ, কিন্তু কী ভয়ঙ্কর ইমপ্যাক্ট। সময় সব কিছু ভুলিয়ে দেয় একথা আমরা সবাই জানি। অমল জানালার বাইরে তাকিয়ে যে দইওয়ালাকে দেখতো তারা দুজনেই সমাজ। আবার যক্ষপুরীর ভেতর রাজা, অধ্যাপক, বিশুপাগল, নন্দিনী এরা সবাই সমাজ। লক্ষ্মণ সেন সমাজ আবার বল্লাল সেনও সমাজ। আদিম কাল থেকে মানুষ গোষ্ঠীবদ্ধ জীব। সেই গোষ্ঠীর মানুষেরা গোষ্ঠীপতির কথামতো কাজের দায়িত্ব পালন করতো। পড়াশোনা ছিল না, ফ্রয়েড ছিল না, তাই ইগো ছিল না। লুকিয়ে চুরিয়ে মেয়ে দেখা ছিল কি না সেটা নিয়ে নৃতাত্ত্বিকরা ভাবুক গে। এরপর গোষ্ঠী ছেড়ে সমাজ এল হৈ হৈ করে, মানে এটাকে ঠিক গোষ্ঠীর সমকক্ষ বলা যাবে না। এটা অনেকটা লার্জ স্কেলের ব্যাপার। রাজা এল, জমিদার, পাইক, পেয়াদা, নায়েব, গোমস্তা এদের সাথে এসে মিশল শক, হুন, পাঠান, মোগল আর সবশেষে ইংরেজ। ব্যস সমাজের মা হয়ে গেল আর কি। সমাজ আর নিরীহ রইল নাকি? মোটেই নয়, আজ এই ফরমান, কাল সেই ফরমান, ব্রিটিশ কালচার আর ফরাসি পর্তুগীজ কালচার সব ঘেঁটে ঘ-এর একটাই সলিউশন। ‘ভায়া টিকিয়া থাকিতে গ্যালে পয়সা রোজগার করিতে হইবে।’ অবশ্য গাঁ গঞ্জের ব্যাপারটা আরেকটু আলাদা হইলো। তাহারা দিনভর গঞ্জিকা সেবন করিয়া তাস পিটিয়া আশেপাশের সকলের চৌদ্দপুরুষের উদ্ধার করিয়া বেলা দ্বিপ্রহরে বাটি ফিরিয়া চর্ব্য-চোষ্য-লেহ্য-পেয় উদরস্থ করিয়া দিন চালাইতেছিলেন।
বেশ চলছিল, গোল বাঁধল রেনেসাঁ। শহরের মানুষ গ্রামে, গ্রামের মানুষ শহরে ভীড় করল রুটি রুজির টানে (যদিও পরের পরিমাণটাই বেশি)। ইংরেজি শিক্ষার প্রতি আগ্রহ বাড়ল, ফলে তৈরী হল শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালি শ্রেণি। ইংরেজরা নিজেদের প্রয়োজনেই বাঙালিদের তৈরি করলেন কেরানি হিসেবে। এরা খায় দায় অফিস যায় আর ঘুমোয়। যাই হোক সেসব এখন অতীত। বর্তমানে অর্থাৎ ষাট সত্তর দশক আগেও বাঙালির প্রধান জীবিকাগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল কেরানি অধ্যাপক এবং স্কুল মাষ্টার। সিভিল সার্ভিসের আগ্রহ আরও পরে।
বিভিন্ন বিবর্তন আর্থ সামাজিক পরিবর্তন, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, এপার বাংলা ওপার বাংলার অদল বদল। সে সংস্কৃতির হোক, খাদ্য অভ্যাসের হোক আর যা কিছুরই হোক আমাদের পূর্বপুরুষেরা একটা ব্যাপার বুঝলেন, কাজ অর্থাৎ সরকারি চাকরি পেতে হবে। আর তাই পুরুষানুক্রমে তৈরী হতে থাকলো কেরানির ছেলে কেরানি মাষ্টারের ছেলে মাস্টার। তবে এর ব্যতিক্রম যে ছিল না তা নয়। পুলিশ আর্মিতে বেশিরভাগই গ্রাম থেকে শারীরিকভাবে সক্ষম প্রার্থীরাই অগ্রাধিকার পেতেন। রইল বাকি ডাক্তার আর ইঞ্জিনিয়ার, এঁরা উচ্চ মেধার সঙ্গে সঙ্গে আর্থিক জোরের কারণেও পড়ার অধিকার পেলেন।
তাহলে সরকারি চাকরির জন্য রইল আর কী কী? ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার পুলিশ আর্মি অধ্যাপক আর স্কুল টিচার। বাকিদের কথা আমি বলছি না তারা ব্যতিক্রম ধরেই এগোই, তাতে আমাদের আলোচনার সুবিধা। একটা ভীষণ প্রিয় আর সত্যি কথা হল, বাকি সব পেশার লোকদের তৈরী করে দেন, স্বপ্নটা বুনে দেন কিন্তু শিক্ষক মহাশয়রা। অনেক দামি বই কিনতে গিয়েও মূল্যের ক্ষেত্রে 'মাত্র' শব্দটি ব্যবহৃত হয়। এই 'মাত্রটুকু শিক্ষা' শিক্ষক মহাশয়রা বিনিময় করেন। পৃথিবীর কোনও দেশ কখনোই শিক্ষকদের প্রাপ্য বেতনটুকু দিতে পারেন নি। কারণ এই পেশার বেতন হয় না। সাধে কি আর একলব্যকে বুড়ো আঙুল কেটে দক্ষিণা দিতে হয়েছিল?
সমাজ সব ধরনের সব পেশার মানুষ নিয়ে গঠিত। প্রায় সবাইকেই পরিশ্রম করেই তার জন্য নির্ধারিত প্রাপ্যটুকু আদায় করতে হয় মাস শেষে। তফাৎ কেউ শারীরিকভাবে পরিশ্রম করেন, কেউ মানসিকভাবে। শারীরিক পরিশ্রম চোখে দেখা যায়, মানসিক শ্রম দেখা যায় না। যে ছেলেটা দশ বছর কঠোর পরিশ্রম করে কলেজে অথবা স্কুলে শিক্ষকতার চাকরিটা জোগাড় করলেন সদ্য, তার দশ বছরের কষ্টটা ভাবুন। মনের জানালা ছাড়া আর কিছুই খোলা ছিল না হয়তো। আর আপনি মাত্র পঁচিশ বছর বয়সে যে চাকরিটা পেয়েছেন, প্রথম বেতন পেয়েছেন, পছন্দের খাবার খেয়েছেন, ঘুরতে গিয়েছেন তখন সেই ছেলেটা দুয়ার এঁটে পৃথিবীর বিরুদ্ধে একা লড়ে যাচ্ছিল। লড়তে তাকে এখনও হচ্ছে, সমাজের অন্য সমস্ত পেশার মানুষদের বিরুদ্ধে, বিকৃতমনস্ক কিছু সুযোগসন্ধানীর বিরুদ্ধে, পাশের বাড়ির বিরুদ্ধে, মাছ বিক্রেতার বিরুদ্ধে, দোকানদারের বিরুদ্ধে।
কোথাও লেখা হচ্ছে লকডাউনে শিক্ষকদের বেতন অর্ধেক করে সেই টাকা পুলিশ ডাক্তার নার্সদের দেওয়া হোক। কোথাও বলা হচ্ছে-- অন্য কোনও পেশায় লাগিয়ে দেওয়া হোক। বসে বসে বেতন পাচ্ছে। কেন পাবে বসে বসে বেতন?
এবার তাহলে ব্যাপারটা একটু অন্যরকম ভাবে ভাবার চেষ্টা করি। এটা কিন্তু জাস্ট একটা ভাবনা। ধরুন পার্শ্ববর্তী দেশের সাথে যুদ্ধ। আমাদের দেশের তিন শ্রেণির সেনা জওয়ানরা জোর কদমে যুদ্ধ করে শত্রু সৈন্যদের আমাদের সীমানায় ঘেঁষতে দিচ্ছে না। দেশে একপ্রকার জরুরী অবস্থা, দিকে দিকে দলে দলে সৈন্যেরা আহত হচ্ছে, তাদের প্রত্যেকের সুচিকিৎসা হচ্ছে, তাঁরা কেউ ওয়েটিংএ থাকছেন বদলে অন্য কেউ যাচ্ছেন। এই সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটা এত সুশৃঙ্খলভাবে হচ্ছে যে আমরা নাগরিকরা কেউ কিছু বুঝতে পারছি না, পক্ষান্তরে বুঝতে দেওয়া হচ্ছে না। সংবাদপত্রে নিউজ চ্যানেলের উত্তেজনা আমাদের গ্রাস করছে, কিন্তু আমরা একবারও বলছি না আমায় যুদ্ধক্ষেত্রে নিয়ে যাওয়া হোক (অতিরিক্ত আবেগপ্রবণ দেশপ্রেমিকদের কথা এখানে হচ্ছে না) ঠিক যেমন ভারত পর পর কোনও ক্রিকেট ম্যাচ হেরে গেলে আমরা মাঠে নেমে খেলার দাবী জানাই না। বুদ্ধিমান ব্যক্তিমাত্রই জানি যে, যার যেটা কাজ তাকেই সেই কাজটা মানায়। সেই কাজের জন্য সে অভিজ্ঞ। সেই কাজের জন্যই রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে তাকে নেওয়া হয়েছে। তার পেছনে প্রচুর খরচ করে তাকে ট্রেইন্ড করেছে এবং সর্বোপরি তার কাজটা সুষ্ঠভাবে সম্পন্ন করবার জন্য যথেষ্ট রকমভাবে সহযোগিতা করেছে। সেটা যুদ্ধের ক্ষেত্রে অস্ত্রসহ যাবতীয় সরঞ্জামই হোক আর ক্রিকেটের ক্ষেত্রে সহযোদ্ধা বা উন্নত কোচিংসহ যাবতীয় সুবিধা। তখন কি বাকি জীবিকার লোকেরা খোল করতাল নিয়ে যুদ্ধে যেতে চাইতেন? আমার বিশ্বাস বসে বসে বেতনটা অন্তত নিতেন না। তাই না?
ভাবনাই যখন তখন আরেকটু উল্টো করেই ভেবে দেখি আসুন। সময় যখন আছেই আপত্তি আর কীসের। ধরুন, হ্যাঁ আবার ধরুন, যে এই পুরো প্যানডেমিকটা শুরু থেকে তো আর প্যানডেমিক ছিলো না। আস্তে আস্তে হলো। মানে আস্তে আস্তে হতে দেবার পর হু নামক বলশালী এবং অবশ্যই নিরপেক্ষ সেই সংগঠন ঘোষণা করলেন লকডাউন নয়, এর একমাত্র প্রতিষেধক টিকা। আমাদের কাছে সমস্ত বিশ্ববাসীকে দেবার মত টিকা মজুত কিন্তু সেই টিকাপ্রদান শুরু হবে পাঁচ থেকে কুড়ি বছর বয়সী বাচ্চাদের দিয়ে। এবার বাচ্চাদের বেশিরভাগ অংশই যেহেতু বিদ্যালয়ে আর কলেজে যায় তাহলে কয়েকজন স্বাস্হ্যকর্মীর সাহায্যে সেই টিকা প্রদানের ব্যাপারটি পরিচালনা করবেন শিক্ষক মহাশয় এবং অধ্যাপকরা। লকডাউন নেই পুলিশ নেই ডাক্তারদের নার্সদের একটা বৃহৎ অংশ তখনও এই প্রকল্পে যুক্ত হন নি। এবার কি সেই শিক্ষকরা বেতনের বেশি পারিশ্রমিক দাবি করবেন বলে আপনার মনে হয়? কখনোই নয়। আমি নিশ্চিত কোনও পুলিশকর্মী কোনও স্বাস্হ্যকর্মী এমনকী অন্যান্য যারা এই মহামারির সময় বিভিন্নভাবে সেবা করে চলেছেন তারা কেউই এই ধরনের দাবী করবেন না।
যারা বেতনভুক্ত কর্মচারী (অবশ্যই সরকারি) তাদের মাস শেষের একটা খাতা থাকে আর মাস শুরুর একটা খাতা থাকে। শেষের খাতায় লোনের ইএমআই, গ্রসারি, ফুয়েল, দৈনিক খরচ, বাজার, মাছ মাংস, বন্ধু স্বজন, এক আধদিন বাইরে খাওয়া আইসক্রিম এগুলোর হিসেব, আর শুরুর খাতায় স্বপ্নদের। ফ্ল্যাটটা পাল্টে একটা বড়ো সড়ো থ্রি বি-এইচকে, একটা হ্যাচব্যাক, একটা ইউরোপ ট্যুর নিদেনপক্ষে ব্যাংকক ফুকেট। কিন্তু কিছুই হয় না. মাস শেষে টান পড়ে আর টিপ্পনি তো উপরি পাওনা।
তবে শান্তিও আছে, যে যাই বলুক ওটা আছে বলেই এই দুঃসময়েও কিছুক্ষণের জন্য হলেও ঘুমটা হয়। কোথাও এক বস্তা চাল, কোথাও এক মাসের রেশন, কোথাও নামমাত্র ওষুধ খরচ, কোথাও ইলেকট্রিক বিল, কোথাও টিভি বা মোবাইল রিচার্জ অক্সিজেনের যোগান দেয় বুকের কোণে। আত্মশ্লাঘা নয় ওঁরা যেভাবে আব্দারটা জানায় তাতে কোনও সংকোচ থাকে না, রাতে আমার আলুভাতে চোখ চিক চিক করে তোলে।
পরিশেষে সেই আবার সমাজ। সমাজে প্রত্যেকের কাজ নির্দিষ্ট করা আছে। সবাই সবার কাজটাকে ঠিকমতো পালন করতে পারবে তখনই যখন একজন ভালো গোষ্ঠিপতি (মানে আধুনিক রাষ্ট্র নেতা আর কী) নিরপেক্ষ এবং রাজনৈতিক মতাদর্শের উপরে উঠে নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে দিয়ে নির্দিষ্ট কাজটি করাতে পারবেন। এখন অবশ্য ফ্রয়েড আছে ইগোও আছে। কতটা সফলতা আসে সেটাই দেখার।
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team