পঞ্চাশ বছর আগে রাজধানী কলকাতার সঙ্গে উত্তরবঙ্গের ভৌগোলিক এবং মানসিক দূরত্ব ছিল বিস্তর। কয়লার ইঞ্জিনের জনতা এক্সপ্রেস ও কামরূপ এক্সপ্রেসে চেপে ১৮-২০ ঘণ্টার রেলযাত্রাই ছিল রাজধানীর সাথে কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার, ফালাকাটার মত অঞ্চলের যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম। একদিনের বাসি সংবাদপত্র পড়তে বাধ্য হতাম আমরা। আর সংবাদপত্রে আমাদের এলাকার খবর কালেভদ্রে বেরোলে সেটাই হত আড্ডার একমাত্র চর্চা। দক্ষিণবঙ্গের উন্নতনাসা মানুষেরা একরাশ অবজ্ঞা নিয়েই জরিপ করতেন উত্তরের প্রান্তবাসী সহজ সরল মানুষদের। তরাই - ডুয়ার্সের সহজিয়া "মানষিগুলান " এই আহত অভিমান বুকে চেপেই বজায় রেখেছিল নিজস্ব কৃষ্টি-সংস্কৃতির অহংকার।
তারপর তিস্তা - তোর্সা দিয়ে অনেক জল প্রবাহিত হয়েছে। স্রোতে ভেসে এসেছে গঙ্গার ওপারের সংস্কৃতি। অন্তর্জালের দৌলতে আমরা জেনেছি উন্নয়নের হাঁড়ির খবর। ছিটেফোঁটা ভাগ আমরাও পেয়েছি। কিন্তু উত্তরের প্রান্তবাসী মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রামে "নেই" -এর তালিকাটা এতই দীর্ঘ যে ২০২১-এর নির্বাচনী উত্তাপেও এই অভিমানের জমাট বরফ গলার কোন লক্ষণ নেই। নীল বাড়ির লড়াইয়ে উত্তরবঙ্গ থেকে ৫৪ টা আসন বরাদ্দ হলেও মন্ত্রীসভায় গুরুত্বপূর্ণ নীতি নির্দ্ধারনে উত্তরবঙ্গের কন্ঠস্বর শোনাই যায় না।
সমগ্র উত্তরবঙ্গকে ঘিরে পর্যটন শিল্পের অযুত সম্ভাবনা আছে, তা কিন্তু সরকারি আনুকূল্য থেকে অনেকটাই বঞ্চিত তখনোও ছিল, এখনো আছে। লাটাগুড়ি, গরুমারাকে কেন্দ্র করে যে পর্যটন শিল্প ডুয়ার্স জুড়ে গড়ে উঠেছে, তার বেশির ভাগটাই নিজস্ব ব্যবসায়িক উদ্যোগে। সরকারি উদ্যোগ কোথায়? চা বাগান আর পর্যটনকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয় তরাই ডুয়ার্সের অর্থনীতি এবং গ্রামীণ কর্মসংস্থান। লকডাউনের সময় আমরা দেখেছি একের পর এক ব্যক্তিগত পুঁজির রিসর্ট বন্ধ হয়ে যাচ্ছে আর এগুলিকে কেন্দ্র করে ব্যাপক মানুষের কর্মসংস্থান সংকুচিত হতে হতে এদেরকে পথে বসিয়ে দিয়েছিল। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আবার এই মানুষগুলোর মাথায় দুশ্চিন্তার কালো মেঘের সঞ্চার ঘটাচ্ছে।
কলকাতা থেকে আসা পর্যটকেরা চিলাপাতা, কোচবিহার রাজবাড়ী দেখেই ফিরে যান। কিন্তু কতজন জানেন যে কোচবিহার শহর থেকে তিরিশ কিলোমিটার দূরেই অবস্থান করছে একদা কামতা রাজ্যের রাজধানী গোসানীমারী এবং সেখানে রাজপাটের মাটির নীচে পাল-সেন যুগের অসংখ্য মহামূল্যবান প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শণ অনাদরে, অবহেলায় নষ্ট হচ্ছে। আজ থেকে দশ-বারো বছর আগে কেন্দ্রীয় সরকারের আর্কেওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া খনন কাজ শুরু করে। মাটির নীচে আবিষ্কৃত হয় বেশ কিছু পাথরের মূর্তি, একটি প্রাসাদপ্রাচীর এবং কূঁয়ো। তারপর হঠাৎ করেই খনন কাজ বন্ধ হয়ে যায়। আজ পর্যন্ত সেই খননকাজ শুরু হয় নি। পাথরের মূর্তিগুলি বহুকাল অরক্ষিত অবস্থায় রাজপাটে পড়ে ছিল। তারপর একটি ঘরে তাদের আশ্রয় জুটেছে বটে, কিন্তু সেটাও চূড়ান্ত অবহেলায় এবং সংরক্ষনের নূন্যতম শর্ত প্রয়োগ না করে। যে কোন ইতিহাস গবেষক বা ইতিহাস অনুরাগীর কাছে গোসানীমারী হতে পারতো স্বর্ণখনির প্রবেশদ্বার। কিন্তু সরকারী ঔদাসীন্য এ পথের অন্তরায়। পর্যটন বিকাশের প্রভূত সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও গোসানীমারী দুয়োরাণী হয়েই পড়ে রইল রাজ অন্তঃপুরের এক অন্ধকার কোনে। একই কথা বলা যায় দক্ষিণ দিনাজপুরের পুর্ণভবা নদীর তীরে অবস্থিত বাণগড় সম্পর্কে। গঙ্গারামপুর শহরের এক প্রান্তে ঐতিহাসিক বাণগড় প্রাচীন মৌর্য ও গুপ্তযুগের স্থাপত্যচিহ্ন শরীরে বহন করছে। তিরিশের দশকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বাণগড়ের খননকার্য শুরু হয় এবং পাওয়া যায় অমূল্য প্রত্নতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক নিদর্শণ। আজ বাণগড়ের জমি দখল হয়ে যাচ্ছে, ধ্বংসাবশেষের ইঁট খুলে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু দেখবার কেউ নেই। সরকারের উপযুক্ত পৃষ্ঠপোষকতা পেলে গোসানীমারী ও বাণগড় উত্তরবঙ্গে ইতিহাস পর্যটনের নতুন দিগন্ত খুলে দিতে পারত।
উত্তরবঙ্গের চা শিল্পের সঙ্কট, একের পর এক চা বাগান বন্ধ হয়ে যাওয়া, শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি লুট করা - এগুলো এখন সর্বজনবিদিত। ন্যূন্যতম মজুরি ও অন্যান্য দাবিতে গড়ে ওঠা চা শ্রমিকদের আন্দোলন নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ভাবছেন এমনটা শোনা যাচ্ছে। আন্দোলনরত শ্রমিক সংগঠনগুলোর সঙ্গে সরকারের একাধিক বৈঠক হয়েছে এ ব্যাপারে। কিন্তু সংকট তো কাটেইনি, উল্টে আরো ঘনীভূত হয়েছে। গত ১০ বছরে ট্রেড ইউনিয়নের উদ্যোগে কিছু বন্ধ বাগান খুলেছে। কিন্তু বৃহৎ পুঁজির যোগানের অভাবে চা-শ্রমিকদের সেই জীবন বাঁচানোর উদ্যোগ অনতিবিলম্বেই মুখ থুবরে পড়েছে। রাজ্য সরকারের "Financial Assistance for Workers of Locked Out Industries" প্রকল্পে বন্ধ বাগান শ্রমিকরা ভাতা পাচ্ছেন, বিভিন্ন অ-সরকারি সংস্থার পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে বন্ধ বাগানের শ্রমিকদের জন্য খাদ্য ওষুধ ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য দেওয়া হয়েছে বা হচ্ছে। কিন্তু শুধুমাত্র ত্রাণ দিয়ে বা বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা দিয়ে একটি উৎপাদনশীল শিল্পকে যে বাঁচিয়ে রাখা যায় না, চা বাগানকে বাঁচাতে হলে যে উৎপাদনশীল শিল্প হিসাবেই বাঁচাতে হবে, চা বাগান বাঁচবে লগ্নি, উৎপাদন, মজুরি, মুনাফা, বিক্রি, শ্রমিক-মালিক সুসম্পর্কের উপর - একথা সরকার কবে বুঝবে! চাহিদা থাকলে, চা উৎপাদন লাভজনক হলে, রপ্তানির পরিমাণ হ্রাস না পেলে সংকট কোথায়? এই প্রশ্নের গভীরে গিয়ে কেন্দ্র ও রাজ্য উভয় সরকারকেই সমস্যা দূর করার প্রচেষ্টা করতে হবে। আর তা না হলে বন্ধ চা-বাগানে অনাহারে-অর্ধাহারে শ্রমিকদের মৃত্যু-মিছিল চলতেই থাকবে, আর পর্যটকরা এসে উত্তরবঙ্গের নয়নাভিরাম চা বাগানের সৌন্দর্যে মোহিত হবেন, ফার্স্ট ফ্লাশের দামী কাপে চুমুক দিতে দিতে অন্য কাজের সন্ধানে বাগান ছেড়ে চলে যাওয়া শ্রমিককে নিয়ে গল্পের প্লট ভাববেন, তারপর কলকাতার ফ্লাইট ধরতে বাগডোগরা উদ্দেশে রওনা হবেন।
নদী ভাঙ্গন উত্তরবঙ্গের বারো মাসের সমস্যা। গঙ্গা, ফুলহার মহানন্দা ঘেরা মালদা জেলার আয়তন ৩৭৩৩ বর্গকিলোমিটার এবং মৌজার সংখ্যা ১৮১৪। কিন্তু গঙ্গা ভাঙ্গন এই হিসাবের অনেকটাই ওলট-পালট করে দেয় ফি বছর। নদী ভাঙ্গন মালদা জেলার ভৌগোলিক মানচিত্রকে পাল্টে দেয় প্রতিবছর। একাধিক মৌজার সাথে পুরো গ্রাম পঞ্চায়েত নদীগর্ভে চলে যাচ্ছে এমন ঘটনাও ঘটেছে। প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে নদী এই জেলায় ধ্বংসলীলা চালালেও টনক নড়েনি কোন সরকারের। মালদা, মানিকচক, কালিয়াচক, ইংরেজবাজার ব্লকের একাংশে গঙ্গার ভাঙন লাখ লাখ মানুষ গৃহহীন, ভূমিহীন করেছে। একদিকে নদী গ্রামের পর গ্রাম গিলে নিচ্ছে, অন্যদিকে ঝাড়খণ্ডের দিকে চরের পর চর জাগছে। ভাঙ্গনের সময় বোল্ডার ফেলা হচ্ছে। যেখানে জলের গভীরতা দুশো ফুট সেখানে এক মিটারের কাজ হচ্ছে। জলের স্তর কমে গেলে নদী আবার পাড় ভাঙছে। গঙ্গা অ্যাকশন প্ল্যান কিংবা নমামি গঙ্গের কোনও ফল মালদাবাসী পাচ্ছে না কেন? এ প্রশ্নের উত্তর তো উত্তরবঙ্গবাসী চায়।
কোচবিহারে মেডিকেল কলেজ হয়েছে এটা অত্যন্ত আনন্দের কথা। কিন্তু বাস্তবতা হল - এখনও সঙ্কটাপন্ন রোগীদের চড়া ভাড়া দিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে ৪-৫ ঘণ্টার পথ পাড়ি দিয়ে শিলিগুড়ি যেতে হচ্ছে। আর অনেক ক্ষেত্রেই পথের মাঝেই রোগীর মৃত্যু ঘটছে। রাজনৈতিক টানাপোড়েনে "এইমস" রায়গঞ্জ থেকে সরে গেল কল্যাণীতে। ঝাঁ-চকচকে সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালে ডাক্তার অপ্রতুল। ২০২১- এর নির্বাচনী ভাষণে এক নেতা শিলিগুড়িতে "এইমস" হবার কথা বলছেন, আবার কোচবিহারের সভায় বলছেন "এইমস" হবে কোচবিহারে। এই ধাপ্পাবাজিতে এখন আর উত্তরবঙ্গবাসী অবাক হয় না। তবে একচিলতে আলোও আছে বঞ্চনার অন্ধকারের মাঝে। অ্যাক্যাডেমিক এক্সেলেন্স কতটা হয়েছে জানিনা, তবে হাজার হাজার ছাত্রছাত্রীর অ্যাকাডেমিক অ্যাকোমডেশন অবশ্যই হয়েছে কোচবিহারে ঠাকুর পঞ্চানন বর্মা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের মধ্য দিয়ে। কোচবিহার, আলিপুর, ফালাকাটা, ধুপগুড়ির মত অঞ্চলের অসংখ্য ছাত্রছাত্রীকে আর উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে না, এটা সত্যিই ভালো দিক। বাড়ির রান্না খেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে পারছে আমাদের ছেলেমেয়েরা - এর চাইতে ভাল আর কী হতে পারে ?
তবে যাই হোক, দেনা পাওনার সূচক ধরে আমরা যখন উত্তরবঙ্গের মানচিত্রের দিকে তাকাই তখন দেখি না পাওয়ার খোপকাটা ঘরের সংখ্যাই বেশি এবং বঞ্চনার ভারী তালা খোলার জন্য দরকার সদিচ্ছা, পরিকল্পনা এবং তা বাস্তবায়নের জন্য নিষ্ঠার চাবি।
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team