"দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর"- চলো যাই সেই আদিম অরণ্যে। কিন্তু কোথায় পাবো তারে? আর কি সেই আদিম অরণ্য আছে? আছে আছে, এখনও সে আছে, হেথা হোথা, ইতস্তত। চলো তাকে খুঁজতে যাই চিলাপাতার আদিম অরণ্যে, নলরাজার গড়ে। আর থাকব অতি অবশ্যই ঘন জঙ্গলের মধ্যে মেন্দাবাড়ি জঙ্গল ক্যাম্পে।
কলকাতা বা দক্ষিণবঙ্গ থেকে আলিপুরদুয়ার বা নিউ আলিপুরদুয়ার জংশনে যাবার জন্য বেশ কিছু ট্রেন পাবেন। ট্রেন থেকে নেমে গাড়ি ভাড়া করে চলুন মেন্দাবাড়ি, দূরত্ব খুব বেশি নয়, সর্বাধিক ২০-২২ কিমি হবে। হাসিমারা স্টেশনে নামলে রাস্তা আরো কম। স্টেশন থেকে বেরিয়ে দমনপুর, পোরো, নিমতি, কোদালবস্তি হয়ে ছোট্ট ভাণ্ডারি নদীর কাঠের ব্রিজ পেরোলেই মেন্দাবাড়ি জঙ্গল ক্যাম্প। আর এই ভাণ্ডারি নদী হচ্ছে ক্যাম্প আর বন্যপ্রাণীদের মধ্যেকার প্রাকৃতিক পরিখা। সেই সঙ্গে বন্য জন্তু এবং বন্যপ্রাণের পানীয় জলের উৎস। মেন্দাবাড়ির ঘন সবুজের চাবিকাঠি।
মনে রাখবেন অন্য সমস্ত জঙ্গলের মতন ডুয়ার্স-এর জঙ্গলও বন্ধ থাকে ১৬ই জুন থেকে ১৫ই সেপ্টেম্বর অবধি। এ গল্প অবশ্য বেশ কিছুদিন আগেকার, ২০১৮ সালের।
ভাণ্ডারি নদীর নড়বড়ে কাঠের সেতু কেবল ছোট গাড়িই পেরোতে পারে। হয়তো মহাকাল বাবাদের কথা ভেবেই এই ব্যবস্থা। কিন্তু তেনারা চাইলে কে তাঁদের আটকাবে! ছোট ছোট রঙিন মাছ ও অসংখ্য জলের পোকা নদীর জলে কতরকম জ্যামিতিক নকশা তৈরি করছে, যেন পথের পাঁচালির রঙিন সংস্করণ। দিনে দুপুরে চতুর্দিকে লক্ষ কোটি ঝিঁঝিঁর ডাক। তার সঙ্গে ব্যাঙের কনসার্ট। ব্যাঙ বাবাজিরা পেট ফুলিয়ে পাথরের উপর বসে সঙ্গিনীদের গান শোনাচ্ছে। উপর থেকে নিবিষ্ট মনে সব নজর করছে কাঠঠোকরা। ক্যাম্পে ঢুকেই মন ভালো হয় গেল-বোর্ডে লেখা গুরুদেবের প্রকৃতি বন্দনা দেখে। অসাধারণ বনবাংলার সর্বত্র দুরন্ত শিল্পভাবনার প্রকাশ।
বিশাল বিশাল মহীরুহ - শাল, সেগুন, চাঁপ, লালি, আরও কত গাছ, বেশির ভাগেরই নাম জানি না। গাছ থেকে ঝুলছে কত রঙের অর্কিড। বিশাল কাঠের সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় তিন শয্যার কাঠের ঘর, লাগোয়া বাথরুম। তিন জন কর্মচারীর ব্যবহারই চমৎকার। সঞ্জয় ও রবি রাভা তো সর্বদা না ডাকলেও উপস্থিত। লাগোয়া ক্যান্টিনের রান্না অতি চমৎকার, খরচা পাতি সঙ্গত। তবে সন্ধ্যারাতে রান্নার পাট চুকে গেলে, খাবার ঢাকা দিয়ে যে যার বাড়ি চলে যাবে। এমনকী ক্যাম্পের কুকুরগুলোও বন্য জন্তু, বিশেষ করে লেপার্ডের ভয়ে সন্ধ্যাবেলা যেন কোথায় চলে যায়, আবার আসে পরদিন প্রাতে। তখন আদিম অরণ্যে আপনি একাকী, নিজের সঙ্গে নিজেই ছুটি কাটান।
সেসময় মেন্দাবাড়ি জঙ্গল ক্যাম্পে ইলেক্ট্রিক আলো ছিল না। সোলারের টিমটিম করা ভুতুড়ে আলো কিছুক্ষণ পরেই নিবে যাবে। তারপরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। এই তো সময়, আস্তে আস্তে অনুভব করতে থাকুন, জঙ্গলের নিজস্ব সত্তা, তার একান্ত নিজস্ব ভাষা। আস্তে আস্তে চোখের সামনের কালো পর্দা সরে যাবে, অনুভবে আসবে জঙ্গলের আদিম রূপ।
এখন সকাল দশটা, সদ্য ক্যাম্পে এসেছি (বর্তমানে চেক ইন/আউট টাইম কিন্তু দুপুর বারোটা)। একটু আগে সামান্য বৃষ্টি হয়েছে। অসংখ্য পাতা মাড়িয়ে, ঝিঁঝিঁর ডাক শুনতে শুনতে চললাম কোদালবস্তি। ড্রাইভার চলে গেছে রাভাবস্তিতে তার আত্মীয়ের কাছে। দুপুরে যাবো চিলাপাতার জঙ্গলে। একটি ছোট পুলিশ ক্যাম্প ও ফরেস্ট বিট অফিস আছে সামনে। আর একটা ছোট স্কুল - মেন্দাবাড়ি বনাঞ্চল প্রাথমিক বিদ্যালয়। সারা রাস্তা জুড়ে প্রজাপতির মেলা বসেছে। কাঠের পুল পেরিয়ে সামান্য একটু গিয়েছি, সঞ্জয় ও রবির সঙ্গে দেখা, ওরা ফিরছে কিছু বাজার নিয়ে। ওদের কাছে শুনলাম সামনেই এক বিরাট হস্তীযুথ জঙ্গল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। শুনে আমরা ভয়ে কাঠ, অথচ এই বাচ্চা ছেলেদুটি তো এইমাত্র হাতির পালের পাশ দিয়ে ফিরলো! তার মানে আমরাও সকালে ওদের পাশ দিয়েই গেছি, অথচ কিচ্ছু বুঝতে পারিনি। আর যায় কোথাও! ফিরে এলাম ক্যাম্পে।
দুপুরে খেয়েদেয়ে চললাম চিলাপাতার জঙ্গলে। গাইড রাখা বাধ্যতামূলক। সঙ্গে আছেন ডাক্তারবাবুর বন্ধু সঞ্জিতবাবু, সমস্ত জঙ্গল ওর নখদর্পণে। ভয়ে ভয়ে বাঁ দিকের জঙ্গল দেখছি, তেনাদের দেখা মেলে কিনা !
চিলাপাতা বলতে মনে পড়ে যায় কোচবিহারের রাজা নরনারায়নের ছোট ভাই ছিলেন চিলা রায় বা শুক্লধ্বজ। কোচবিহার থেকে অসম পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে তাঁর বীরগাথা। বাপরে সে কী ভয়ঙ্কর জঙ্গল-গহন, গভীর, নিশ্ছিদ্র অরণ্য। চারদিক নিস্তব্ধ, খালি একটানা ঝিঁঝিঁর ডাক। এখানে আছে অতি প্রাচীন ( আমার নয়, অনেক পন্ডিতদের অভিমত সম্ভবত গুপ্ত যুগে নির্মিত) নল রাজার দুর্গ। গাইড ছেলেটি একটি গাছ দেখিয়ে বললো যে এটি রামগুয়া গাছ, এই গাছটিকে খোঁচালে গাছের গা দিয়ে এক রক্তবর্ণ তরল বেরোতে থাকে। মনে পড়লো এই রক্তক্ষরণ নিয়ে একটি চমৎকার লোককথা পড়েছি গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্যর লেখাতে- এই গাছগুলি আসলে গাছ নয়। রাজা চিলারায়ের বিশ্বস্ত সৈনিকেরা মৃত্যুর পরেও গাছ হয়ে দুর্গ পাহারা দিচ্ছে। তাই আঘাত করলে এদের শরীর থেকে মানুষের মতন রক্তক্ষরণ হয়। দুর্গের সামান্য অংশই এখনো টিঁকে আছে। বাকি সব ইঁট চলে গেছে আমার/আপনার বাড়িঘর তৈরিতে। গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্যর ডুয়ার্সের ওপরে লেখা চমৎকার বইটিতে কবি সমর চট্টোপাধ্যায়-এর একটি অসাধারণ কবিতা পড়েছিলাম -
"নলরাজার গড় পাহারা দিচ্ছে আদিবাসী যুবক
দময়ন্তী প্রাতস্নান সেরে নিচ্ছে তোরষায়
বনভূমি থেকে চাঁদ,আকাশে লাফ দিয়ে ওঠে
দূরে দেখা যায় বাইসনের দল"
দুর্গতোরণের পরে আর যাওয়া সম্ভব হলো না- জঙ্গল এতোই সূচীভেদ্য। এখান থেকে চললাম চিলাপাতার জঙ্গল ভ্রমণে। এক দঙ্গল হস্তী কেন জানিনা ক্ষেপে গেছে।রাস্তায় যে গাড়ি যাচ্ছে তাকেই চার্জ করছে। দুই দিকের রাস্তাই বন্ধ। প্রায় ঘন্টাখানেক পরে ইষ্টনাম জপতে জপতে চললাম তোরষার ধারে সিসি লাইন নজর মিনারে। হাতির পাল একটা চমৎকার কাজ করেছে, সমস্ত হুজুগে ট্যুরিস্ট ভয়ে আর এদিকে আসেনি। কিন্তু আমাদেরও বিধি বাম। মাটি ফুঁড়ে কোথা থেকে সামনে এসে দাঁড়ালো এক বৃষস্কন্ধ বাইসন(গাউর)। নির্লিপ্ত চোখে কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে ফোঁস শব্দ করে আবার জঙ্গলে মিলিয়ে গেলো। রওয়ানা হয়েছি কি হইনি, এক হস্তী পরিবার চলেছে আমাদের সামনে দিয়ে, সঙ্গে গাব্দা গোবদা ছানা। আমরা বিমূঢ় বিস্ময়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। যেন ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেল দেখছি। নজর মিনার সুনসান, প্রাণভরে ডুয়ার্স-এর জীবন বৈচিত্র লক্ষ্য করতে করতে, মহাকাল বাবাদের উদ্দেশে প্রণাম করলাম। উনাদের দয়াতেই আজ এতসব দৃশ্য দেখতে পেলাম।
আকাশ আস্তে আস্তে কালো হয়ে আসছে। রওয়ানা হলাম মেন্দাবাড়ি ক্যাম্প। ভাণ্ডারি নদীতে কালো কালো ওগুলো কী দেখা যাচ্ছে? এক বাইসন পরিবার অবাক বিস্ময়ে আমাদের দেখছে! ড্রাইভার অতি বাচ্চা ছেলে, কিন্তু প্রাণশক্তিতে ভরপুর। ভয়ে আমরা মরছি, যদি তাড়া করে, ও কিন্তু নির্বিকার। ঘন কালো মেঘের মধ্যে দিয়ে প্রায় প্রাণ হাতে করে ফিরে এলাম মেন্দাবাড়ি ক্যাম্প সন্ধ্যা সাতটায়। আমাদের নামিয়ে দিয়ে ড্রাইভারকে নিয়ে সঞ্জিতবাবু ফিরে গেলেন। কোনোগরকমে রাতের খাবার সেরে ঘরেও ফিরিনি তখন, শুরু হলো প্রচন্ড ঝড়। কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না, ধুলোয় ঢেকে গেছে চারদিক। কর্মচারীরা রাতের খাবার ঢাকা দিয়ে আগেই যে যার বাড়ি চলে গেছে। সোলার ভূতুড়ে আলোও দেহত্যাগ করল। নিকষ কালো রাতে আমরা তিনটি প্রাণী, দৌড়ে ঘরে ঢুকতে গিয়ে আছাড় খেয়ে পায়ে তো চোট পেলাম, সঙ্গে মোবাইলের শুধু চোট নয়, সঙ্গে ফ্র্যাকচারও, গ্লাস ভেঙ্গে চৌচির। জঙ্গল এডভেঞ্চারের ফটোর জন্য অগত্যা ডাক্তারবাবু আর সঞ্জিতবাবুর তোলা ছবিই ভরসা।
শুরু হলো ভয়ঙ্কর বৃষ্টি, ঘন ঘন বাজ পড়ছে। যেন আর বাংলায় নেই, পৌঁছে গেছি রিকটারভেল্ট পর্বতমালার উপরে বিভূতিভূষণ এর বর্ণিত 'চাঁদের পাহাড়ে'। জেনে এসেছিলাম যে সেদিন পূর্ণিমা অথচ অমাবস্যার রাতকেও হার মানায় সেই নিকষ কালো আধাঁর। টর্চের আলো জ্বালিয়েছি, কত রকমের যে পোকা উড়ে আসছে তার ঠিক নেই। ক্রিকেট বলের সাইজের একটা কালো পোকা, সঙ্গে কাঁকড়ার মতন দাঁড়া, সশব্দে কাঠের মেঝেতে এসে আঘাত করলো। সত্যি বলতে কী বেশ ভয়ই পেয়েছিলাম সে রাতে। রাত দশটা নাগাদ ঝড় বৃষ্টি থামলো। এর পরেই ঘটলো সেই অলৌকিক ঘটনা- বনজ্যোৎস্নার সবুজ অন্ধকারে। সেই তিমির আচ্ছাদিত স্তব্ধ রাতের আঁধারে হঠাৎ শুরু হলো বন্যহাতির সমবেত বৃংহতি। সেই ভয়ঙ্কর বুক কাঁপানো ডাক এত কাছ থেকে যে না শুনেছে, সে কল্পনাও করতে পারবেনা, চারটে অসহায় মানবের উপরে তার কী সাংঘাতিক প্রতিক্রিয়া হতে পারে! আশ্চর্যজনক ভাবে কিছুক্ষনের মধ্যেই আবার জঙ্গল শান্ত হয়ে গেল। একদম নিঃশ্চুপ। ঝড়ো হাওয়া থেমে গেছে।
এর পর থেকে যা ঘটলো তাকে ভাষায় বর্ণনা করা সম্ভব নয়। সে রাতের মতন ছায়াবিহীন জ্যোৎস্না জীবনে আর কখনও দেখিনি।গাছের প্রতিটি পাতা, ঘাসের ডগায় ঝুলন্ত জলকণা, সমস্ত কিছু পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। আরণ্যক-এর সত্যচরণের ভাষায় বলি-"চারিধারে চাহিয়া সেই নীরব নিশীথরাত্রে জ্যোৎস্না ভরা আকাশ তলে দাঁড়াইয়া মনে হইল এক অজানা পরী রাজ্যে আসিয়া পড়িয়াছি -মানুষের কোন নিয়ম এখানে খাটিবে না।"
শেষ রাতের দিকে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছি। সকালে রবি রাভার ডাকে ঘুম ভেঙে গেল। ওর কাছেই শুনলাম পুলের ওধারেই মহাকাল বাবাদের এক বিশাল দল দাঁড়িয়ে আছে। ক্যাম্প থেকে খুব বেশি হলে ৫০০মিটার। হে ভগবান! তোমার অশেষ করুণা। রাত্রিবেলা তো ইচ্ছা করলেই ওরা এখানে এসে হামলা করতে পারতো। বুঝলাম, এই হাতির দলটাই গতকাল দুপুরে চিলাপাতার জঙ্গলে কোনো কারণে সবাইকে চার্জ করছিল।
ব্রেকফাস্ট খেয়ে সকাল ১০টায় বেরিয়ে দেখা পেলাম পুরো দলটিকে। অন্তত দশটা হাতির দল, সব শান্তশিষ্ট হয়ে গাছের পাতা খাচ্ছে। এবার আর কেউ তেড়ে এলো না। প্রাণভরে ওদের ছবি ও ভিডিও নিয়ে জয় গণেশ বলে চললাম পরবর্তী গন্তব্যে।
মেন্দাবাড়ি জঙ্গল ক্যাম্পের প্রচন্ড চাহিদা। আমরা যখন গেছি তখন ঘর ভাড়া বেশ কম ছিল, শুনেছি যে বর্তমানে ঘর ভাড়া ২২০০টাকা এবং তদূর্ধে। অনলাইনে যোগাযোগ করুন- west bengal state forest development agency র ওয়েব সাইটে। ওদের হেল্প লাইন 8145584286/ 9434860604. চেক ইন/ আউট টাইম দুপুর ১২ টা, সঙ্গে প্রত্যেকের ফটো আইডি কার্ড রাখবেন। বর্তমানে সরকার অনুমোদিত ব্লু হোম স্টে চালু হয়েছে মেন্দাবাড়িতে। দেখতে শুনতে তো বেশ ভালোই, সস্তাও পড়ে ঘর ভাড়া। এখানে থাকার জন্য সরাসরি সঞ্জিতকে ফোন করলেই হবে। ছোট পরিবার হলে আলিপুরদুয়ারের সঞ্জিত রায়-এর সঙ্গে ঝামেলা মুক্ত ট্রিপে যাওয়া যায়, আপনি খালি গিয়ে উপস্থিত হবেন, বাকি দায়িত্ব সঞ্জিতবাবুর (৯৭৩৩২৮২৭২২ )।
ছবি- সঞ্জিত রায় ও ডঃ তিলক পুরকায়স্থ
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team