কোচবিহারের রাজারা শিব ও চণ্ডী বা ভবানী মায়ের উপাসক ছিলেন। কোচবিহার রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা বিশ্বসিংহের জন্ম শিবের ঔরসে বলে কথিত। আবার বিশ্বসিংহের রাজপদে বসার পিছনে দেবী ভবানীর আশীর্বাদ আছে বলেও কাহিনি প্রচলিত আছে। কোচবিহারের মদনমোহনবাড়িতে ভবানী মন্দিরে থাকা প্রস্তর মূর্তি বিশ্বসিংহ জঙ্গলে পালিয়ে বেড়ানোর সময় পেয়েছিলেন বলে কথিত। কোচবিহারের মহারাজা নরনারায়ণের স্বপ্নে দেখা দেবীমূর্তির আদলে প্রায় ৫ শতক ধরে পূজিত কোচবিহারের বড়দেবী বহু আলোচিত। কিন্তু তার বাইরেও কোচবিহার জেলায় ২০০-৩০০ বছরের প্রাচীন বেশ কিছু দুর্গাপূজা আজও অনুষ্ঠিত হয়ে চলেছে। এইসব পূজায় সাবেকিয়ানা এখনো রক্ষা করার সর্বতো চেষ্টা দেখা যায়। বারোয়ারী বা সার্বজনীন পূজা যেমন আছে, তেমনি পারিবারিক পূজাও আছে।
কোচবিহার রাজ্যের উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী ছিলেন রূপচন্দ্র মজুমদার। তাঁর বংশের পুরুষেরা পরে রাজপ্রদত্ত 'মুস্তাফি' পদবি লাভ করেন। সাবেক ছিটমহল ভিতরকুঠি বা শিবপ্রসাদ মুস্তাফি তালুকে ১৬৬৫ খ্রিস্টাব্দে তাঁদের পারিবারিক দুর্গাপূজা শুরু হয়। পরে সমৃদ্ধ গ্রাম গোবরাছড়ায় ওই পূজা হতে থাকে। পরিবারের বহু প্রাচীন মন্দিরটি এখনও আছে। সেখানে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত পূজা হয়েছে। তাদের এক শরিক দিনহাটা শহরে আজও পূজা চালু রেখেছে। রক্তবর্ণা সিংহ ও ব্যাঘ্রবাহনা দেবীবাড়ির প্রতিমায় দেবীর পুত্র ও কন্যারা নেই। জয়া ও বিজয়া আছে। এই পরিবারের প্রতিমায় জয়া ও বিজয়া নেই। পরিবর্তে লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক ও গণেশ আছে। মৎসপুরাণ মতে সাবেক রীতি বজায় রেখে এখানে পূজা হয়। একই বছর গোসানিমারিতে কামতেশ্বরী মন্দিরের পুনর্নির্মাণ করেন মহারাজা প্রাণনারায়ণ। সেখানে দেবী পূজা মহাসমারোহের সাথে করা হয়। মূর্তি নেই, ঘট বসিয়ে পূজা হয়।
ভেটাগুড়িতে বারোয়ারি দুর্গাপূজা দুই শতকের পুরোনো বলে মনে করা হয়। ১৮১২ সালে মহারাজা হরেন্দ্রনারায়ণ এখানে রাজধানী স্থাপন করলে দেবদেবীর মন্দিরও স্থাপিত হয়েছিল। সেখানে রাজপরিবারের আরাধ্যা দেবী ভবানী মন্দির নিশ্চয়ই ছিল। ১৮২২ সাল পর্যন্ত এখানে রাজধানী ছিল, সেসময় নিশ্চয়ই দেবী পূজা হত। পরে রাজধানী স্থানান্তরিত হলে এই পূজা বন্ধ হয়ে যায়। সম্ভবত তখন কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দার প্রচেষ্টায় বারোয়ারি দেবী পূজা শুরু হয়। এই মূর্তি দেবীবাড়ির মতো রক্তবর্ণা। এখানে এক কাঠামোয় লক্ষ্মী, সরস্বতী, গণেশ, কার্তিক তৈরি হত। অসুরের বর্ণ সবুজ। এক্ষেত্রে বাঘ নেই। জয়া, বিজয়া নেই। সাবেক রীতি মেনে কামরূপী ব্রাহ্মণ পূজা করেন। তবে কয়েক বছর হল আলাদা আলাদা কাঠামোয় লক্ষ্মী, সরস্বতী, গণেশ, কার্তিক মূর্তি তৈরি করা হয়। পূজা শুরুর প্রামাণ্য নথি নেই। তবে ক্ষেত্র অনুসন্ধান করতে গিয়ে বছর দশেক আগে আশি বছরের বেশি বয়সী বৃদ্ধ মূর্তি নির্মাতার মুখে শুনেছি তাঁর ঠাকুরদার বাবাও ওই মূর্তি তৈরি করতেন।
দিনহাটা মহামায়ার পাটে পূজা শুরু হয় মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণের রাজত্বকালে (১৮৬৩--১৯১১)। কোচবিহার স্টেট রেলওয়ে স্থাপনের জন্য তখন দিনহাটা শহরের পূর্বদিকে লাইন পাতার কাজে বড় বড় পাথর ফেলা হয়েছিল। জঙ্গলাকীর্ণ এলাকায় শ্রমিকরা দিনের বেলায় কাজ করে রাতে তাঁবুতে থাকত। তারা একদিন লক্ষ্য করে বিশেষ একটি পাথর আগের দিন অন্য স্থানে সরিয়ে রাখলেও আবার পূর্বস্থানে অবস্থান করছে। কয়েকদিন সরানোর পর একই ঘটনা ঘটে। দেবী রাতে ঠিকাদারকে স্বপ্নে জানান, ওই পাথরে এবং ময়না গাছে তিনি বিরাজ করছেন এবং তাঁর পূজা করতে বলেন। পূজা শুরু হয়। স্বপ্নাদেশ পেয়ে এক মাড়োয়ারি চালা তৈরি করে দেন। পরে সেখানে পাকা মন্দির ওঠে। নিত্যপূজার সাথে সাথে এখানে ১৯৬৭ সাল থেকে ফাল্গুনের শুক্লা অষ্টমীতে বার্ষিক পূজা হয়। তবে দুর্গাপূজার চারদিনও এখানে সাড়ম্বরে পূজা হয়। নিয়ম কানুনের ব্যাপারে এখানে কঠোরতা লক্ষ্য করা যায়। প্রসঙ্গত রেলের জন্য এই পথে ১৮৯১ সালে জরিপ করার বিজ্ঞপ্তি জারি হয়। এর পর জরিপ এবং অল্প সময়ের মধ্যেই লাইন পাতার কাজ শুরু হয়।
মহারাজা দেবেন্দ্রনাথের রাজত্বকালে (১৭৬৩--১৭৬৫) মেখলিগঞ্জ মদনমোহন মন্দিরে বারোয়ারি দুর্গাপূজা শুরু হয়। সম্ভবত জেলার প্রাচীনতম বারোয়ারি পূজা এটি। এখনও প্রাচীন নীতি মেনেই এখানে পূজা হয়। হলদিবাড়ি বাজারে মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণের দান করা ভূমিতে বারোয়ারি দূর্গা পূজার প্রচলন হয়। সম্ভবত ১৮৯৭ সালে এই পূজা শুরু হয়। তবে নথি নেই। ১৯১০ সালে পূজার কথা একজন চিঠিতে তার পরিজনকে জানিয়েছিলেন। সেই চিঠি আছে। সুতরাং এর আগেই পূজা প্রচলন হয়েছে। সন্ধ্যায় আরতি হত। ইউরোপীয় সাহেবরা পূজা দেখতে আসতেন। গানের আসর বসত, নাটক অভিনীত হত। ইউরোপীয় পাট ব্যবসায়ী অধ্যুষিত হলদিবাড়ির এই পূজায় দেশপ্রেমের মন্ত্র 'বন্দেমাতরম' ধ্বনিত হয়েছিল। সাবেক এই পূজা এখন অনেকটাই জৌলুশহীন।
বলরামপুরে কোচবিহারের নাজিরদেউয়ের আবাসস্থল। বহু ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী বলরামপুর। নাজিরদেউ দশভূজার মূর্তি প্রতিষ্ঠা ও মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। তবে ঠিক কখন তা জানা যায়নি। পরে ১৮৭০ সাল থেকে মন্দির ও বিগ্রয়ের ব্যয়ভার বহন করে রাজ সরকার। প্রাচীন মন্দির আর নেই। রাজবংশের এই শাখা দেবীবাড়ির আদলে রক্তবর্ণা দেবী পূজা করত। এখনও নাজিরদেউ খগেন্দ্রনারায়ণের বংশধর এই পূজা করে।
চিলাখানার সাহেববাড়িতে 'সুবা' হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত রাজবংশের শাখায় দুর্গাপূজার শুরু হয় ৩০০ বছর আগে। বড়দেবীর আদলে বিগ্রহ ছিল। রাজবাড়ি থেকেই বিগ্রহ রীতিমতো শোভাযাত্রা করে পাঠানো হয়। এই বিগ্রহ গত শতকে চুরি হয়ে যায়। পরে বারাণসী থেকে নতুন বিগ্রহ এনে পূজা হতে থাকে। বর্তমানে তিন শরিক পর্যায়ক্রমে পূজা করে আসছে। কামরূপী ব্রাহ্মণ পূজা করেন। পূজায় পাঁঠা ও চালকুমড়া বলি দেওয়া হয়। এখন চার দিনের পরিবর্তে শুধু মহাষ্টমীতে পূজা হয়। এই পরিবারের পূজার চামর, থালা, হাড়ি, খড়্গ, হাঁড়িকাঠ ইত্যাদিও মহারাজা দান করেছিলেন। পূজার নিয়মকানুন এখনও একই আছে। নিষ্ঠা আছে ষোলো আনা।
রংবেরঙের বিজলি বাতি নতুন রোশনাই ও প্রাচুর্যের কাছে সাবেক পূজাগুলি ম্লান হয়ে গেলেও আন্তরিকতা ও নিষ্ঠায় এইসব পূজায় প্রাণের ছোঁয়া বজায় আছে। জাকজমকপূর্ণ পূজায় তা কতটুকু পাওয়া যায় সে বিষয়ে সন্দেহ আছে।
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team