‘আশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে উঠেছে আলোকমঞ্জির...’
আলো তখনও ভালোমতো ফোটেনি আকাশে। ভিতরে কোনও এক তাগিদ কাজ করে চলে হয়তো। সেই কারণে দেশলাই বাক্সের সামান্য খসখস শব্দ আর ধূপকাঠির এক চিলতে মিষ্টি গন্ধেই ঘুমটা তড়াক করে ভেঙে যায়। লাফ দিয়ে উঠে মশারি সরিয়ে বাইরে বেরতে চোখে পড়ে প্রতিবছরের মতো এবারেও রেডিওর জায়গা বদল হয়েছে। দেওয়ালের দ্বিতীয় তাকের কোণা থেকে সোজা সেন্টার টেবিলের উপরে, মাথায় কুরুশের কাজের ঢাকনাটা সরিয়ে রাখা। রেডিওর একপাশে প্রদীপ। অন্যপাশে ধূপদানিতে গুঁজে রাখা জ্বলন্ত ধূপকাঠি। তিনটে মোটা ধোঁয়ার রেখা এঁকে বেঁকে জানলা দিয়ে বেরিয়ে মিশে যাচ্ছে বাগানে শিউলি গাছের শরীরে।
বাড়ির পিছনের উঠোনটায় শিউলি ফুলের গালচে পাতা। গাছের ডাল ধরে নাড়ালে টুপটাপ বৃষ্টি ঝরে পড়ে। গালচের মধ্যবিন্দুতে গাছের গোড়ায় ঝুঁকে বসে পাশের বাড়ির খুকি একমনে ফুল তুলতে ব্যস্ত। মাথার কোঁকড়া চুলের ফাঁকে ফাঁকে আটকে আছে শিউলি ফুল। পাশে রাখা ডালা উপচে পড়ছে ফুলে। খুকি এরপর বসে বসে মালা গাঁথবে। পুকুরে, খালবিল, দীঘিতেও শালুকের সম্ভার। এইসময় অন্যরকম এক আলোয় ভরে ওঠে চরাচর। ‘বাজলো তোমার আলোর বেণু, মাতলো যে ভুবন।’ সেই স্ফটিকস্বচ্ছ আলোয় একেবারে রানির মতো সেজে ওঠে প্রকৃতি।
পাড়ার রাস্তা দিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে সাইকেলের ক্রিং ক্রিং কানে আসে। দল বেঁধে চলে গেল ছেলেরা। ওরা যাচ্ছে নদীর চরে। একটা দুটো বাজি ফাটানোর শব্দ ভেসে আসে দূর থেকে। তিস্তার চর এখন কাশফুলে সাদা। আত্রেয়ী, অজয় আর কোপাইও তাই। রূপনারায়ণ, কংসাবতীও। প্রবল বাতাসে দূর থেকে মনে হয় যেন নদীর চরে সমুদ্রের ঢেউ জেগেছে। ওদিকে ঘরের ভিতরে মায়ের নরম আঙুলের ছোঁয়ায় রেডিও জেগে উঠল। বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের চণ্ডীপাঠে ভরে গেল ঘর দালান। অন্ধকার কোণা ঘুপচিগুলোও যেন হেসে উঠল আনন্দে। ‘জাগো দুর্গা, জাগো দশপ্রহরণধারিণী। অভয়া শক্তি, বলপ্রদায়িনী, তুমি জাগো।’ পাশের ঘরে বাবার আরামে পাশ ফিরে শোওয়ার মৃদু খুকখুক কানে ভেসে এলো। বাতাসে শীত শীত আমেজ। বাগানে ঘাসের মাথায় শিশিরের চাদর পেতে রাখা। খালি পায়ে হাঁটতে বড় মজা। পায়ের পাতা নিমেষে ভিজে চুপ্পুস। গায়ের মোটা খদ্দরের চাদরটা বেশ করে জড়িয়ে নিয়ে ভাইবোনেরা মিলে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বারান্দায় পেতে রাখা মাদুরে বসে মহালয়া শোনা। ওই তো, একে একে এসে পড়লেন বড়মা, কাকিমা, জেঠিমারা।
ইতিমধ্যে রাঙামাসি উনুনে আঁচ দিয়েছেন। টগবগ করে বিশাল কেটলিতে ফুটছে চায়ের জল। একটু পরেই হাতে হাতে ঘুরবে ধূমায়িত কাপগুলো। চায়ের ধোঁয়ার ওম নিতে নিতে বারবার বাচ্চাদের চোখ চলে যাবে তালাবন্ধ আলমারিটার দিকে। একদম উপরের তাকে তাদের নাগালের বাইরে পরপর সাজিয়ে রাখা আছে পূজাবার্ষিকীগুলো। স্কুলে হাফ ইয়ারলি পরীক্ষা শেষ। রেডিওতে মহালয়া শোনা সম্পূর্ণ হলেই জেঠু নিজে হাতে বের করে দেবেন শারদীয়াগুলো। ভাইবোনেরা কাড়াকাড়ি করে টেনে নিয়ে বুকের তলায় বালিশ পেতে উবু হয়ে শুয়ে গোগ্রাসে গিলতে থাকবে সেসব গোটা ছুটি জুড়ে।
কুচোকাঁচাদের দল যদিও আজ সকাল সকালেই এসে ভিড় করবে চণ্ডীমণ্ডপের সামনে। কাঠামো পুজোর পরদিন থেকেই চলে এসেছেন পালমশাই। তারও আগে নিলু আর সুবাস ঘাট থেকে নৌকা নিয়ে চলে গিয়েছিল শিমুল কাঠ আনতে। সেই কাঠেই তৈরি হল কাঠাম। ঠাকুরদালানে এখন মৃত্তিকা থেকে মৃন্ময়ীর আগমনের অন্তিম পর্যায়ের ব্যস্ততা। কাঠ, খড়, বাঁশ, পাটের কুঁচি, এঁটেল মাটি দিয়ে ধীরে ধীরে আকৃতি পেল হিরণ্ময়ী মায়ের রূপ। এখন পালমশাইয়ের নিমগ্ন হাতের রঙ তুলির ছোঁয়ায় একটু একটু করে জীবন্ত হয়ে উঠছেন মা। কাঁচা হলুদ গায়ের রঙ। ভরাট মুখে চকচকে গর্জন তেলের জৌলুস। ‘তব অচিন্ত্য রূপচরিত মহিমা।’ কচিরাও এমনি বসে নেই। পালমশাইয়ের নির্দেশে তারাও হাত লাগায় ছাঁচে মাটি দিয়ে মায়ের আর তার ছানাপোনাদের অলঙ্কার আর চালের সাজ তৈরিতে। খবরের কাগজ পেতে সেসব রোদে শুকিয়ে নেওয়া হবে। পেটমোটা অসুরও বাদ যায় না সাজসজ্জায়। যত্ন করে তারও গলার মালা, হাতের রুলি। গায়ে সবুজ রঙ।
আর একটু বড় যারা, তারা বেরিয়ে পড়বে রাস্তায়। মনের আনন্দে টইটই করে ঘোরা। গলিতে গলিতে সেদিন আড্ডার ঠেকগুলো ভাঙতে বেলা গড়িয়ে যাবে। তখন খিদেয় চোঁ চোঁ করবে পেট। হেঁশেলে আজ যার যার সাধ্যমতো বিশেষ আয়োজন। ইলিশ মাছের তেল দিয়ে মাছভাজা। ইলিশ মাছের ঝোল অথবা সর্ষে বাটা। পুকুরের পাকা রুই। জেলেপাড়ার মোহনকাকা এসেছেন জাল কাঁধে। গোটা পাড়ায় বাটি চাপা দিয়ে মাছের পদ যাবে। দিদার জন্য হবে নিরামিষ পদ। দুই তিন ধরনের তিতো, করলা ভাজা, ডাল, মানকচু কাঁচা বাটা। শাপলার ডাঁটি দিয়ে তরকারি। ডাঁটির ভিতরে লম্বা সরু কাঠি গুঁজে বেসনে ডুবিয়ে ভাজা। নদীর ঘাটেও ভোর থেকে তর্পণে নিমগ্ন মানুষর ঢল নেমেছে। ছেড়ে যাওয়া পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে তিল-জল দান। এই নিয়ে চমৎকার একটি গল্প কথিত আছে। দুপুরে খাওয়া দাওয়া সেরে ভাইবোনেরা মিলে দিদার মুখে শুনবে সেই কথা।
তারপর কর্ণ তো স্বর্গে গেলেন। কিন্তু সেখানে গিয়ে তিনি জলের অভাবে হাহাকার আরম্ভ করলেন। কত স্বর্ণালঙ্কার, রাশি রাশি রত্নস্তূপ, সুদৃশ্য বিশ্রাম কক্ষ, আরামের বিপুল আয়োজন। কিন্তু কোথাওই গিয়ে একফোঁটা জল পান না। একমুঠো অন্নও জোটে না। শেষমেশ খিদে তেষ্টায় কাতর হয়ে দেবরাজ ইন্দ্রের শরণাপন্ন হয়ে জানতে পারেন যে দাতা নামে সুপরিচিত তিনি স্বয়ং জীবিত অবস্থায় কখনও তাঁর পিতৃপুরুষকে জল ও অন্ন নিবেদন করেন নি। তাই এই শাস্তি। অলঙ্কার কি চিবিয়ে খাবেন? সুতরাং প্রায়শ্চিত্তের উদ্দেশ্যে কর্ণ আবার মর্তে নেমে আসেন এবং এক পক্ষকাল ধরে পিতৃপুরুষকে জল ও অন্ন দিয়ে তাঁদের তৃপ্ত করে নিজে পাপমুক্ত হন – ‘তৃপ্যন্তু সর্বমানবা’। সেই এক পক্ষকালই পিতৃপক্ষ নামে পরিচিত। তর্পণ শেষে সূর্যপ্রণাম করে মা মহামায়াকে আহ্বান করা হয়। সেই সঙ্গে আরম্ভ হয় দেবীপক্ষের সূচনা। ‘জয়ন্তী মঙ্গলা কালী ভদ্রকালী কপালিনী। দুর্গা শিবা ক্ষমা ধাত্রী স্বাহা স্বধা নমোহস্তুতে।’
ওই গল্প শেষে আরও একটি ভীষণ জরুরি কথা উচ্চারণ করেন দিদা। জানিস তোরা? এই ভোরে শুধুমাত্র পিতৃপুরুষের নয়, করজোড়ে প্রার্থনা করা হয় জগতের সকলের মঙ্গলের নিমিত্ত – ‘সর্ব মঙ্গল মঙ্গল্যে।’ বেঁচে থাক আমার পড়শি। পাড়ার শুধু নয়। দেশের পড়শিরাও। আবার তাদের দেশেরও। অপরিচিত সেইসব মানুষগুলিরও, আহা, ভালো হোক তাঁর। যার সঙ্গে কখনও দেখা হয়নি, যাকে চিনিনা, জানিনা, শোকতাপ, জ্বালা যন্ত্রণা, তাঁদেরও মঙ্গল হোক – ‘ওঁ নমঃ যে বান্ধবা অবান্ধবা বা’।
আর শুধুমাত্র মানবজাতির নয়, এই মন্ত্র উচ্চারণের মাধ্যমে সামগ্রিক সুখ শান্তি সৌভাগ্য কামনা করা হয় জগতের সমস্ত জীবজগত – বৃহৎ ক্ষুদ্র তুচ্ছ যত প্রাণী, তৃণ থেকে বৃক্ষ, পশু পাখি মাছ, পাহাড় নদী বন সকলের জন্য। অশুভ শক্তি নাশ করে সুরক্ষিত থাক বিপন্ন প্রাণ ও প্রকৃতি। ‘দেহি সৌভাগ্যমারোগ্যং দেহি দেবি পরং সুখম্। রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো জহি।’ সুখী হোক বাগানের গাছপালা। বাগান পেরিয়ে ওই নদী, আরও কিছুটা দূরে ওই যে পদ্মবিল। সে-ও।
পদ্মবিলটাও দিদুন! আর বিলের বকগুলোও?
নয় কেন? ওরাও যে তোদের বন্ধু হয় রে।
ভালো থাক উত্তরের কাঞ্চনজঙ্ঘা, দক্ষিণের সুন্দরবনের দ্বীপ। দার্জিলিংয়ের বৌদ্ধ মঠের মন্ত্রঃপূত রঙিন পতাকা ছুঁয়ে এই প্রার্থনা ছড়িয়ে পড়ুক দেশের ব্যাপ্তি ছাড়িয়ে আরও অনেক অনেক দূরে। কল্যাণময়ীর আশীর্বাদে ভালো থাকুক নীল নদ। আমাজনের জঙ্গল। সাভানার ঘাসজমি। আন্টার্কটিকার মেরুভালুক।
উঠোনের নরম রোদে পিঠ দিয়ে দিদার গা ঘেঁষে বসে হাঁ করে গল্প শোনে নবীন প্রজন্ম। দিদার শরীর থেকে মিঠেপান আর জর্দার সুমিষ্ট গন্ধ ভেসে আসে। মেনি বেড়ালটা আড়মোড়া ভেঙে হাই তোলে। ভুলো কুকুরের মাথায় আঙুল বোলালে তার চোখ আরামে বুজে আসে। বাগানে গাছে গাছে রঙবেরঙের প্রজাপতি উড়ে বেড়ায়। ছাতারে পাখিগুলোও ঝগড়া ভুলে চুপ করে মুড়ি খায় আর খোকাখুকুদের গল্প শোনা দেখে।
ধীরে ধীরে মুহূর্তেরা ছায়ার পাখি হয়ে মিলিয়ে যায়। শুধু রয়ে যায় অমোঘ কিছু শব্দ – গন্ধ – বর্ণ। মনের ভিতরের লুকনো সিন্দুকে ওরা ঝিকমিক করে। ঝিকমিক করে আর আলো ছড়ায় মণিমাণিক্যের মতো। ‘ওগো আমার আগমনী আলো। ওগো আমার পথ দেখানো আলো। জীবনজ্যোতিরূপের সুধা ঢালো, ঢালো, ঢালো।’
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team