১২ অগাস্ট ছিল বিশ্ব হাতি দিবস। সেই উপলক্ষ্যে আমাদের উত্তরবঙ্গের হাতিদের সংরক্ষণ নিয়ে খানিক খোঁজখবর-আলোচনা-সমালোচনা ইত্যাদি করবার উদ্দেশ্যে সাম্প্রতিক কালের খবরের কাগজের পাতা ওলটাতে গিয়েই ভীষণ মন খারাপ হয়ে গেল। দেশের আরো অনেক জঙ্গলের মতো ডুয়ার্সের জঙ্গলেও ‘হাতি দি বস’ মান্য করা হলেও উত্তরবঙ্গে হাতিদের প্রতিনিয়ত যে অস্তিত্বের লড়াই লড়তে হচ্ছে তার খবর কে রাখে বলুন তো? একদিকে যেমন হাতি-মানুষের ক্রমবর্ধমান সংঘাতে হাতি ও মানুষ দুইয়েরই জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে, অন্যদিকে ট্রেনে কাটা পড়ে হাতির মৃত্যুও কিন্তু পুরোপুরি বন্ধ করা যায়নি। বনদপ্তর ও রেলদপ্তরের সমন্বয় বা প্রযুক্তির ব্যবহারে হাতি নিধনের হারে হয়ত রাশ টানা সম্ভব হয়েছে; কিন্তু সেইসঙ্গে হাতির চোরাশিকার আচমকা বেড়ে যাওয়ার ঘটনা আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে হাতিদের মতো গুরুত্বপূর্ণ বৃহদাকার বন্যপ্রাণ উত্তরবঙ্গে আজ ফের নানানভাবে বিপন্ন।
কদিন আগেই চাপড়ামারির জঙ্গলে ট্রেনে কাটা পড়ে মারা গেল এক পোয়াতি মাদি হাতি, এবছরের প্রথম হাতি মৃত্যু যা নিঃসন্দেহে দুর্ভাগ্যজনক। এতে যে ফের নড়েচড়ে বসেছে রেল কর্তৃপক্ষ সেটা বোঝা গেল যখন রেল দপ্তর থেকে জানালো হলো ৭৭ কোটি টাকা ব্যয় করে লামডিং, রঙ্গিয়া, কাটিহার ডিভিশনের সঙ্গে আলিপুরদুয়ার ডিভিশনেও হাতিদের চলাচলের পথ সংলগ্ন রেল ট্র্যাকের পাশে বসানো হচ্ছে অত্যাধুনিক আইডিএস বা ইন্ট্রুশন ডিটেকশন সিস্টেম। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স চালিত এই প্রযুক্তি রেল ট্র্যাকের আশপাশে হাতির আনাগোনার সংকেত স্বয়ংক্রিয় উপায়ে তাৎক্ষণিক ভাবে রেলকর্মীদের জানাতে পারবে। রেল লাইন নজরদারিতে নিযুক্ত রেলকর্মীদের এবং সংশ্লিস্ট ট্রেন চালকদের এই প্রযুক্তি নিয়ে বিশেষভাবে সচেতন করার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছে।
ট্রেনে চাকায় হাতি নিধনে ফের প্রশ্ন উঠেছে রেল ও বন দপ্তরের সমন্বয় নিয়ে। কিন্তু রেল দপ্তর থেকে আশ্বস্ত করে বলা হয়েছে, এই সমন্বয় টিকে আছে বলেই গত দেড় বছরে অন্তত ৮২-৮৩টি বুনো হাতিকে রেল দুর্ঘটনার হাত থেকে বাঁচানো গিয়েছে। আরো সাবধানতা অবলম্বনের জন্য এই অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সাহায্য নেওয়া হচ্ছে।
রেল দপ্তরের এই খবর স্বস্তিদায়ক হলেও প্রকৃত স্বস্তি মেলে কই? অসম বাংলা সীমান্তে সংকোশ নদীর ধারে উদ্ধার হওয়া হাতির কাটা মাথা এবং তারপরে পা উদ্ধার হওয়ার খবর এলাকায় চোরাশিকারের সম্ভাবনাই উসকে দিচ্ছে। মধ্যিখানে কয়েক বছর যে সমস্যার খবর আমরা খুব একটা পাইনি সেই পোচিং চক্র ফের সক্রিয় হয়ে উঠলে বনকর্তাদের রাতের ঘুম যে আবার বিঘ্নিত হবে তা বলাই বাহুল্য।
আর সবার উপরে বন সংলগ্ন বসতিতে হাতির তান্ডব সরাসরি প্রমাণ করে দিচ্ছে মানুষ ও হাতির সম্পর্ক এখানে মোটেও ভাল যাচ্ছে না। মাঠে ফসল পাকার মরসুমে প্রতিনিয়ত হাতির আঘাতে কোথাও বা মৃত্যু হচ্ছে বা সঙ্কটজনকভাবে মৃত্যুর সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে স্থানীয় আদি বাসিন্দারা, কোথাও তছনছ হচ্ছে তাদের ঘরবাড়ি। কোথাও আবার দেখা যাচ্ছে লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয়ে সোলার পাওয়ারের ইলেক্ট্রিক ফেন্সিং দিয়ে গ্রাম ঘিরেও হাতির তান্ডব থেকে রক্ষা পাওয়া যাচ্ছে না।
সব মিলিয়ে বন দপ্তর তথা উত্তরবঙ্গের বায়োডাইভারসিটি আজ কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে। একদিকে হাতি যেমন সংকটে পড়েছে, তেমনই মানুষের ক্রমবর্ধমান অস্তিত্ব হাতির সাবেক চলার পথে (করিডর) মূল অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে অনিবার্য সংঘাত কোনওভাবে রোধ করা যাচ্ছে না। সদ্য অবসরপ্রাপ্ত বনপাল বিমল দেবনাথের কথায়, সোলার এনার্জাইসড ফেন্স, হাতি খায় না এমন ফসল চাষ, মৌমাছির শব্দ, গোবর লংকার গুঁড়োর ফেন্স, হাতি রোধক নালা, নজর মিনার, সার্চ লাইট ও পটকা বিতরণ, হাতি পথে কাঁটা যুক্ত গাছের চাষ, হুলা পার্টি, ইলেকট্রনিক সেন্সর ইত্যাদি হেন কাজ নেই যা গত চার দশকে করা হয়নি। কিন্তু দেখা গেছে এসবের কোনওটিই হাতিকে বেশি দিন বোকা বানাতে পারেনা। কারণ পেটের জ্বালায় ওদের যে হাঁটা দরকার। তাই ওরা বেঁচে থাকলে হাঁটবেই। হাঁটার পথে মানুষ থাকলে সংঘাত অবশ্যম্ভাবী।
কিন্তু এই সংঘাত এড়ানো কি তাহলে কোনভাবেই সম্ভব নয়? বিমল দেবনাথের কথায়, উপায় একটাই, হাতির করিডোর (পথ) নোটিফাই করে করিডোর পুনরায় তৈরি করে দিতে হবে অর্থাৎ হাতি তার চিরপরিচিত পথ বাধামুক্ত পেতে চায়। তাই হাতির হাঁটবার পথে মানুষের বসতি বা আনাগোনা থাকলে সেসব সরিয়ে দিতে হবে। এর জন্য প্রয়োজনে মানুষের স্থানান্তর করতে হতে পারে। কারণ মাথায় রাখতে হবে মানুষের বসতি স্থাপনের আগেই এই সব পথ হাতিদের ছিল। উপরন্তু সেই সব পথে হাতিদের খাদ্যের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করতে হবে।
কাজটার পরিমাপ বিশাল ও জটিল হলেও খুব একটা কঠিন নয়, প্রয়োজন কেবল সদিচ্ছার। এই সদিচ্ছার অভাব হলে সংঘাত বাড়তে থাকবে। মানুষের প্রতিরোধ ও বিস্তার যত বাড়বে হস্তীকুল তত দূরে সরে যেতে থাকবে, অদূর ভবিষ্যতে উত্তরবঙ্গের জঙ্গল থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে বইয়ের পাতায় স্থান পাবে এই প্রাণী, আর তার জন্য দায়ী থাকবে আমাদের প্রজন্মের মানুষ।
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team