যে ফুল এখনও কুঁড়ি
তারই জন্মশাখে
রবি নিজ আশীর্বাদ
প্রতিদিন রাখে....
সম্ভাবনার কুঁড়িগুলি আর যথেচ্ছ ডালপালা ছড়ানো গাছগুলির শাখায় শাখায় প্রাণবন্ত ফুল হয়ে ফুটে উঠবার সুযোগ পাচ্ছে কোথায় আজ? আমাদের প্রজন্ম যারা সেকালের আর একালের জলপাইগুড়ির ব্যাপক পটপরিবর্তনের প্রত্যক্ষদর্শী, প্রিয় এই শহরটিকে বড় অচেনা লাগে আজকের দিনে দাঁড়িয়ে বয়ে চলা ঋতুগুলির সঙ্গে এর আবহাওয়ার চরম অসঙ্গতি দেখে আর অজস্র ফ্ল্যাট পুরোনো বাড়িগুলির জায়গা দখল করে সমস্ত ভারসাম্যকে নষ্ট করে কীভাবে করুণ এক পরিণতির দিকে আমাদের নিয়ে চলেছে সেটা উপলব্ধি করে। অবশ্যম্ভাবী ভাবেই এর প্রভাব পড়ছে শহরের প্রকৃতিতে। ফুলের সঙ্গে মানুষের চিরকালীন নিবিড় এক সম্পর্ক। পুরোনো জলপাইগুড়ির আটপৌরে বাড়িগুলির সামনের খোলা জায়গাটুকু গাছগাছালিতে ভরে থাকতো সেসময়। ডালে ডালে দোলা দিয়ে যেত ঋতুর দলেদের আমন্ত্রিত রঙিন অতিথিরা। পথিকের মুগ্ধ চোখ ছুঁয়ে যেত তাদের। মাটিকে ছুঁয়ে অকৃত্রিম ভাবে বেড়ে উঠতো তাদের কান্ড, গভীরে ছড়াতো শিকড়ের টান। বাড়ির পেছনের একটুকরো জায়গায় তরতাজা কিচেন গার্ডেন থাকতো তার উজ্জ্বল অস্তিত্ব নিয়ে।
শহরবাসীর এই বাগানবিলাস আজ প্রায় অস্তমিত গগনচুম্বী ফ্ল্যাট-সংস্কৃতির ক্রমবর্ধমান দৌরাত্ম্যে। এই আবাসনপ্রিয়তা শিকড়ের টানকে আলগা করে শহরের যৌথ পরিবারগুলিকে ভেঙে খানখান করেছে। উপড়ে নিয়েছে প্রাচীন ঐতিহ্যমন্ডিত এই শহরের বহু পুরোনো বাড়ির মাটির গল্প এবং সহজ যাপনের চালচিত্রখানি। বাতাবি লেবুর ফুল, সজনে ফুল, কদমফুল তাদের বড় বড় গাছগুলি নিয়ে গন্ধের মাদকতায় আর দাঁড়িয়ে নেই শহরের অলিগলিতে। কামিনী, চাঁপা, কাঠটগর, স্থলপদ্ম ছোট ছোট ঘেরাটোপে ডালপালা মেলবে কেমন করে! শিউলির গন্ধে আবিষ্ট হবার উপায় কোথায় আজ! একটুকরো ঝুমকোলতা বা মাধবীলতার বিতানে পাখিদের কানাকানি হারিয়ে যাবার পথে। টবে টবে লাগানো সৌখিন গাছগুলি বড় পরিসরে মাটির আদর পেয়ে বেড়ে উঠবার সুযোগ পাচ্ছে কোথায়! বলাই বাহুল্য অক্সিজেনের সরবরাহ স্বাভাবিক ভাবেই কমে আসছে প্রকৃতিতে। প্রচুর গাছপালা কাটা পড়ে যাওয়ায় উষ্ণায়ণের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে দীর্ঘমেয়াদি অনাবৃষ্টি ও ভয়াবহ তাপমাত্রার প্রকোপে শহরবাসীর প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে উঠেছে। আবার কখনো অতিবৃষ্টির প্রকোপে জনজীবন বিপর্যস্ত হচ্ছে।
ক্রমাগত ছোট হয়ে আসা পরিবারগুলি নিজস্ব লোকজন ও সময়ের অভাবে গাছপালা ও ফুলের মতো এমন ভালোলাগার একটি বিষয় থেকে দূরে সরে আসছে ক্রমশ। ফুল সেই অর্থে সবচেয়ে কাছের বন্ধু হয়ে আনন্দ দেয় আমাদের। ছোট্ট কুঁড়িটির একটু একটু করে বেড়ে ওঠা আর পাঁপড়ি মেলাকে প্রত্যক্ষ করবার যে আশ্চর্য এক আনন্দ তা ফুল ও গাছকে জড়িয়ে যারা বাঁচেন তাঁরাই জানেন। সবুজ গাছপালা আর রঙিন ফুলেদের এই বন্ধুত্বের সবটাই নিঃশর্ত ও নিঃস্বার্থ। এরা খুশি ছড়াতে জানে শুধু। জড়িয়ে নিয়ে বাঁচতে শেখায়। শহরের প্রবীণদের অবসর জীবনের অলস প্রহরগুলি একসময় হাতে পায়ে মাটি মেখে বাড়ির উঠোন জুড়ে সাজানো এই ফুল লতাপাতাদের সঙ্গেই অনাবিল আনন্দে কেটে যেত। ফ্ল্যাটবাড়ির ছোট পরিসরে ছোট ছোট টবের পরিমিত ছোটখাটো গাছে সে আনন্দ কোথায় আর! পুজোর ফুলের কোনো অভাব ছিল না তখন শহরে। আজকাল বেশিরভাগ মানুষকেই ফুল কিনে পুজো দিতে হয়। আমগাছ, বেলগাছ সবই নিজেদের জায়গা হারানোতে আমের পল্লব বা বেলপাতার জন্যও দোকানির দ্বারস্থ হতে হয় আমাদের।
ছোটবেলার রান্নাবাটি খেলা বা বনভোজনে এই গাছগাছালির ভূমিকা ছিল অনেক। ভেঙে পড়ে যাওয়া ডালপালাগুলি আর ঝরে পড়া শুকনো পাতা দিয়ে মাটির উনুন জ্বালিয়ে তাতে রান্না করে গাছের নিরিবিলি ছায়ায় সারে সারে কলাপাতায় অতি সাধারণ কিছু খাওয়াদাওয়াতেও চড়ুইভাতি এক অকৃত্রিম আনন্দের আমেজ হয়ে রয়ে যেত সেসময়। প্রতিটি বাড়ির ঘরে ঘরে ফুলদানিগুলি সেজে উঠতো নিজেদের ফুলবাগানের সাদা ও রঙিন ফুলে। নিয়ম করে প্রতিদিন তাদের পাল্টানো ও সাজানো হতো। বিশেষ বিশেষ দিনে বাড়িতে ফোটা নানারঙের ফুল দিয়েই তোড়া বানিয়ে স্কুলে শিক্ষকদের উপহার দিত ছাত্রছাত্রীরা। সেই সহজ সরল যাপন, ফুলের মতো নির্মল কোমল মনগুলি আজকের এই পরিবর্তনের হাওয়ায় ভীষণভাবে অনুপস্থিত আমাদের একান্ত আপনার এই ভালোবাসার শহরটিতে। বাজারে চড়া দামে কেনা কৃত্রিম ফুলগুলির মতোই রঙিন সৌন্দর্য্যের আড়ালে আসলে সবটাই নকল, সবটাই ফাঁকি। শিউলি গন্ধমাখা ভোর বা বেলি,জুঁই, গন্ধরাজের আবেশের রাতের প্রহর যে কত সুমধুর তা অজানাই রয়ে গেল আজকের প্রজন্মের অনেক ছেলেমেয়ের। বড় স্পর্শকাতর তাই সেই দিনগুলি তাদের নিজস্ব গন্ধ নিয়ে, ফুলেল মায়াময়তায়। যেখানে যেটুকু এখনও রয়ে গেছে তারা মনের খুশিতে ডালপালা মেলে দিক আকাশছোঁয়া স্বপ্ন নিয়ে। অযুত কুঁড়ি ভালোবাসার ফুল হয়ে মুগ্ধতা ছড়াক। ইট কাঠ কংক্রিটের কৃত্রিমতার মাঝেও আকাশে বাতাসে ভাসুক সুগন্ধি এক সুর। ফুল নামে খুশিটি হাত বাড়ালেই ফুটে উঠবার ইচ্ছে হয়ে বেঁচে থাকুক অগণিত বন্ধুর মনে।
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team