দোতারাডাঙা পালার অন্যতম জনপ্রিয় পালা ‘করিম বাদশা’। করিম বাদশা পালার কাহিনি সংক্ষেপে এইরূপ, দীর্ঘকাল অপুত্রক থাকার পর সদ্যোজাত পুত্রের মুখ দেখে প্রাণ জুড়িয়ে গেল ‘করিম বাদশা’র। খুশিতে ভরে উঠল মন। উৎসব অনুষ্ঠানের আনন্দের সঙ্গে দান-ধ্যানে মেতে উঠলেন তিনি। বাদশা নিজের হাতে সাতদিন সাতরাত একটানা দান করার পর ক্লান্ত হয়ে সিপাহীদের ওপর সে ভার ছেড়ে বিশ্রামে গেলেন। এর কিছুক্ষণ পর এলেন মূর্শিদ গাজি। দান প্রার্থনা করে ঝোলা খুলে ধরলেন। বাদশার লোক আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলেন মূর্শিদের ঝোলায় যাইই দান করা হয় নিমেষে অদৃশ্য হয়ে যায় সব। খবর গেল বাদশার কাছে। আশ্চর্য এই কথা শুনে করিম বাদশা হাজির হলেন গাজির কাছে। বললেন তিনি কী চান! যা চাইবেন তাই তুলে দেবেন তাঁর হাতে। স্মিত হেসে মূর্শিদ জানালেন, তিন আঙুলের মাথায় যতটুকু মাটি ধরে ততটুকুই চাই। এই কথায় প্রবল আত্মবিশ্বাসে বাদশা মূর্শিদকে নিয়ে নিতে বললেন। গাজি তিন আঙুলের মাথায় সমস্ত পৃথিবী তুলে ধরলেন। ফলে বাদশার আর নিজের কিছুই রইল না। অথচ মূর্শিদ চাইলেন দানের দক্ষিণা। বাদশা তখন নিজেকেই তুলে দিলেন তাঁর হাতে। এতে খুব খুশি হলেন মূর্শিদ গাজি। আল্লার রূপ ধরে আশীর্বাদ করলেন বাদশাকে এবং ফিরিয়ে দিলেন সবকিছু। করিম বাদশা সুখে রাজত্ব করতে লাগলেন।
এই কাহিনিতে দশাবতারের কাহিনিগত মিল লক্ষ্যণীয়। দশাবতারের পঞ্চম অবতার বামন। দৈত্যরাজ বলির ক্ষমতা খর্ব করবার জন্য ভগবান বিষ্ণু বামন রূপে আবির্ভূত হন। দানবীর বলে খ্যাত বলি দান করতে চাইলে বামনরূপী বিষ্ণু তিন পায়ের সমান জমি প্রার্থনা করলেন। আত্মবিশ্বাসে ভরপুর বলি খুশিমনে তা দিতে চাইলেন। এইকথায় বামনের শরীর ক্রমশঃ বড় হ’তে শুরু করে। মাথা আকাশ ফুঁড়ে গেল। বামন তাঁর প্রথম পা রাখলেন স্বর্গে, দ্বিতীয় পা রাখলেন পৃথিবীতে। তৃতীয় পা কোথায় রাখবেন সে কথা জিজ্ঞাসা করতেই দৈত্যরাজ বলি হাঁটুমুড়ে বসে নিজের মাথায় তৃতীয় পদ রাখতে বললেন। এই কাহিনি আমাদের সকলেরই জানা। করিম বাদশা পালায় আমরা দেখি তা অন্যরূপে। পুরাণের কাহিনিতে মুসলিম চরিত্রের উপস্থিতি আমরা দেখি সত্যপীর পালাতেও। দুই ধর্মের নির্বিঘ্ন সহাবস্থান আমাদের এই উত্তরবাংলার প্রাচীন ঐতিহ্য। ফল্গুধারার ন্যায় বয়ে চলেছে আজও। বহিরাগত ক্ষমতা এসে এই সম্পর্ক নষ্ট করবার চেষ্টা করেছে। সফল হয়নি, হবে না—এই বিশ্বাস আমাদের আছে।
দোতারাডাঙা পালায় অনেক গানের ব্যবহার হয়। মূল গায়ক বা গীদালের হাতে থাকে তারের বাদ্যযন্ত্র দোতার। এছাড়াও সারিঞ্জা, বেহালা, বাঁশী, সানাই, ঢোল, হারমোনিয়াম প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্র ব্যবহৃত হয়। জনপ্রিয় কাহিনির সঙ্গে রয়েছে মনমুগ্ধকর অভিনয় ও সুন্দর গান। হাড়হীম করা শীতের রাতেও খোলা আকাশের নিচে খড়ের ওপর চট বা ত্রিপল বিছিয়ে পালা উপভোগ করেন দর্শক। পাঁচশো, হাজার বা অনেকসময় তারও বেশি মানুষ থাকেন এক একটি আসরে। এ এক অন্য আকর্ষণ, প্রাণের ছোঁয়া, রক্তের টান। আমরা যাঁরা ‘সুশীল সমাজে’ প্রেক্ষাগৃহ ভাড়া ক’রে মনোরম ব্যবস্থার পর নাট্যায়োজনে দর্শক পাই হাতে গোনা তাঁদের ভাবা উচিৎ। আমাদের গলদটা ঠিক কোন জায়গায়।
হুদুম-দেও
উত্তরবঙ্গের সাংস্কৃতিক গভীরতা তার গানে। গ্রামীন সমাজ জীবনে বারো মাসে তেত্রিশ পার্বণ। প্রকৃতির কোলে পিঠে মানুষ আমরা। তাই জীবন চর্যায় মূল অনুষ্ঠান প্রকৃতিকে ঘিরে। ফুল-পাতার প্রাকৃতিক উপচার যেমন সাজিয়ে নেওয়া হয় তেমনই শরীর, মন, গানও উপচার রূপে নিবেদন করা হয় প্রকৃতি পূজায়। পুজো পার্বন উপলক্ষে মেলাও বসে। আচার ধর্মী পার্বণ অনেক সময়ই উৎসবের রূপ নেয়। অনেক মানুষের মেলামেশা, ভাবের আদান প্রদান সম্পর্ককে গভীর ক’রে তোলে। আবার কিছু আচার ধর্মী পার্বণ ঘিরে উৎসব হয় না কিন্তু গ্রামের প্রতিটি মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে জড়িয়ে থাকে তাতে। কোচবিহারের ‘হুদুম-দেও’ এক আচারধর্মী ব্যতিক্রমী পূজানুষ্ঠান। মূলত মহিলাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এই অনুষ্ঠানে পুরুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ। সে অনুষ্ঠান দূর থেকেও দর্শন করা বারণ তাদের। নির্দেশ অমান্য করলে পেতে হবে কঠিন শাস্তি। সে শাস্তির ফল পেতে হ’তে পারে গ্রামের সবাইকে।
‘হুদুম-দেও’ পূজার সঙ্গে জড়িয়ে আছে আকর্ষণীয় ‘পারফরম্যান্স’। পূজা অর্চনার জরুরী অঙ্গ হিসেবে অনুষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত মহিলারা গান ও নাট্যধর্মী অভিনয় করেন। এই অনুষ্ঠান আয়োজন হয় আষাঢ়-শ্রাবন মাসে। গ্রীষ্মের প্রবল দাবদাহের পর নেমে আসে বর্ষা। কৃষিজীবি উত্তরবঙ্গে আষাঢ়-শ্রাবন এই দু’মাস ও আগে-পরে আরও পনের দিন প্রবল বর্ষার সময়। ঘন কালো মেঘ থেকে নামে প্রবল ধারার বৃষ্টি। চারিদিক সবুজ হয় আরও। কৃষিক্ষেত্রে কৃষক পরিবার গুলি ব্যস্ত হয়ে পড়ে কৃষিকাজে। মাটির বুক চষা হয়। নরম কাদা-মাটির সোঁদা গন্ধে ভরে ওঠে চারপাশ। চলে ফসল বোনার কাজ। কারুর বিশ্রামের সময় নেই। মনে আছে আনন্দ। নতুন ফসল উৎপাদনের প্রক্রিয়ায় জড়িয়ে থাকার আনন্দ।
এই স্বাভাবিক পরিবেশের ব্যত্যয় হয় কখনও। আকাশে মেঘের কণামাত্র দেখা নেই। অত্যধিক উজ্জ্বল সূর্যের প্রখর উত্তাপ পুড়িয়ে দেয় যেন। শুকিয়ে আসে খাল-বিল-পুকুর-নদী-নালা-ঝিল-দিঘি। ক্রমশঃ সবুজের সমারোহ কমে আসে। ধূসর হয় চারপাশ। মাটির বুক ফেটে চৌচির। আকাশে মেঘের দেখা নেই, বরষার জল নেই। কৃষকের চোখে জল। পল্লীকবি জসিমউদ্দিনের বুকে তাই সেই বেদনার খবর। ভাওয়াইয়া সম্রাট আব্বাসউদ্দিনের দরদী কন্ঠে সেই ব্যথার পরশ পাই আমরা।
স্বাভাবিক প্রাকৃতিক কারণে বৃষ্টি হয় না যখন, কৃষিজীবি মানুষ-জন প্রকৃতি পূজার আয়োজন নেয়। তেমনই এক আচার ‘হুদুম-দেও’। গ্রামের বিবাহিতা, কুমারী মেয়েরা ‘জল মাঙতে’ বেরোয়। এক কুমারী মেয়ের মাথায় একটি ঘটে জল থাকে। তাতে ব্যাঙের বাচ্চা রাখা হয়। রাখা হয় পান, সুপারি ও কিছু দুর্বা। ঘটের গায়ে সিঁদুরের পাঁচটি ফোটা দেওয়া হয়। এই কুমারী কন্যার বয়স হ’তে হবে সাত থেকে এগারো বছরের মধ্যে। তার মাথায় ছাতা ধরা হয়। এই মেয়েকে বলা হয় ‘ঘটধরী কুইনা’। কুইনার ডানহাত থাকে বরাভয় মুদ্রায়। সঙ্গে থাকে দশ-বারো জনে মহিলার একটি দল। এরা বাড়ি বাড়ি ঘোরে গান গাইতে গাইতে। তারা গৃহস্থের উঠোনে প্রবেশ করলে বাড়ির মহলারা হুলুধ্বনি দিয়ে তাদের স্বাগত জানায়। ঘর থেকে বেরিয়ে এসে ঘটধারী কুইনাকে প্রণাম ক’রে অনুরোধ করবে ঘট উঠোনে নামিয়ে রাখতে। এরপর ঘটে ও ছাতায় দেবে জল।
মহিলারা একে অপরকে সিঁদুর মাখিয়ে দেবে। এরপর সেই উঠোনে শুরু হবে চাষের অভিনয়। ঘড়া ঘড়া জল উঠোনে ঢেলে কাদা-কাদা করা হবে উঠোনের মাটি। তারপর দুজন অভিনয় করবে চাষের বলদ রূপে, একজন কৃষকের চরিত্রে অভিনয় করবে। বিভিন্ন রকম রঙ্গ রসিকতা করা হয়। গান গাওয়া হয়। তার সঙ্গে নৃত্য।
প্রার্থনা করা হয় ইন্দ্রের কাছে বৃষ্টির জন্য, জলের জন্য। তাকে তুষ্ট করবার জন্য যৌন উত্তেজক অঙ্গভঙ্গি করা হয়। বয়স্ক মানুষের কাছে শুনেছি অতীতে এই অনুষ্ঠানের ব্রতচারিনীগণ বিবস্ত্র থাকতেন। লোকসংস্কৃতি গবেষক শিশির মজুমদার তাঁর ‘উত্তর গ্রাম চরিত’ গ্রন্থেও তেমনটি লিখেছেন। মহিলারা বস্ত্রহীনা থকতেন বলেই অনুষ্ঠানের রাতে গ্রামের কোনও পুরুষ ঘরের বাইরে বেরুতে পারতেন না। সমাজ বিধানের এই রীতি কঠোরভাবে পালনীয় ছিল। গাঁয়ের বাড়ি বাড়ি ঘুরে মাগন সংগ্রহ ক’রে মহিলারা অন্ধকার এক রাতে উপস্থিত হয় মাঠের মাঝে। একটি ছোট্ট কলাগাছ পোঁতা হয়। স্নান করানো হয় তাকে। এরপর বারোরকম শস্য সহ ঘট স্থাপন করা হয়। তারপর শুরু হয় গীত ও নৃত্য। হাততালি দিয়ে ও ক্যানেস্তারা বাজিয়ে মহিলারা কলাগাছের চারিদিকে ঘিরে এই নৃত্য পরিবেশন করেন বৃষ্টির দেবতার উদ্দেশে। এই গানে দেবতাকে তুষ্ট করার চেষ্টা যেমন থাকে তেমনই থাকে অশ্লীল শব্দের ব্যবহার ও ভদ্র সমাজে উচ্চারণ অযোগ্য গালাগাল। দেবতাকে খারাপ খারাপ শব্দে ধীক্কার জানানো হয় বৃষ্টি না হওয়ার জন্য দায়ী ক’রে। সমস্ত শরীর মন দিয়ে মহিলারা আবাহন জানান তাকে। সেই আবেদনে থাকে নিজেকে সম্পূর্ণ সঁপে দেওয়ার আকুতি। মহিলারা বৃষ্টির দেবতা হুদুম দেও-কে বলেন আমার সবকিছু গ্রহণ করে বিনিময়ে বৃষ্টি দাও। সেই যৌন আবেদন আপাতভাবে দৃষ্টিকটু লাগতে পারে। কিন্তু চাষের জন্য, বেঁচে থাকার প্রাথমিক রসদের জন্য এই আয়োজন। এতে কোনও ভনিতা নেই। কৃষির সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের অস্তিত্বের প্রশ্ন। কৃষিভিত্তিক এই বাংলায় বৃষ্টির প্রয়োজন প্রশ্নাতীত। সে আমাদের প্রাণের নির্ভরতা। তাই মহিলারা শরীর মন সমস্ত দিয়েই বৃষ্টির দেবতাকে আহ্বান জানাতেন। নির্বিঘ্নে শষ্য উৎপাদনের জন্য চাষের ক্ষেতে নর-নারীর রতিক্রীড়া অন্যতম আচার রূপে গণ্য হয় অনেক জনগোষ্ঠীতেই। এ হ’ল বিশ্বাস। প্রাণের গভীর থেকে উৎসারিত ভক্তি শ্রদ্ধার নিবেদন। নারী তো প্রকৃতির প্রতীক। বৃষ্টির দেবতা তুষ্ট হ’লেই ভূমি উর্বর হবে।
‘হুদুম দেও’ আচারধর্মী অনুষ্ঠানটি এখন খুব কম লক্ষ্য করা যায়। পরিবর্তিত রূপে এই আচার পালনের দৃষ্টান্ত কখনও কখনও দেখা যায়। মহিলারা এখন আর নগ্ন হয়ে যোগ দেন না। তবে হুদুম দেও-কে তুষ্ট করবার জন্য যৌন উত্তেজক আঙ্গিকাভিনয় এই আচারে ব্যবহার করা হয়। কোচবিহারের কোনও কোনও গ্রামে হঠাৎ কখনও বা এই আচার সংক্ষিপ্ত রূপে দেখা যায়। কুশান পালা বা দোতারা ডাঙ্গার গান পরিবেশিত হয় অবসর বিনোদনের জন্য। আচার ধর্মী আনুষ্ঠানিক পালা যেমন বিষহরি, সাইটল, হুদুম দেও গৃহস্থের মানসিক রূপে বা সামাজিক প্রয়োজনে। বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে এই আচারসমূহ পালন করা হয়। তাতে গ্রামের প্রত্যেকের অংশগ্রহণ থাকে। এই যোগদান সতঃষ্ফূর্ত।
উত্তরবঙ্গের পালনীয় আচার সমূহ অনেকাংশেই নাট্যধর্মী। গীত-বাদ্য সহযোগে নৃত্যও এর অংশ। তাই অনেক সময়ই দর্শকের সামনে কেবল মঞ্চে উপস্থাপনের জন্য পরিবেশন করা হয়। আরও একটি বহুল প্রচলিত আচার ‘বৈরাতি নাচ’। আদতে রাজবংশী সমাজের বিয়ে উপলক্ষে গীত সঙ্গীত। বেশ কিছু বছর হ’ল বৈরাতি নৃত্য নাট্য আঙ্গিকে পরিবেশিত হয়।
রাজবংশী বিয়ের নিজস্ব ধরণ আছে। মঞ্চে তেমনই বিয়ের অনুষ্ঠান অভিনয়ের মাধ্যমে উপস্থাপিত হয়। অত্যন্ত নয়নাভিরাম এই পরিবেশনা। তাতে নৃত্য ও নাট্যের ব্যবহার অত্যন্ত সমৃদ্ধ। সাংস্কৃতিক চর্চার নব নব রূপ নতুন উদ্যমে বিভিন্ন ধারায় প্রবাহিত হয়। তা বরফগলা নদীর মতই প্রবহমান ও পরিবর্তনশীল। তাই তাতে কোনও শৈবাল গতিরোধ করে না। লোকসংস্কৃতির সার্থকতা, শক্তি তাই চিরকালীন। সমাজ জীবনের সঙ্গে মিলেমিশে থাকে সে।
(ক্রমশ)
ছবি- দোতারা পালার আসর। অঙ্কন- রুমা দত্ত
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team