 
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                                                 রম্যাণী গোস্বামী
                                            
                                                
                                                রম্যাণী গোস্বামী
                                            
                                            
                                         
                                            
                                        শিলিগুড়ির একটি নামী ইংরেজি মিডিয়ম স্কুলের ছাত্রী সাত বছরের ছোট্ট নয়নতারা চুপিচুপি ওর মায়ের নজর এড়িয়ে আমার গা ঘেঁষে এসে যখন ফিসফিস করে জিগ্যেস করে, আন্টি, ‘ফাক ইউ’ মানে কী গো? মাথাটা মুহূর্তের জন্য ফাঁকা হয়ে গেলেও ওর নিস্পাপ কৌতূহলী দুটো চোখের দিকে তাকিয়ে রেগে উঠি না। কারণ জানি যে সম্পূর্ণ না বুঝেই বলা হয়েছে ওই শব্দবন্ধটি। কিন্তু সেই সঙ্গে এও নিদারুণ সত্যি যে ওই শব্দের নিগূঢ় অর্থ নয়নতারা আর কিছুদিন পর আপনা আপনিই তার বন্ধুবান্ধব অথবা ক্লাসমেটদের সহায়তায় বুঝে যাবে। স্কুলে আসা যাওয়ার মাঝখানে চলন্ত স্কুলবাসে বা দুটি ক্লাসের বিরতিতে কচি কচি আঙুলেরা একে অপরের কাছ থেকে সাতিশয় আগ্রহে শিখে নেবে এমন কয়েকটি মুদ্রা বা ভঙ্গি যা সবিশেষ অর্থবাহী।
হ্যাঁ, সকলের অজান্তে এভাবেই ওরা ছোট্ট থেকে ‘বড়’ হয়ে যাবে মুহূর্তের মধ্যে।
নয়নতারাদের দোষ না দিয়ে বরং চোখ মেলে চেয়ে দেখি চূড়ান্ত ভোগবাদী আমাদের এই পারিপার্শ্বিক দুনিয়াকে। বেশি দূরে যেতে হবে না। বিগত কয়েক বছরে করোনাকালে নিম্ন, মধ্য ও উচ্চবিত্ত পরিবারের শিশুদের হাতে অনলাইন পড়াশোনার জন্য তুলে দেওয়া হয়েছে দ্রুতগামী আন্তর্জাল পরিসেবাসমেত উন্নত মানের গ্যাজেট। যা এক ধাক্কায় তাদের শৈশবকে ঠেলে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করিয়েছে পরিপক্ক মন মানসিকতার অফুরান এক জটিল এবং ধূসর প্রান্তরে। প্রয়োজনের তাগিদে এখন শুধুমাত্র শহর নয়, গ্রামাঞ্চলে এবং চা বাগান বেল্টেও ঘরে ঘরে দানাপানি থাকুক বা না থাকুক, স্মার্টফোনটি অপরিহার্য।
ফলত কী হয়েছে?
বড়দের পাশাপাশি ছোটরাও ঘাড় ঝুঁকিয়ে বুঁদ হয়ে থাকছে নিষিদ্ধ আবিস্কারের নেশায়। ঘাটতি দেখা যাচ্ছে তাদের মধ্যেকার স্বাভাবিক শিশুসুলভ আচরণে। কোভিডের পর পর বিভিন্ন সমীক্ষায় উঠে এসেছে বিশেষ করে শহরের স্কুলগুলিতে স্পোর্টস পিরিয়ডে মাঠে খেলতে নেমে একের পর এক শিশুর অসুস্থ হয়ে পড়ার কথা। ক্লাস টু থেকে নাইন – কে নেই এই দলে? অদ্ভুত কিছু আলস্য ও খানিকটা অনভ্যাস যেন গ্রাস করেছে তাদের শৈশবের উৎফুল্লতাকে। রোদে মাথা ঘোরা, বমিভাব, মাসল ক্র্যাম্প, শারীরিক পরিশ্রমে তীব্র অনীহা – সমস্যার তালিকাটি নেহাত ছোট নয়। মাঠের ধারে বিল্ডিঙের সিঁড়ির ধাপে ধাপে বসে রয়েছে জবুথবু শরীরের ‘ফিলিং আনওয়েল’ এর দল। মনের আনন্দে সাঁ সাঁ ছুটে বেড়ানোর, শোরগোল ফেলে দেওয়া স্কুলের মাঠে প্রায়শই তাই বিরাজ করছে নৈরাশ্যের স্তব্ধতা। আবার একেবারে সাম্প্রতিক একটি আন্তর্জাতিক সমীক্ষা তুলে ধরেছে আরেকটি ভয়াবহ চিত্র। সেখানে দেখা যাচ্ছে যে শৈশবের যে পর্বে যতখানি পর্যাপ্ত পরিমাণে কথা বলা উচিত, বহু শিশু তা বলছে না। শিশুদের ভিতরে বেড়ে চলা এই নীরবতার মাত্রা কি স্বাভাবিক? নিউ নর্মালেরই অংশ? বিষয়গুলো ভাবায় খুব।
অকালেই শিশুদের শৈশব চুরি হয়ে যাওয়ার পিছনে তাদের অভিভাবকদেরও দায় থেকে যায় অনেকখানিই। সেই সঙ্গে সামাজিক পরিকাঠামোও অবশ্যই দায়ী। সাবেকী আমলের কাকা-কাকি, জেঠিমা-জেঠু, ঠাকুমা-ঠাকুরদা পরিবৃত একান্নবর্তী সংসার ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে আশ্রয় নিয়েছে টু-থ্রি বিএইচকে’র খুপরি গহ্বরে। তুতো ভাইবোনেরা মিলেমিশে একজায়গায় বসে নিজস্ব কল্পনার রঙিন জগতে অনাবিল ফুর্তিতে মেতে থাকার সুযোগ সেখানে নেই। কোথায় উধাও হয়ে গেল দাদু ঠাকুমার মুখের ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমীর গল্প? কাড়াকাড়ি করে পড়া পূজাবার্ষিকীগুলো? কোথায় বিলীন হয়ে গেল অবন ঠাকুর, লীলা মজুমদার সৃষ্ট সেইসব কল্পনায় রঙিন হয়ে ওঠা দেশ? কখন কীভাবে কবেই বা হারিয়ে গেল দিগন্তবিস্তৃত সবুজ মাঠ, রুমাল চোর, কানামাছি ভোঁ ভোঁ–র হুল্লোড়?
এখন নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি। বাবা মা এবং সন্তান। কেরিয়ার সর্বস্ব, অফিস পলিটিক্স-টার্গেট রিচ-ডেডলাইন-ওয়ার্কলোড-প্রাপ্তি অপ্রাপ্তি-অসুখ বিসুখ-ক্ষোভ বঞ্চনায় ঘেরা আমাদের জীবন। নিউজ চ্যানেল ও পত্রপত্রিকায় ক্রমাগত এবং একইসঙ্গে ক্রমবর্ধমান দুর্নীতি আর অবক্ষয়ের চিহ্ন। শিশুমনে গভীর প্রভাব ফেলছে এরা। কখনও পরিবারের ছোট্ট সদস্যটির উপস্থিতিতেই বাবা মায়ের মধ্যে এমন সব অসহিষ্ণু আলোচনা, তর্কাতর্কি, কুরুচিকর ভাষার ব্যবহার চলছে যা শিশুটির শোনা মোটেই কাঙ্ক্ষিত নয়। তবুও সে শুনছে। গিলছে। তারপর বন্ধুদের মাঝে গিয়ে সেটাই উগড়ে দিচ্ছে।
বাচ্চাটিকে হয়তো ঘরে রেখে আসার সমস্যা, রোববারের সকালে দেখা যাচ্ছে অভিভাবকের হাত ধরে খুদে সদস্যও চলে এসেছে মাংসের দোকানে। এ কিন্তু আমাদের এক অতি পরিচিত দৃশ্য – কী সেটা? ওই যে। বাবা দামাদামিতে ব্যস্ত। ঠোঁটের কোণে জ্বলন্ত সিগারেট ঝুলছে। পাশেই শিশুটি হাঁ করে ধোঁয়া গিলতে গিলতে দেখছে মাংস কাটার দৃশ্য। নির্বিকার। স্কুল থেকে ফিরেই তাইকন্ডু ক্লাস আর তারপর সন্ধ্যাবেলা দুখানা টিউশনে ‘পড়াশোনা’ শেষ করে এসে অবশেষে তার হাতে স্মার্টফোনের জন্য অবশ্য বরাদ্দ এক ঘণ্টা। গভীর আগ্রহে তখন সেই ছেলেটি বা মেয়েটিই দেখছে ফোনের পর্দায় ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলোতে চরম ভায়োলেন্সের দৃশ্যাবলী। বেড়াতে গিয়ে অথবা ঘরোয়া গেট টুগেদারে ও পার্টিতে প্রকাশ্যে বাচ্চাদের সামনেই চলছে অভিভাবকদের আকণ্ঠ মদ্যপান, বেলেল্লাপনা। ‘ও তো ছোট, কিছু বোঝে না’ – এরকম আপ্তবাক্যের প্রয়োগ কচি মনকে করে তুলছে বিদ্রোহী। রাতারাতি ‘সবকিছু’ বুঝে ফেলার ও ‘জেনে নেওয়ার’ প্রয়াস কেড়ে নিচ্ছে তাদের যাবতীয় শিশুতোষ অনুভূতিগুলো।
চারটি শিশু একত্রিত হলে তাই এখন আর আমাদের সেই পরিচিত ছেলেবেলার স্বাদগন্ধ খুঁজে পাওয়া যায় না। ওদের মুখে মুখে শুধুই বড়দের বুলি। বড়দেরই অনুকরণ। ওদের আলোচনাতে ঘুরে ঘুরে আসছে ইন্সটাগ্রাম, রিল, নরা ফতেহির বেলি ডান্স। অনিবার্যভাবেই চলে আসছে লাইক, ফলোয়ার, ভিউয়ের সংখ্যা, ওয়েব সিরিজের হিট নিউ রিলিজ। স্কুলে বেড়ে ওঠা কম্পিটিশন, বাড়িতে অভিভাবকদের আকাশছোঁয়া প্রত্যাশা, চূড়ান্ত শাসন আবার কখনও লাগামহীন প্রশ্রয়ের ধাক্কায় ছোটবেলা উপভোগ করার আনন্দটাই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে শিশুমনকে ছেয়ে ফেলছে চোরা অবসাদের ঘন কুয়াশা।
বাড়ির খুদে সদস্যটির সঙ্গে কেবলমাত্র অভিভাবক নয়, বরং বন্ধুর মতো মিশে, রুটিনের বাইরেও ওদের কিছুটা সময় দিয়ে, মিড টার্মে পাওয়া নম্বর আর গ্যাজেটগুলো একপাশে সরিয়ে রেখে, খেলাধুলো আর গল্প শোনানোর মাধ্যমে এই কেজো দুনিয়ার বাইরের অদৃশ্য কল্পলোকের দরজাটা (যার পাসওয়ার্ড প্রত্যেকটি শিশুর মনের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে) সহানুভূতিশীল কিন্তু জোরালো দু’হাতের ধাক্কায় খুলে দিতে পারলে হয়তো এই কুয়াশা কেটে গিয়ে সেখানে ঝিকিমিকি আলো আসবে। সেই আলো ফোটাতে পারাটাই এখন সবচাইতে জরুরি সামাজিক দায় আমার ও আপনার।
এবং সেটা খুব বেশি দেরি হয়ে যাওয়ার আগেই।
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team
