স্বাধীনতার ছিয়াত্তর বছর পেরিয়ে ‘নতুন ভারত’ গড়ার আহ্বান যখন একদিকে নতুন প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ করবার কথা, তখন অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গ নামক ‘অতি প্রগতিশীল’ এক প্রদেশে দেশের একদা রাজধানী ও সংস্কৃতির পীঠস্থান বলে পরিচিত মহানগরীতে এক জগদ্বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসে র্যাগিং নামক প্রাচীন ব্যাধির ভয়াবহ প্রাদুর্ভাব এখনও বিদ্যমান। ছাত্রদেরই জান্তব অত্যাচারে কিশোর এক নবীন ছাত্রের দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যু আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল আমাদের নিজেদের ভাবী প্রজন্ম আমাদের নিজেদের হাতেই নিরাপদ নয়। যাদের প্রত্যক্ষ অপরাধী বলে পুলিশি হেফাজতে নেওয়া হয়েছে তাদের বাইরেও পরোক্ষে অপরাধ অস্বীকার করতে পারেন না কেউ। কেবল বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনই নয়, প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীরা, সাধারণ চেতনাসম্পন্ন নাগরিক এবং সর্বোপরি এ রাজ্যের প্রশাসন কেউই নৈতিক দায় থেকে ছাড় পেতে পারেন না। যারা দিনের পর দিন এই অমানবিক প্রথাকে আমাদের উদাসীনতার আড়ালে বাড়তে দিয়েছি। যারা রাজনীতির জটিল আবর্তের বাইরে বেরিয়ে এসে গোটা ছাত্রসমাজকে এর বিরুদ্ধে এককাট্টা করবার উদারতা দেখাতে পারিনি। এ রাজ্যে আমরা তাই আজ সবাই অপরাধী, একে অপরের দিকে আঙ্গুল তোলা তাই অর্থহীন।
আমরা সবাই আশ্চর্য রকমের নির্বিকার অথবা পারস্পরিক দোষারোপে মগ্ন, তাই এখানে শিশু জন্ম নেওয়ার পরে তার বার্থ সার্টিফিকেট পেতে যেমন দালালের আশ্রয় নিতে হয়, তেমনি শিশু পাচার বা নাবালিকা বিবাহের মতো ঘৃণ্যতম অপরাধের ক্ষেত্রেও আমরা তালিকার উপরদিকেই বিরাজ করি। দারিদ্র্যই এই হতভাগ্য শিশুদের সবচেয়ে বড় অপরাধ। যে দারিদ্র্যকে একটা সময় অলংকার হিসেবে শোকেসিং করা হতো, সেই দারিদ্র্য মোচনের নামে তাকে সযত্নে লালন করাই আজকের গণসমর্থিত রেওয়াজ। আর প্রাথমিক বুনিয়াদী শিক্ষাব্যবস্থার করুণ হাল আমাদের কায়েমী স্বার্থকে মজবুত রাখতে সাহায্য করে বলেই বোধহয় গত ছিয়াত্তর বছরে গোটা দেশে এই ব্যবস্থা ঢেলে সাজাবার কথা আমরা কখনও কারও মুখে শুনিনি, কেবল পরিসংখ্যানের চমৎকারিত্বেই আহ্লাদে আটখানা থেকেছি। যদিও পরিসংখ্যানই বলে দেয়, অর্থনীতিতে বলবান হলেও গোটা দুনিয়ার নিরিখে প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার ক্ষেত্রে উন্নত দেশগুলির থেকে আমাদের দেশ এখনও অনেক পিছনে পড়ে আছে। আসলে বুনিয়াদী শিক্ষা মজবুত থাকে বলেই উন্নত দেশগুলির প্রগতির ভিতও চট করে নড়বড়ে হয় না।
এতসব বাধা বিপত্তি পেরিয়ে আমাদের যে প্রান্তিক শিশুটি বড় হয়ে ওঠে, লেখাপড়া শিখে তার মেধা প্রদর্শন করে, কলেজে বা ইউনিভার্সিটিতে এসে ভর্তি হয়, তার জন্য আমরা কোন দুনিয়া হাজির করতে পারছি, এটাই কিন্তু আজ লক্ষকোটি টাকার প্রশ্ন। ন্যুনতম শিক্ষা, পেটভরা খাবার ও সুস্বাস্থ্য যে শিশুর মৌলিক অধিকার তাকে বেঁচে থাকবার কতটুকু স্পেস আমরা আদপে দিতে পেরেছি সে প্রশ্নের উত্তর কি আমাদের কাছে আছে? তাদের মনের বাসনাগুলিকে পাখিদের মতো উড়তে দেওয়ার নীল আকাশ, সবুজ মাঠ বা বিষমুক্ত বায়ু কোনওটাই কি আমরা দিতে সক্ষম? কাকে দোষারোপ করব আমরা এই অপারগতা অক্ষমতার জন্য? কার বিরুদ্ধে মিছিল অবরোধ অবস্থান করব? আমাদের অন্তহীন ছুটে চলার ফাঁকে একটু নিভৃতে বসে কবে দুদণ্ড ভাবব এসব? যেদিন আততায়ীর করাল থাবা আমার বাড়ির বা প্রতিবেশির সন্তানের উপর এসে পড়বে সেইদিন? বড্ড দেরি হয়ে যাবেনা!
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team