ঘরের বিষয়ে বলার আগে কুলুজি জানিয়ে রাখি। ভয় হয় বংশপরিচয় জানলে যদি নাম জানতে ইচ্ছে না হয়। নাম - ডাহুক। অনেকে আদর করে ডাকে – সাদা বুক জলমুর্গি। গোত্র- গ্রুইফরমেস (Gruiformes), পরিবার - রেলিডি (Rallidae), গণ - আমুরর্নিস (Amaurornis) । যে নামে সার পৃথিবী চেনে তা হলো - আমুরর্নিস ফোইনিকুরুস (Amaurornis phoenicurus) । পৃথিবীর একটা বৃহৎ অংশে ন্যুনতম বিপদগ্রস্ত হলেও মানুষের শহরে ডাহুকের ঘরবাড়ি খুব বিপদগ্রস্ত।
পিঠ কালচে, মুখমণ্ডল-গলা-বুক সাদা; একদম সাদা। থাকা হয় জলা জায়গায়। খাদ্য দাড়কিনা মাছের মতো ছোট ছোট মাছ, ছোট জলজ পোকা, পতঙ্গ, নানা ধরণের বীজ। আগে শহরে জলা জমিতে ডাহুকের আনাগোনা ছিল। সকাল সন্ধ্যায় ডাহুকের ভাঙ্গা গলার ক্রোয়াক ক্রোয়াক ডাক ছিল বর্ষার আগমনী গান। এখন শহরে ডাহুক প্রায় দেখাই যায় না। শহরের জলাজমিগুলি শুধু ডাহুকের ঘর ছিল না, এইগুলো ছিল মানুষের কষ্টের অণু জীবাণুর গারদ আর পৃথিবীর জল পান করার মুখ।
শহরে ডাহুকের জল-ঘর আস্তে আস্তে কমে যাচ্ছে পরিকল্পনা মাফিক। চক্রান্তকারীরা পিঁপড়ের মতো আস্তে আস্তে জলার চার দিক তিন দিক দুই দিক বা একদিক যখন যেমন সুযোগ পায় সেই ভাবে ঘরটা ছোট করতে থাকে। জলাজমি পরিবর্তিত হয় ঝোপ ঝাড়ে ভরা নিচু জমিতে। সেই ঝোপ ঝাড়ে জল ছাড়া আত্মগোপন করে বেঁচে থাকে জলমুর্গি। আগে যার ডাকে বর্ষা আসতো সে অপেক্ষা করে থাকে কখন বর্ষা আসবে। জল জমবে ঝোপ ঝাড়ে ভরা নিচু জমিতে।
বর্ষায় জল জমে নিচু জমি আবার জলা হয়ে যায়। যা ছিল ডাহুকের স্থায়ী ঘর সেটাই আবার ফিরে আসে ক্যাম্প হয়ে। সেটাই বা কম কীসের। ডাহুক আবার জোড় বাঁধে। বর্ষার মেঘের ডাকের ছন্দে, শৃঙ্গারে নেচে ওঠে; বৃষ্টিতে ভিজে প্রেম করে, সুখী ঘর বানায় ডাল লতাপাতায়। বর্ষা যে ওদেরও প্রজননের সময়। প্রেম-প্রজনন যে বিনোদনের অপর নাম। বন্ধু বান্ধব আত্মীয় স্বজন আসে, হৈ হুল্লোড় শুরু হয়।
বর্ষার জল জমার সাথে সাথে চলে আসে কলমি লতা, শোলা গাছ আরো কত কী আগাছা লতাপাতা। চলে আসে সোনা ব্যাঙের দল, জল পোকা, জল নাচিয়ে, ছোট ছোট মাছ। আকাশ থেকে অবতরণ দূরত্ব মাপতে মাপতে নেমে আসে বালি হাঁস। জলে দাঁড়িয়ে সঙ্কেত দেখায় কোঁচ বক। ডাহুকের এখন ঘর নেই বলে ক্যাম্পে আসেনি ওদের প্রিয় পিসি জলপিপি। সোনা ব্যাঙ কোলা ব্যাঙ কোঁচ বক বালি হাঁসেরা গান গেয়ে ভুলাতে চায় জলপিপি না আসবার কষ্ট। জল নাচিয়েরা নেচে নেচে মন ভোলায় ডাহুকের। ডাহুক ডিম পাড়ে তিনটা। এটাতো ঘর নয়, ক্যাম্পে কি আর সাত আটটা ডিম পাড়া যায়! ডাহুক ডাহুকী দুজনেই ডিম তা দেয় বুকের সব গরম দিয়ে।
কুচক্রীরা জলার পাশে দাঁড়িয়ে জল মাপে। বর্ষা চলে গেলে আবার নামবে জমির জাত পাল্টানোর কাজে - পিঁপড়ের মতো। জলার পাশের গাছের ডালে বসে সব খেয়াল রাখে এক তিলা বাজ। জলেও সব জলের মতো হয় না। কোথায় থেকে এসে পড়ে এক জল ঢোড়া সাপ। এঁকেবেঁকে সাঁতার কাটে জলে। ত্রাহি ত্রাহি রব ওঠে জলে ঝোপে। এই যাত্রায় বাঁচায় তিলে বাজ। বর্ষা চলে যায়, সাথে নিয়ে চলে যায় সব বন্ধু বান্ধব আত্মীয় স্বজন। শহরে মানুষ মেতে উঠে মা দুর্গার পূজায়।
ডাহুক ডাহুকী নিয়ে সন্তান সন্ততি চলে যায় আত্মগোপনে আবার। কিন্তু কেন? যেখানে বসবাস করেছে ডাহুকেরা হাজার হাজার বছর, সেই ঘরে কেন থাকবে না ডাহুকের বংশ পরম্পরা অধিকার? মানুষই তো বানিয়েছে নিয়ম - যে বাস করেছে বংশ পরম্পরা হাজার বছর জমির উপর অধিকার শুধু তার। তাহলে ডাহুকের আর কী দোষ?
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team