আর কদিন পরেই শুরু হচ্ছে আকারে-কলেবরে-জনপ্রিয়তায় এবং ঐতিহ্যে উত্তরপূর্ব ভারতের সবচেয়ে বড় উৎসব কোচবিহার রাসমেলা। কথায় বলে বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ। কোচবিহারবাসীদের জন্য কিন্তু পার্বণ সংখ্যা তেরোর জায়গায় চোদ্দো। উৎসবের মরসুমে পুজো আর বড়দিনের মধ্যেকার ফাঁক ভরাট করতেই যেন প্রতিবছর উত্তরের এই রাজনগর মেতে ওঠে রাসমেলায়। কথিত আছে মহারাজা হরেন্দ্রনারায়ণ রাস পূর্ণিমার পূণ্য লগ্নে তাঁর রাজধানী ভেটাগুড়িতে স্থানান্তরিত করে নব নির্মিত রাজপ্রাসাদে প্রবেশ করেন। সেই উপলক্ষে প্রাসাদের বাইরে একটি মেলা বসেছিল। রাসমেলার সূচনা সেই দিন থেকেই। সেই হিসেবে এই মেলা এবার ২১১তম। পরবর্তী কালে রাজধানী কোচবিহারে ফিরে এলে রাসমেলাও কোচবিহারে চলে আসে। প্যারেড গ্রাউন্ড অর্থাৎ বর্তমান রাসমেলার ময়দান ঘিরে আয়োজিত এই মেলার বয়স ১২৫ পেরিয়েছে। তবে রাজ আমল চলে গেলেও রাস উৎসব বা রাসমেলার গরিমা কিন্তু একটুও ম্লান হয়নি। রাসমেলা ধীরে ধীরে কলেবরে বাড়তে বাড়তে আজ বৈরাগী দীঘি চত্বর ছাড়িয়ে, প্যারেড গ্রাউন্ড, স্টেডিয়ামের মাঠ, হাসপাতাল মোড়, জেলখানা মোড়, কোচবিহার ক্লাব দিয়ে চতুর্দিকে তার ডালপালা বিস্তার করেছে। আর ধীরে ধীরে প্যারেড গ্রাউন্ডও তার অস্তিত্ব হারিয়ে লোকমুখে পরিণত হয়েছে রাস মেলার মাঠে।
কোচবিহারের মানুষের প্রাণের ঠাকুর মদনমোহনকে ঘিরেই এই উৎসবের আয়োজন। কোচবিহার যখন ভারতের সঙ্গে পরবর্তীতে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে যুক্ত হয় তখন ভারতভুক্তি চুক্তি অনুসারে মহারাজার পরিচালিত যে মন্দিরগুলি রয়েছে সেই সমস্ত মন্দিরের দায়িত্ব ভারত সরকারকে নিতে হয়েছে। বর্তমানে এই মন্দিরগুলোর দায়িত্বে আছে দেবত্র ট্রাষ্ট বোর্ড। মদনমোহনের দ্বাদশ যাত্রার অন্যতম এই রাসযাত্রার আয়োজন এরাই করে থাকে।
রাসযাত্রা ঘিরে যে রাসমেলা বসে তার পরিচালনার ভার প্রশাসন থেকে দেওয়া হয় পুরসভাকে। পুরসভা রাসমেলার মাঠের জমির মধ্যে স্টল বণ্টনের দায়িত্বে থাকে। কোচবিহার শহরের ফুসফুস এই রাসমেলার মাঠটি কিন্তু জেলা কালেক্টরের অধীনে। কেবল মাত্র রাসমেলার জন্যই প্রশাসনের তরফ থেকে এই মাঠটি কয়েক দিনের জন্য পুরসভার হাতে দেওয়া হয়। এজন্য প্রশাসনকে পুরসভার তরফ থেকে কোনো রকম টাকা দিতে হয়না। উল্টে স্টল বণ্টনের ভাড়ার টাকা সবটাই আসে পুরসভার ঘরে। এই বাড়তি আয় পুরসভার জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। বহু বছর ধরে যারা এখানে মেলা করে আসছে, স্থানীয় বা বাইরে থেকে আসা ব্যবসায়ীরা, তারা তাদের নির্দিষ্ট স্থানেই যাতে স্টল পায় তার সবটা দেখভাল করে পুরসভা। সেখানে স্টলের জন্য যে নির্দিষ্ট জায়গা থাকে ব্যবসায়ীদের থেকে সেই জায়গায় ভাড়ার টাকা পুরসভা নেয়। গত বছর স্টল ভাড়া হয়েছিল প্রতি স্কোয়ার ফিটে দেড় টাকা। তখন ভাড়া বাড়ানো নিয়ে একটা সমস্যা দেখা দিয়েছিল। এবছর পুরসভার পক্ষ থেকে আবারও ভাড়া বাড়ানোর কথা জানানো হয়েছে। এবছর এক ধাক্কায় বাড়িয়ে তিন টাকা পঁচাত্তর পয়সা করা হয়েছে। সাথে ২৫% কনজারভেন্সি চার্জ বলে অতিরিক্ত অঙ্ক দিতে হবে দোকানীদের।
রাসমেলা চলাকালীন মেলা চত্বর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার দায়িত্ব হল পুরসভার। মেলাতে বিভিন্ন জায়গায় স্টলগুলো বসার বিভিন্ন নিয়ম রয়েছে। রাসমেলা মাঠের কিছু অংশ কন্ট্রোল রেটে দেওয়া হয়। নাগরদোলা, বন্দুক বেলুন এদিকের লাইনগুলোতে এবং রাস্তার দুদিকে যে স্টলগুলো বসে তাদের হিসাব কমার্শিয়াল রেটে করা হয়। শুধুমাত্র মাঝ মাঠে যে স্টল বসানো হয় তাদের নির্দিষ্ট একটা বর্গফুট হিসাবে টাকা ধরা হয়ে থাকে। একই ভাবে স্টেডিয়ামের ভেতর স্টলগুলোও কমার্শিয়াল রেটে ভাড়া হয়। মাঠে স্টলের ভাড়া পনেরো দিনে ৫-৬ হাজার টাকা হলে স্টেডিয়ামের ভেতরে সেই রেট হয় ২০-২৫ হাজার থেকে শুরু করে ৭০-৮০ হাজার টাকা। তবে জানা গেল, পৌরসভা অবশ্য সরাসরি স্টেডিয়ামের ভেতরকার স্টলগুলো বন্টন করেনা। থার্ড পার্টিকে স্টেডিয়ামের দায়িত্ব দিয়ে দেওয়া হয় নির্দিষ্ট একটি টাকার বিনিময়ে। ঠিক কী নিয়মে বা কোন মাপকাঠিতে ‘থার্ড পার্টি’ এই বরাত পায় তা অবশ্য জানা যায়নি।
যেমন গত বছর রাসমেলায় প্রায় হাজার দুয়েক স্টল বসেছিল। এবছর স্টলের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে জানালেন পুরসভার বর্তমান চেয়ারম্যান রবীন্দ্রনাথ ঘোষ। তিনিই জানালেন, গত বছর স্টল বাবদ পুরসভা ১ কোটি ২ লক্ষ টাকা আয় করেছিল। এবার আরো বেশ কিছু জায়গায় নতুন স্টল করা হবে। আর তার জন্য প্রচুর আবেদন পত্র জমা পড়েছে বলে জানা গেল। এবছর বাংলাদেশ ছাড়াও থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর থেকে স্টল আসার কথা হচ্ছে। যাই হোক, সব কিছু ঠিক মত হলে ২০২৩-এর রাসমেলা থেকে পুরসভার আয় বেশ ভালোই হবে আশা করা যায়। তবে শুধু আয় নয়, স্টেডিয়ামের মাঠে যে সাংস্কৃতিক মঞ্চ থাকে সেখানে অনুষ্ঠানে যেসব শিল্পীদের আনা হয়, তাদের জন্যও বেশ মোটা টাকা খরচ করে পুরসভা। অন্যান্য বারের তুলনায় গতবছরই প্রায় ২০ লাখ টাকা বেশি লেগেছিল বলে জানা যায়। এ বছরও কথা হচ্ছে কলকাতা ও মুম্বাইয়ের শিল্পীদের আনবার। তাই এবারের বাজেটও স্বভাবতই অনেকটা বেশী। এসব খরচাপাতি করে গত বছর পুরসভার নেট আয় ছিল ৫২ লক্ষ টাকা। জানা গেল, এই টাকা দিয়ে সারা বছরের বিভিন্ন খরচ চলে যায় তাদের। যেমন ভাসানীর মেলা, বিশ্বকর্মা পুজো, ৫১ পীঠ পূজা, নানা রকম স্পোর্টস, ছট পূজা, স্বচ্ছতা উৎসব এসব নানা কিছুতে এই টাকা খরচ হয় বলে জানা গেল।
পনের দিনব্যাপী এই রাসমেলার আয়োজন করার জন্য প্রশাসনকে তৎপর হতে হয় অনেক আগে থেকে। বিভিন্ন দপ্তরের সঙ্গে রাসমেলা সংক্রান্ত প্রশাসনিক বৈঠক করতে হয় দফায় দফায়। লক্ষ লক্ষ লোকের সমাগম হবে যেখানে, সেখানে নিরাপত্তা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। কোনওরকম বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তি যাতে এই মেলাকে কোনওভাবে বিপর্যস্ত করতে না পারে তার জন্য শয়ে শয়ে পুলিশ আনানো হয় বিভিন্ন জেলা থেকে। এদের যাওয়া আসা, থাকা খাওয়া সব দায়িত্ব, সব খরচ যোগাতে হয় জেলা প্রশাসনকেই। মেলাতে দর্শনার্থীদের যাওয়া আসার সুবিধার জন্য বাড়তি বাসের ব্যবস্থা করা, জলের ব্যবস্থা, আলোর ব্যবস্থা সবটাই প্রশাসনিক মাথাব্যথা। দমকল, স্বাস্থ্য বিভাগ সবাইকে প্রশাসনের নির্দেশে ২৪ ঘন্টা প্রস্তুত থাকতে হয় যে কোনও আপৎকালীন পরিস্থিতির মোকাবিলা করার জন্য। এককথায় প্রতিবছর কোচবিহার জেলা প্রশাসনের কাছে এ যেন একটা রাজসূয় যজ্ঞ।
মেলা থেকে পুরসভার আয় হলেও এই ‘রাজসূয় যজ্ঞে’ প্রশাসনের মোট খরচ কতো হয় সেটা সঠিক জানা যায়নি। তবে অসমর্থিত সূত্র অনুযায়ী মেলায় বিশাল পুলিশবাহিনী, বিদ্যুৎ, জল, সরকারি স্টল, কর্মীদের খাওয়াদাওয়া, পরিবহণ ইত্যাদি সব খরচ যোগ করলে পঞ্চাশ লাখ পেরিয়ে যেতে পারে। এছাড়াও, অসমর্থিত সূত্র মতেই, জেলা প্রশাসন যে রাসমেলার মাঠ এবং সংলগ্ন স্টেডিয়াম মাসখানেকের বেশি সময় ধরে ব্যবহারের জন্য কোচবিহার পুরসভাকে বিনামূল্যে দেয়, সরকারি হিসেবে তার ভাড়াও নাকি ৩৫-৪০ লাখের মত হয়। সে টাকাও প্রশাসনিক ব্যয়ের খাতাতেই ধরতে হবে। আর এই রাস উৎসব থেকে মদনমোহন মন্দিরকে কেন্দ্র করে দেবত্র ট্রাস্টের আয় ও ব্যয়ের হিসেবটাই বা কী? খোঁজখবর করে যেটুকু জানা গেল, মেলার সময় প্রণামী, ধর্মশালায় ঘরভাড়া বা স্টল ভাড়া বাবদ যেটুকু আয় হয় তা বাদ দিলে তাঁদের ব্যয় দশ লাখের আশপাশেই থাকে।
অর্থাৎ পক্ষকাল ব্যাপী এই সুবিশাল হেরিটেজ মেলা বাবদ প্রশাসন, পুরসভা ও দেবত্র ট্রাস্ট এই তিন সরকারি সংস্থার সাকুল্যে ব্যয়ের পরিমাণ দেড় কোটি টাকার কম নয়, এই দাবি করাটা বোধহয় অত্যুক্তি হবে না। এই ব্যয় পুরোটাই হয় কোচবিহারের মানুষের সেন্টিমেন্ট রক্ষার্থে এবং ক্ষুদ্র খুচরো ব্যবসায়ীদের বেচাকেনার স্বার্থে, সে কথাও অস্বীকার করবার নয়। কিন্তু এই ঐতিহ্যমণ্ডিত মেলার নেই কোনও স্মারক পুস্তিকা, বছর কয়েক আগে এক দুবার উদ্যোগ নিয়ে প্রকাশ হলেও তা ছিল সীমিত স্তরেই। অথচ এই স্মারক পুস্তিকাতেই মেলার এইসব তথ্য নিয়মিত দেওয়া যেতে পারে নাগরিকের স্বার্থেই। যা থেকে যেতে পারে ভবিষ্যতের ইতিহাস লেখার জন্যও, পারে না? এইসব প্রশ্নই নীরব নাগরিক মনে ঘুরপাক খায়, কারণ গণতান্ত্রিক কোচবিহারের নাগরিকদের এসব তথ্য জানবার অধিকার আছে অবশ্যই। মেলা থেকে পুরসভার আয়কে কোচবিহার নাগরিক পরিসেবার কোনও গঠনমূলক কাজে লাগানো যায় কিনা সে নিয়েও ভাবনাচিন্তার অবকাশ রয়েছে বলে মনে করেন অনেকেই। মেলায় শৌচাগারের অপ্রতুলতা একটি বড় নাগরিক অভিযোগ। তেমনি মেলার পরিসর ক্রমেই বাড়তে থাকার ফলে সংলগ্ন বাড়িগুলির দৈনন্দিন জীবনযাত্রা ও পরিবেশ-পরিচ্ছন্নতা বিঘ্নিত হওয়া নিয়ে ভুক্তভোগী নাগরিকদের অসন্তোষের উপর দৃষ্টিপাত এবং তার সুরাহা হওয়াটা প্রয়োজন। একই ভাবে মেলা কলেবরে বাড়লেও ঐতিহ্যবাহী এই রাসমেলার গা থেকে সাবেকি গন্ধ ক্রমেই মুছে যাচ্ছে বলে আক্ষেপ পুরনো কোচবিহারবাসীর, মেলা আয়োজকদের সেদিকেও নজর দিতে হবে বইকি।
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team