রায় বাড়ির বড় ছেলে বাইরে চাকরি করে। শোনা যায় ভোট নামক গণতান্ত্রিক মোচ্ছবে ইভিএম যন্ত্রে বোতাম টিপে নাগরিক কর্তব্য সমাপনের উদ্দেশ্যেই তার জলপাইগুড়িতে আগমন ঘটেছিল। সঙ্গে এসেছিল তার স্ত্রী ও কিশোরী কন্যাটি। তাছাড়া জলপাইগুড়ির বাড়িতে বৃদ্ধা মা ও ছোট ভাই আছে, কতদিন দেখা হয়নি! ডুয়ার্সের গয়েরকাটাতে শ্বশুরবাড়ি তাদের কাছেও যাবার কথা ছিল। তার আগেই বড়ছেলে তার শরীরে উপসর্গ দেখা দিতেই টেষ্ট করিয়ে কোভিড পজিটিভ হলো। ছেলেটির অসুস্থতার মাত্রা বাড়তেই কোভিড হাসপাতালে যেতে হল। মেয়েটিকে এক আত্মীয়ের বাড়িতে সরিয়ে দেওয়া হল। বাড়িতে তখন তার মা, ছোট ভাই ও তার স্ত্রী।
সেদিন হঠাৎ সকালে দেখেছিলাম আমাদের পাড়ার পূজা কমিটির গ্রুপ হোয়াটস অ্যাপে দলের কেউ একজন লিখেছে “একজনকে হাসপাতালে নিতে হবে। একটা অ্যাম্বুলেন্স জোগাড় করে দিতে হবে”। খানিকটা পরে আমি লিখেছিলাম “অ্যাম্বুলেন্স পাওয়া গেল?” একজন উত্তর দিয়েছিল “ছেলেটি মারা গেল। কিছুই করা গেল না”। হতভম্ব হয়ে গেলাম। যন্ত্রণায় বিদ্ধ হয়ে ছিলাম। পরে শুনলাম ছেলেটি সেই রায় বাড়ির ছোট ছেলে। বাড়িতে তখন ছেলেটির মা শ্বাসকষ্টে ভয়ানক কাতর।
জলপাইগুড়ি মিউনিসিপ্যালটির কর্ণধার আমাদের পাড়ার বধূ ও সহনাগরিক পাপিয়া পাল, মেয়েটির মরমী মন মানবিক গুনাবলীর আধার। মৃত্যুর খবর পেয়েই মিউনিসিপ্যালটি ব্যবস্থা নিয়েছিল। মাকে হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা হয়েছিল। র্যাপিড টেষ্টে ‘নেগেটিভ’ এলো। উনি সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালে ভর্তি হলেন। ছোট ছেলের মৃতদেহ বিকেলে মিউনিসিপ্যালিটির উদ্যোগ নিয়ে হাসপাতালে পাঠিয়েছিল টেষ্টে তারও ‘নেগেটিভ’ এলো। ছোট ছেলেটির মৃতদেহ মর্গে পাঠানো হয়েছিল। বড় ছেলে উন্নত চিকিৎসার জন্য শিলিগুড়িতে একটা নার্সিং হোমে ভর্তি হয়েছিল। সে জানত না পরিবারের সঙ্কটের কথা। গোটা পরিবারটি ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। রায় বাড়ির বৌ তখন বাড়িতে একা।
অন্যদিকে পাড়ার তরুণরা তখন ঘাবড়ে ছিল তাদের দলপতিকে কোভিডের সঙ্গে লড়তে দেখে। প্রথমে জলপাইগুড়ি ও পরে শিলিগুড়িতে তার চিকিৎসা চলেছিল। অসংখ্য মানুষের ভালবাসা তাকে মৃত্যুর হাত থেকে ছিনিয়ে আনতে পারেনি। ছেলেটিই তো দুর্গা পূজার উদ্যোক্তা, রক্তদান শিবিরের আয়োজক, বস্ত্রদানে উৎসাহের কেন্দ্রে। আচমকা এমন একটা আঘাতে তরুণদের মানসিক স্থিতি নড়ে গিয়েছিল। অন্য দুজন সহযোদ্ধার একজন নিজে ও পরিবার আক্রান্ত ছিল, অন্যজনের স্ত্রী আক্রান্ত। একটা গভীর শূন্যতা তৈরী হয়েছে। তবে এরমধ্যেই দু-চার জন দ্বার ঠেলে বেরিয়ে এসেছে।
পরদিন সকালে পাড়ার এক ভাই-এর সঙ্গে রায় বাড়িতে যাই। বউটি রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্রতিবেশীর দেওয়া খাবার খাচ্ছিল। দূর থেকে দু-একটা কথা বলে চলে আসি, কথা বলার মত অবস্থা ছিল না। ওখানেই খবর পেলাম হাসপাতালেই রায় বাড়ির মা অর্থাৎ তার শ্বাশুড়িও মারা গিয়েছেন। মিউনিসিপ্যাল কর্তৃপক্ষের সাহায্যে সেদিন মায়ের সৎকার হয়েছিল, মুখাগ্নি করেছিল পুত্রবধূটিই। পরদিন মর্গ থেকে ছোট ছেলের মৃতদেহ পেতে দুপুর হয়েছিল, এবারও সৎকারের ব্যবস্থা করেছিল মিউনিসিপ্যালটি। মুখাগ্নি করেছিলেন বাড়ির সেই বৌটিই। সে সকালে গয়েরকাটার বাড়ি থেকে এসে পরপর দুদিন দুটি দাহকার্য সম্পন্ন করে স্বামীকে শিলিগুড়িতে দেখে রাতে ফিরে যায় ৮৫ কিমি দূরে গয়েরকাটায়। শ্মশানের কাজটুকু সামলে দেবার জন্য ওদের এক আত্মীয়ের সঙ্গে অনেকক্ষন কথা বলেছিলাম, ফল হয়নি।
বউটিকে নিয়মিত শিলিগুড়ি যেতে হয়েছিল স্বামীকে দেখতে। তার অসুস্থ স্বামী বারবার দাবি করেছিল ভিডিও-তে মা ও ভাই এর সঙ্গে কথা বলতে। অবশেষে একদিন অসুস্থ স্বামীকে সে জানাল তার মায়ের মৃত্যুর কথা, স্বামী অঝোরে কেঁদেছিল। দুদিন পর নার্সিং হোমে শয্যাশায়ী স্বামীকে তার ছোট ভাইটির মৃত্যুসংবাদ দিয়ে অনুভব করেছে স্বামীর সীমাহীন যন্ত্রনা। একদিন বউটি তার শাশুড়ির পারলৌকিক কাজ স্থানীয় এক মন্দিরে শেষ করে জনশূন্য বাড়িটায় ফিরে এসেছিল। দাদা ফিরে এলে পর ভাইটির ক্রিয়াকর্ম করবে। প্রতিবেশীরা তখন অনেকটাই কাছে এগিয়ে এসেছে। বউ বা মেয়েটির অসীম মনের জোর ও পারিবারিক দায়িত্ববোধের এ কাহিনী কোভিডের সঙ্গে লড়াইতে এক বিরল দৃষ্টান্ত রেখে দিল, কুন্ঠাহীন নমস্কার তার প্রাপ্য। অবশেষে রায় বাড়ির বড় ছেলে সুস্থ হয়ে শ্বশুরবাড়িতে ফিরে এসেছে।
জীবনের অপরাহ্নে এসে কোভিডের দিনগুলি মানুষের যাওয়ার খবরে বুকে এমনিই চাপ চাপ ব্যথা জাগে। এই সেদিন সন্ধ্যায় ফোন এল। পুত্রবৎ এক অধ্যাপক ফোনে বলেছিল “আমাদের ঘনিষ্ট প্রতিবেশী একটি মেয়ে অসুস্থ হয়ে অজ্ঞান হয়ে গেছে। একটা অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করে দাও”। আমি ‘গ্রীন জলপাইগুড়ি’-র অঙ্কুরকে ফোন করে জানাই। সে অ্যাম্বুলেন্স অক্সিজেন ও অন্যান্য জরুরি কিটস নিয়ে ছুটে আসে। মেয়েটি বাঁচেনি। মাঝে মধ্যেই মনে হয় একদিন আমরা সবাই বোধ হয় স্বজন হারানোর ব্যথায় ব্যথায় নীল হয়ে যাব।
কিন্তু তবু আশা জাগিয়ে রাখে তরুণ প্রজন্ম। ইতিমধ্যে পাড়ার তরুণ ব্রিগেড হারানোর ব্যথা ভুলে মনোবল বাড়িয়ে নিয়ে এগিয়ে এসেছে। কদমতলা দুর্গাবাড়ির সদস্যরা সাহস করে প্রশ্ন তুলল, “আমাদের নিজেদের কেন আপৎকালীন পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার মত অক্সিজেন পরিষেবা থাকবে না?”। অক্সিজেন সিলিন্ডার জোগাড় করাটাও কঠিন ছিল। কদমতলা দুর্গাবাড়ির সবাই মিলে ‘গ্রীন জলপাইগুড়ি’-র সম্পাদক ও টিমের সঙ্গে আলোচনা করে ফ্রী পরিষেবার জন্য একটা টোটো অ্যাম্বুলেন্স দ্রুত চালু করে ফেলল।
একজন প্রশিক্ষিত নার্স, সঙ্গে অক্সিজেন সিলিন্ডার, অক্সিমিটার, রক্তচাপ মাপার যন্ত্র ও অন্যান্য সামগ্রী সঙ্গে নিয়ে আমাদের টোটো অ্যাম্বুলেন্স ডাক পেলেই পৌছে যাচ্ছে অলিতে গলিতে রোগীর পাশে, প্রয়োজনে রোগীকে পৌছে দিচ্ছে হাসপাতালে। ওরা চালু করেছে একটি পেট্রল চালিত আধুনিক অ্যাম্বুলেন্সও। দুর্গাবাড়ির ছেলেরা এখন ভাবছে নিজস্ব অ্যাম্বুলেন্স ও অক্সিজেন কনসেনট্রেটার নিয়ে আসবার। সহ-নাগরিকবৃন্দ পাশে থাকলে এসব চালু করা শুধু সময়ের অপেক্ষা।
আসলে এসব কিছুর মূলেই প্রেরণা ছিল রায়বাড়ির সেই তরুণী গৃহবধূটি, যিনি পরিবারের চূড়ান্ত বিপদের দিনে তাঁর শাশুড়ি ও দেওরের মৃতদেহ সৎকার করে অসুস্থ স্বামীকে দেখে বাড়ি ফিরতেন, যিনি অদম্য সাহসে নিজের জীবন তুচ্ছ করে দাঁড়িয়ে থেকেছেন তাঁর বিপন্ন পরিবারের পাশে, যার শুশ্রূষায় সুস্থ হয়ে উঠছেন তাঁর কোভিড যোদ্ধা স্বামী। তাকে কুর্নিশ জানিয়ে কবিপক্ষে স্মরনে এসেছিল অমোঘ এই পংক্তি--
নৈরাশ্য কভু না জানে/বিপত্তি কিছু না মানে,
অপূর্ব অমৃত-পানে অনন্ত নবীন।
নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা আজ শয়ে শয়ে হাজারে হাজারে যেভাবে এই মারণ ভাইরাসের সঙ্গে মোকাবিলায় পথে নেমেছে, তা আমাদের মত বুড়ো ফুসফুসে বাড়তি অক্সিজেন জোগায়। ওদের হয়েই বলতে ইচ্ছে করে, ভরসা রাখুন ভোর আসবেই।
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team