সমাজ মাধ্যম থেকে শুরু করে বিভিন্ন জায়গায় ইতিমধ্যেই তাদেরকে নিয়ে ট্রোল, মিম ইত্যাদি শুরু হয়ে গেছে। অকপটে তাদের দাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে কোভিড ব্যাচ বলে! চলছে মশকরা, ঠাট্টা, তামাশা। কিন্তু আমাদের এই তরলতা যে আখেরে আমাদের সন্তানদের ক্ষতি ডেকে আনছে, তা আমরা আদৌ বুঝতে পারছি না।
দীর্ঘদিন ধরেই আমাদের বাঙালি সমাজে মাধ্যমিক পরীক্ষা রীতিমত একটি উৎসব। এই পরীক্ষা ঘিরে পরীক্ষার্থী থেকে শুরু করে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে যে উৎসাহ চোখে পড়ে, সেরকম ব্যাপার আমাদের দেশের আর কোনও রাজ্যে হয় বলে আমার জানা নেই। শুধু পরীক্ষার দিনগুলিই নয়, পরীক্ষার ফল প্রকাশ অবধি এই উৎসাহ কমবেশি সবার মধ্যেই নজরে পড়ে। ফল প্রকাশের পর কৃতি ছাত্রদের ঘিরে যে উন্মাদনা আমরা লক্ষ্য করি তাও কোনও অংশে কম নয়।
অন্যদিকে উচ্চ মাধ্যমিক হল ছাত্রদের পরবর্তী জীবনকে গড়ে তোলার পরীক্ষা। এই পরীক্ষা ঘিরে মাধ্যমিকের তুলনায় অন্যদের উৎসাহ খানিকটা কম হলেও, ছাত্রদের নিজেদের কাছে এর গুরুত্ব অনেক বেশি। কেননা এই পরীক্ষার ফলের ওপর নির্ভর করে থাকে আগামীদিনের জীবন।
এই দুই পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে ছাত্রদের অনেক কিছু নির্ভর করে বলে, লক্ষ লক্ষ ছাত্র অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে পরীক্ষা দেওয়ার। তাদের সঙ্গে অপেক্ষায় থাকেন অগুনতি অভিভাবকও। এইরকম অবস্থায় পরীক্ষা না হওয়া মানে শুধু স্বপ্নভঙ্গ নয়, জীবন সম্পর্কেই অনিশ্চয়তা তৈরি হওয়া, যার অভিঘাত অত্যন্ত তীব্র! সেই তীব্রতায় ইতিমধ্যে একজন ছাত্রী আত্মহত্যা করেছে বলে মনে করা হচ্ছে। ভাল ফল করবার প্রত্যাশী সেই কিশোরী দিশেহারা হয়ে আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছে বলে পরিবার সূত্রে দাবি। আমাদের কপাল ভাল যে, এরকম আরও খবর আমরা পাইনি। পেলেও বিস্ময়ের কিছু ছিল না। এই টালমাটাল অবস্থায় যেখানে প্রতিটি মুহূর্ত অনিশ্চিত, সেখানে পরীক্ষা না হওয়ার যন্ত্রনা একমাত্র তারাই বুঝতে পারবে, যারা এই অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। আমরা অনুমান করতে পারি মাত্র। কিন্তু তারপরেও আমাদের হাসি ঠাট্টা থামছে না। আর সেটাই অনেক বেশি চাপ সৃষ্টি করছে এবারের পরীক্ষার্থীদের ওপর। নিজেদেরকে অপরাধী ভাবতে শুরু করেছে তারা!
আসলে আমরা যেন ধরেই নিয়েছি যে, এরা পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনার মতো সব কিছু পেয়ে গেল! মূল্যায়নহীন হয়ে উত্তীর্ন হওয়ায় এরা কিছুই জানল না, শিখল না। আমাদের এই ধারণাটা সম্পূর্ণ ভুল বলে ব্যক্তিগতভাবে আমার বিশ্বাস। কেননা আমাদের এই সন্তানেরা কোনও কিছুই শেখে নি, এটা কখনই হতে পারে না। এবারের পরীক্ষার্থীদের জন্য আমাদের অভিভাবক ও শিক্ষকরা কিছুই করতে পারেন নি ভাবাটা অতি সরলীকরণ হয়ে যাচ্ছে। এই দুই পরীক্ষা নিয়ে আমাদের বাঙালি সমাজ যত সচেতন তাতে কোনও পরিবারে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী থাকলে তাকে আলাদাভাবে দেখা হয়। পরিবারের প্রত্যেকটি সদস্য নিজেদের মতো তাদের সাহায্যের চেষ্টা করেন। নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, এবারেও সেটা হয়েছিল। অনলাইন ক্লাসের ফলে বা ব্যক্তিগত উদ্যোগেও পরীক্ষার্থীরা যথেষ্ট প্রস্তুতি সেরে ফেলেছিল। খামতি রয়ে গেল শুধুমাত্র মূল্যায়নে। কিন্তু সেটাই শেষ কথা নয়। বিশেষ করে এই মহামারী পরিস্থিতিতে যেখানে প্রাণ নিয়ে টানাটানি চলছে, সেখানে পরীক্ষা বাতিলের সিদ্ধান্তকে মেনে না নেওয়া ছাড়া উপায়ও নেই।
নিঃসন্দেহে এই মতের বিরুদ্ধে অনেক যুক্তি দেওয়া যায়। পরীক্ষা নেওয়ার স্বপক্ষেও বলা যায় অনেক কথা। কিন্তু বিতর্কে না ঢুকে বলি যে, সিদ্ধান্ত যেটাই হত, তা নিয়ে পক্ষে বিপক্ষে নানা কথা হত। একেবারে সঠিক সমাধান, সোনার পাথরবাটির মতোই একটি অলীক বস্তু। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় বোর্ডের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়েও এই মুহূর্তে এছাড়া হয়ত আর কোনও উপায় ছিল না। পাশাপাশি এটাও মনে রাখতে হবে যে, আমাদের পরীক্ষার্থীদের কারোরই এখনও টিকাকরণ হয় নি। তাই কোনও অঘটন ঘটলে কিন্তু আমরা নিজেদের ক্ষমা করতে পারতাম না।
কিন্তু যেভাবে আমাদের সন্তানদের নিয়ে ঠাট্টা তামাশা চলছে তাতে সত্যি ভয় হচ্ছে যে, এই মজা করা শেষটায় না বুমেরাং হয়ে যায়। নিজেদের মনোরঞ্জন করতে গিয়ে আমরা আরও বিপদ ডেকে আনছি না তো? এই মুহূর্তে পিছনে না তাকিয়ে পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝে আমাদের উচিত আমাদের ছাত্রদের পাশে দাঁড়ানো। তাদেরকে মানসিক সাহস দেওয়া। প্রতিটি মুহূর্তে তাদের বোঝানো যে, সমগ্র জীবনের পরিপ্রেক্ষিতে একটি বছর বা একটি পরীক্ষা আদৌ কোনও গুরুত্ব রাখে না। জীবনের পরীক্ষা বরং অনেক বেশি কঠিন। আর সেই পরীক্ষা জেতাই হল আমাদের কাজ। বৃহত্তর জীবনে সাফল্য পেতে সাময়িকভাবে যদি কোনও কিছু থেকে বাদ পড়তে হয় বা কোনও কিছুকে বাদ দিতে হয়, তাতে কিছুই এসে যায় না। এই মুহূর্তে অতিমারীর হাত থেকে বেঁচে থাকাটাই আমাদের সবচেয়ে বড় সাফল্য। আর সেই সাফল্য অর্জনে একটি পরীক্ষা বাতিল হওয়া দীর্ঘ জীবনের ক্ষেত্রে কিছুই না। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আমরা আবারও ফিরে যেতে পারব আগের জীবনে। হ্যাঁ, যা চলে গেল তা আর ফিরে আসবে না ঠিকই, কিন্তু তাই বলে ভেঙে পড়বারও কিছু নেই। বরং নতুন অবস্থার সঙ্গে খাপ খাইয়ে, এগিয়ে যাওয়াটা অনেক বেশি জরুরি।
আর যারা ট্রোল, মিম করছেন তাদের কাছে আবেদন যে, আপনারা এমন কিছু করুন যাতে আমাদের সন্তানেরা সদর্থক ভাবতে শেখে, উৎসাহিত হয়। অনুগ্রহ করে এমন কিছু করবেন না, যাতে ওরা আরও ভেঙে পড়ে। এই দুঃসময়ে ওদেরকে ঠিক রাখাটা আমাদের সবচেয়ে বড় কর্তব্য, কেননা ওরাই আগামীর নাগরিক। ওরাই দেশের ভবিষ্যত।
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team