বাড়িতে বা মন্দিরে পূজায় যখন যজ্ঞ করা হয় তাতে আমরা সবাই অগ্নি প্রজ্জ্বলন করি। আর সেই অগ্নির ভেতর ঘি বা অন্যান্য দ্রব্য দিয়ে আগুন বা অগ্নির শিখাকে আরও খানিকটা বেশি উস্কে দেওয়ার পর আমরা বলি স্বাহা। মুনি ঋষি থেকে শুরু করে পুরোহিতরা যজ্ঞের সময় বলে ওঠে ওম স্বাহা। নইলে যজ্ঞ ফলপ্রসূ হয় না।
কখনও ভেবে দেখেছেন কি এই স্বাহা কেন বলা হয়? এ কি কোনও মন্ত্র? নাকি অগ্নি দেবতাকে তুষ্ট করার কোনও বিশেষ পদ্ধতি?
আসলে 'স্বাহা' কথাটি উচ্চারণ করা হয় যেকোনও ভালোর জন্য। শুভ কাজ পরিসমাপ্তি ঘটলে উচ্চারিত হয় 'স্বাহা'। সংস্কৃতে এর অর্থ সু অর্থাৎ ভালো, অহ্ অর্থাৎ ডাকা। অগ্নিদেবতার কাছে নিঃস্বার্থভাবে নিজেকে সম্পূর্ণ উৎসর্গ করার সময় বলা হয় স্বাহা। আমরা সাধারণ ভাষায় বলে থাকি নৈবেদ্য, পূজার প্রধান উপকরণ, তা নিবেদন করার সময় আমরা স্বাহা উচ্চারণ করি। পূজার পর যজ্ঞের সময় অগ্নিকে কোনও সামগ্রী যেমন ঘি, মধু, ফল ইত্যাদি অর্পণ করা হত, তাতেই স্বাহা বলা হয় নইলে যজ্ঞের কাজ সম্পূর্ণ হয় না। শ্রীমদ্ভাগবত গীতা ও শিবপুরাণে আমরা স্বাহা সম্পর্কে জানতে পারি। আসলে মনে করা হয় আগুন বা অগ্নি সর্বভূক, অগ্নিকে আহুতি দিয়ে তুষ্ট করতে হয়। ঋগ্বেদে স্বাহা মানে অর্ঘ্য বলা হয়েছে। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে স্বাহাকে প্রকৃতির একটি রূপ বলে মনে করা হয়েছে, যাকে ছাড়া অগ্নি টিকতে পারে না।
তাহলে এই স্বাহা কী? আসলে স্বাহা একটি স্ত্রীবাচক শব্দ, যিনি অগ্নিদেবের পত্নীরূপে পুরাণে উল্লেখিত। উপনিষদে বলা হয়েছে স্বাহা এমন এক শক্তি যাকে অগ্নি কখনোই ধ্বংস করতে পারে না। স্বাহা ও অগ্নি চিরকাল পাশাপাশি বসবাস করেন।
মহাভারতের বনপর্ব থেকে স্বাহার গল্প জানতে পারা যায়। মার্কণ্ডেয় পান্ডবদের কাছে স্বাহার গল্প করেছিলেন। বিয়ের আগে স্বাহা ছিলেন একজন অপ্সরা, অগ্নিদেবের সঙ্গে বিবাহের পর তিনি হয়ে ওঠেন অমর, চিরজীবী।
মহাভারতে আছে স্বাহা ছিলেন প্রজাপতি দক্ষের কন্যা। তিনি অগ্নিদেবের প্রেমে পড়েন ও তাঁকে কামনা করেন। কিন্তু অগ্নিদেবের তাঁর প্রতি লক্ষ্য ছিল না। অগ্নিদেব সপ্তর্ষিদের যজ্ঞ আচারের সভাপতিত্ব করতেন। তিনি সপ্তর্ষিদের স্ত্রীদের প্রতি বিমোহিত হয়ে পড়েন যারা ছিলেন অনেক সুন্দর ও আকর্ষণীয়, অগ্নিদেব তাঁদের দিকে মুগ্ধদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতেন।
অন্যের স্ত্রীদের প্রতি কামনা পোষণ করার অপরাধ। অগ্নিদেব যখন এটা বুঝতে পারেন তখন প্রায়শ্চিত্ত করতে তিনি বনে যান তপস্যা করার জন্য। স্বাহা তাকে অনুসরণ করেন এবং তার ইচ্ছাকে উপলব্ধি করতে পারেন। তিনি সপ্তর্ষিদের স্ত্রীদের রূপ ধারণ করেন (যদিও তিনি বৈশিষ্ঠের স্ত্রী অরুন্ধতীর রূপ ধারণ করতে পারেননি) এবং অগ্নিদেবের সাথে মিলিত হন। অগ্নি এবং স্বাহা বনে অনেক প্রেমময় মুহূর্ত অতিবাহিত করেন এবং অগ্নিদেব তাকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেন।
কিছু কিছু গল্পকথায়, তিনি কার্তিকের অনেক ঐশ্বরিক গণ্য মায়েদের (স্কন্ধ) মধ্যে একজন। তিনি অগ্নিদেবের কন্যা অগ্নেয়ারও মা। আবার কোথাও কোথাও প্রজাপতি দক্ষের কন্যা বলেও তাঁকে মনে করা হয়। ধারণা করা হয় তিনি হোমবলি যজ্ঞের প্রধান। তাঁর দেহ চার বেদের সমন্বয়ে গঠিত এবং ছয় অঙ্গ প্রতঙ্গ বেদের ছয় অঙ্গকে প্রকাশ করে। এটা বলা হয়ে থাকে যে, কোনও দেবতাকে উদ্দেশ্য করে যজ্ঞের মাধ্যমে যদি কোনওকিছু উৎসর্গ করা হয় তাহলে সেই দেবতা তখন পর্যন্ত উৎসর্গ গ্রহণ করেন না যতক্ষণ পর্যন্ত না স্বাহা মন্ত্রোচ্চারণ করা হয়। এমনই সম্পর্ক অগ্নির সঙ্গে স্বাহার।
স্বাহাকে অনেক বৈদিক সাহিত্যের স্তোত্রেও পাওয়া যায়, যার অর্থ ‘স্বাগত’। এই অভিবাদন করা হয় অগ্নিকে স্মরণ করে যা সকল প্রাণীর উৎসের একটি দিক হিসাবেও মনে করা হয়।
স্বাহা অগ্নিদেবী বলা হলেও তিনি আসলে পরকাল, নরক, মাতৃত্ব, জীবন এবং বিবাহের দেবীরূপে পূজিত।
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team