ছোটবেলার পুজোর ছুটি মানে ছিল নতুন জামা, নতুন পুজোবার্ষিকীর সম্ভার, স্কুল ছুটি, নেই পড়াশোনার বালাই, বন্ধুদের সঙ্গে সাইকেল নিয়ে দে ছুট। তখন আর কে পায় আমাদের। আমাদের শহরের আশপাশে বেশ কিছু চা বাগান রয়েছে, সেগুলোই ছিল আমাদের মূল গন্তব্য। ওইসব চা বাগানগুলোর মধ্য দিয়ে ছোট ছোট নদী বয়ে যেত। যেমন করলা, ধরলা, জেপি, পাঙ্গা। সেইসব হাঁটুজল নদীতে পা ডোবানোর এক আলাদাই অনুভূতি ছিল। অবশ্য এই জায়গাগুলোতে গেলে ছোটবেলায় যেমন মনে হত, বড় হয়েও সেই একই রকম ভাবে রোমাঞ্চিত হই। পুজোর ছুটি যত এগিয়ে আসে, ভাবতে বসি নতুন কোথায় যাওয়া যায়, কোন অজানা জায়গা অপেক্ষা করে আছে এবার। এবার আমার এক ছোটবেলার বন্ধুর সাথে গিয়েছিলাম নলদারাতে।
সেখানে এক হোমস্টের মালিক অনুপ তামাংজির সাথে আলাপ হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন নলদারা নামের ইতিহাস। নল বা নাল কথাটির অর্থ দুটি বাঁশের সাহায্যে মালপত্র বোঝাই করে পাহাড়ি পথে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা। সেকালে কোনও যানবাহন না থাকায় পায়ে হেঁটে স্থানীয় মানুষেরাই এই মাল বহন করে নিয়ে যেত। পানিঘাটা বাজার থেকে মিরিক। পথ যেহেতু অনেকটা তাই সন্ধের পরে এই স্থানে তারা রাত্রি বাস করত, পরদিন আবার সকালবেলায় তারা পাড়ি দিত মিরিকের উদ্দেশে। সেই থেকেই এই জায়গার নাম ক্রমে হয় নলদারা। একটি স্বল্প পরিচিত পাহাড়ি গ্রাম, চা বাগানে ঘেরা। মিষ্টি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ, পাখির ডাক, খোলা আকাশ, অচেনা পাহাড়ি রাস্তা, সহজ সরল গ্রাম্য মানুষ নিয়ে এই ছোট্ট পাহাড়ি জায়গাটি ঘরোয়া পর্যটন মানচিত্রে নতুন সংযোজন।
বয়স বেড়েছে, বেড়েছে অভিজ্ঞতাও। কিন্তু স্পিরিটটা রয়ে গেছে ঠিক আগের মতই। আমার বন্ধুটিও বহুদিন পর ঘুরে বেড়াতে চায় সেই সব জায়গাগুলোতে। Two is company and three is crowd-- এই ফর্মুলাতেই সেদিন দুই বন্ধুতে মিলে পাহাড়ের চা বাগানগুলো ঘুরবো বলে সকাল সকাল বেরিয়ে পড়েছিলাম। নলদারার নাম সম্পূর্ণ অজানা ছিল আমাদের কাছে। এক বন্ধুর কাছে নাম শুনেছিলাম মাত্র। শরতের নীল আকাশ, সাদা তুলোর মতন মেঘ ভাসছে, চারিদিকে কাশফুল ফুটে রয়েছে। আমরা শিলিগুড়ি পৌঁছে দার্জিলিং মোড়ের একটি দোকানে চা আর বাটার টোস্ট দিয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে নিয়ে এগিয়ে চললাম অজানা নলদারাকে চিনতে। শিলিগুড়ি পেরিয়ে শালবাড়ি ছাড়িয়ে পথ অন্য রূপ নিতে শুরু করেছে। একদিকে টয় ট্রেনের লাইন আর অন্যদিকে শাল সেগুনের মহানন্দা অভয়ারণ্য। আমার বন্ধুটি তো যারপরনাই খুশি। আমরা শুকনা হয়ে বাঁদিক দিয়ে শিমুলবাড়ির রাস্তা ধরলাম। এই রাস্তাটি ভীষণ সুন্দর। দূরে শিবালিক হিমালয়ের বিস্তৃত পর্বতসারি তার পাদদেশে সবুজ অরণ্যের বুক চিরে মসৃণ চওড়া পিচের রাস্তা ধরে আমরা এগিয়ে চললাম সেই পথে। দুধিয়ার বিখ্যাত লোহার ব্রিজ পেরিয়ে কিছুটা এগুতেই একটা মোড় পড়ে, সেখান থেকে সোজা চলে গেলে মিরিক আর বাঁদিকে মুক্তি বস্তির রাস্তা। আমরা এই রাস্তাটি ধরেই এগুতে থাকলাম, এই রাস্তায় মুক্তি খোলা ভিউ পয়েন্টে কিছুটা সময় কাটালাম। একটি শিব মন্দির দেখতে পেয়েছিলাম। একেবারে মুক্তি খোলার পাশেই। মুক্তি খোলা যেখানে একটু বাঁক নিয়েছে সেখানেই রয়েছে মুক্তি ব্রিজ। সেখান থেকে নদীর অসাধারণ দৃশ্য দেখা যায়। এরপর রাস্তা একেবারে খাড়া উঠে গেছে উপরের দিকে।
কিছুটা খারাপ রাস্তার পরে অবশ্য বেশ ভালো রাস্তা আর তার দু'ধারে চা বাগান। শান্ত নিরিবিলি শহরের কোলাহল থেকে বহু দূরে এই অপার্থিব সুখে তৃপ্ত হয়েছিলাম আমরা। এই চা বাগানটির নাম Fallodi Tea Garden । বেশ কিছুটা যাবার পর আরেকটি চা বাগানের মধ্যে একেবারে রাস্তার পাশে একটি চায়ের দোকান দেখে আমরা দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম। পাহাড়ের রাস্তার পাশে এই চায়ের দোকানগুলোতে চা খেতে বেশ লাগে, চায়ের সাথে উপরি পাওনা অসাধারণ নৈসর্গিক দৃশ্য। দোকানের দাদাকে জিজ্ঞেস করে জানলাম এটা মিল্লিকথং টি গার্ডেন, আরো সামনে গেলে মিল্লিকথং ভিউ পয়েন্ট। এখানে একটি হোমস্টে রয়েছে, নাম আয়ুষ্মান হোমস্টে। চা বাগানের মাঝে ছোট্ট ফুটফুটে একখানা হোমস্টে। এখানে থেকেই ঘুরে দেখা যায় আশালিয়া জলপ্রপাত, এই জলপ্রপাতটি যেন একটি লুকনো মণি। এ ধরনের জলপ্রপাত আমাদের উত্তরবঙ্গে আর আছে কিনা বলে আমার জানা নেই। সত্যিই অপূর্ব এই জায়গাটি। আশালিয়া জলপ্রপাত পর্যন্ত একটি ট্রেকিংরুট আছে। যারা অ্যাডভেঞ্চার পছন্দ করেন তাদের জন্য এটি আদর্শ জায়গা। স্থানীয় কিছু লোকজনের মুখেই শুনলাম এখান থেকে নেপাল সীমান্ত খুব কাছে।একজন সামনের একটি পাহাড়কে দেখিয়ে বললেন ওটাই নাকি নেপাল। সময়ের অভাবে আমরা সেদিন যেতে পারিনি, আবার এলে নিশ্চয়ই যাব।
ফিরে আসবার সময় নলদারায় আমাদের দেখা হয়ে গেল অনুপজির সাথে, ওয়াং হোমস্টের মালিক, ভীষণ ভদ্র এবং ভালো মানুষ। একরকম জোর করেই আমাদের নিয়ে গেলেন ওঁর হোমস্টেতে। তবে এখানে না এলে অনেক কিছুই দেখা হত না। হোমস্টে যাবার রাস্তাটি আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছিল। দুপাশে চা বাগানের মাঝখান দিয়ে চলে গেছে মসৃণ পিচের সরু রাস্তা, যেটি এক জায়গায় গিয়ে দু'ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছে। ডান দিকে চলে গিয়েছে অনুপজির হোমস্টেতে আর বাঁদিকের রাস্তাটি সোজা নেমে গেছে বাগডোগরা নকশালবাড়ির দিকে। অনুপজি আমাদের হোমস্টে ঘুরিয়ে দেখালেন, বসিয়ে চা খাওয়ালেন আর বলে দিলেন যে আমরা যে পথে এসেছি সে পথ দিয়ে না গিয়ে এই সোজা পথটি অর্থাৎ বাগডোগরা যাবার রাস্তাটি ধরে শিলিগুড়ি ফিরতে। আমরা তাই করেছিলাম। এই রাস্তাটিও কম সুন্দর নয়, মেচি নদী পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে। চা বাগান শেষে লোহাগড় ফরেস্ট অফিস পেরিয়ে ফিরে এলাম স্বস্থানে আরেকটা অসাধারণ অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে।
সরাসরি যোগাযোগের জন্য রইল নাম্বার-- আয়ুষ্মান হোমস্টে, মিলিকথং। 9593634103, 8348827177; অনুপ তামাং, ওয়াং হোমস্টে, নলদারা 6294250189
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team