পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি জনস্তরে চলছে জাতিসত্তার অন্বেষণ। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা জাতিগত দাঙ্গার আত্মঘাতী সংঘাতের রূপ নিচ্ছে। নানা জাতি স্রোতের মহাসাগর এই ভারতবর্ষকে সেই অভিশাপে, বলতে গেলে ঔপনিবেশিক শাসনের কুফলের প্রভাবের শাস্তি ভোগ করতে তার নানা কোণে কোণে সেই জনজাতির দাঙ্গার আগুনে দগ্ধ হতে হচ্ছে। মনে রাখতে হবে এই সমস্যা কোনো আইন শৃঙ্খলার সমস্যা নয়। এই সমস্যা কোনো রাজনৈতিক সমস্যা নয়। তবু শাসক একে আইন শৃঙ্খলার সমস্যার নামে প্রশাসনের রক্তচক্ষুর বজ্র শাসনে সমাধানের চেষ্টা করে। রাজনৈতিক নেতারা এই সমস্যাকে সমাধানের পরিবর্তে তাদের রাজনৈতিক স্বার্থের জারক রসে জারিত করে তাদের স্ব স্ব রাজনৈতিক মৃগয়ায় টোপ হিসাবে ব্যবহার করে সেই জাতিদাঙ্গার আগুনকে আরো উস্কে দেয়।
লেখক সৌমেন নাগ তাঁর লেখায় নিরলস ভাবে দীর্ঘ দিন ধরে এই জাতিসত্তা ও জাতি ‘উপজাতি’র সমস্যার গভীরে প্রবেশ করে তার কারণগুলি নিয়ে আমাদের সচেতন করতে চেয়েছেন। এই লেখকের ‘কাঞ্চনজঙ্ঘার অশান্তির আগুন’ বইতে পাহাড়ে সুবাস ঘিসিঙ-এর এমন উল্কার গতিতে উত্থানের কথা আগেই প্রকাশিত হয়েছিল। তাতে তিনি আগাম সতর্ক বাণী দিয়েছিলেন জাতিসত্তার দাবি শান্ত হিমালয়ে আগুন জ্বালাতে পারে। এরপর ‘প্রসঙ্গ গোর্খাল্যান্ড আন্দোলন’ তারপর ‘গোর্খাল্যান্ড আন্দোলন ও বাঙালির জাত্যাভিমান’ এবং ‘বিচ্ছিন্নতার উৎস সন্ধানে কামতাপুর থেকে উত্তর পূর্ব ভারত’ - পাহাড় থেকে সমতলের বিভিন্ন জাতিসত্তার অবদমিত অভিমান কীভাবে তাদের বিচ্ছিন্নতাবোধের দিকে ঠেলে দিয়েছে ও দিচ্ছে তার সমগ্র তথ্য পাঠকের দরবারে হাজির করে দেশের সংহতির প্রশ্নে এই অভিমানগুলিকে দূর করার আশু প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছিলেন।
উত্তর পূর্ব ভারতে ছোট্ট সুন্দর এক রাজ্য মনিপুর যখন জাতিদাঙ্গার অগ্নিকুণ্ডে পরিণত হয়ে সবাইকে হতচকিত করে দিয়েছে তখন রাজনৈতিক দলগুলির সেই চিরাচরিত রাজনৈতিক মৃগয়ার পরিবর্তে এর মূল কারণগুলি জানার জন্য অধীর আগ্রহে সাধারণ মানুষ অপেক্ষা করছিল। পরিচিত প্রকাশনী সংস্থা ‘এখন ডুয়ার্স’ সৌমেন নাগের ‘বিচ্ছিন্নতার উৎস সন্ধানে উত্তরবঙ্গ থেকে উত্তর-পূর্বে’ বইটির পরিমার্জিত সংস্করণ প্রকাশ করে যেন অগনিত পাঠকের সেই বহু প্রতীক্ষিত অপেক্ষার অবসান ঘটাতে এগিয়ে এসেছেন।
উত্তরপূর্ব ভারতকে বলা হয় জনজাতির যাদুঘর। এত বিশাল সংখ্যার জনজাতির সমাবেশ বা বসতি ভারত তো বটেই পৃথিবীর কোনো দেশে আছে বলে জানা নেই। সমস্যা ও বিষয় বিশাল। লেখক প্রতিটি সমস্যার গভীরে প্রবেশ করে এর উৎসকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছেন। ফলে বইটির কলেবর বৃদ্ধি হওয়া স্বাভাবিক। প্রকাশক লেখকের সেই স্বাধীনতা দিয়েছেন বইটি হাতে নিলে ও পড়লেই বোঝা যায়।
লেখক শুরু করেছেন জাতিসত্তার সহজাত আবেগ ও বিচ্ছিন্নতা বোধের চরিত্র ও উৎস নিয়ে। বঞ্চনার অভিমানের সঙ্গে সংখ্যাগরিষ্ঠতার অহমিকা কী ভাবে সংখ্যালঘু জনজাতির মনে বিচ্ছিন্নতা বোধের জন্ম দেয় এবং দেশ বিরোধী শক্তি তাদের কীভাবে বিচ্ছিন্নতাবাদের দিকে টেনে নিয়ে যায় তার তথ্য সমৃদ্ধ আলোচনা করেছেন।
দার্জিলিঙ পাহাড় থেকে শুরু করে সমতলে কামতাপুর দাবি, অসমিয়াদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারানোর আতঙ্ক, বোড়োদের জাতিসত্তার দাবি হয়ে মেঘালয়ে নেপালী খেদার সর্বনাশা মানসিকতার উৎস সন্ধান, সেখান থেকে লেখক উপস্থিত হয়েছেন মিজোরামের মিজোদের মনের কথা জানতে। নাগাল্যান্ডের নাগাদের বিভিন্ন গোষ্ঠী ও তাদের মধ্যে ঐক্য ও বিরোধ এবং বিচ্ছিন্নতার লড়াই এই আলোচনায় জায়গা পেয়েছে। এসেছে ত্রিপুরায় তিপরা জনজাতির অবস্থান ও তাদের দাবি এবং বিচ্ছিন্নতার দাবি ও ককবরক ভাষা নিয়ে আলোচনা এই বইতে জায়গা পেয়েছে। লেখক পৌছে গেছেন সুদূর অরুণাচল প্রদেশে। সেখানেও আছে জনজাতিদের মধ্যে নানা সমস্যা। এই স্পর্শকাতর রাজ্যে এ বিষয়ে যে এখনই ভাবা দরকার সেই ব্যপারে লেখক সতর্কতার প্রয়োজনের কথা বলেছেন। মিজো এবং রিয়াঙদের বিবাদ মেটানোর কথাও বলা হয়েছে।
মনিপুরের কুকিদের সঙ্গে সমতলের মেইতেইদের বিরোধ এবং কুকি নাগাদের এই বিরোধ তো বহুদিনের। কংগ্রেস শাসনে ঘটেছে। বিজেপি শাসনেও ঘটছে। সমস্যা তো রাজনৈতিক নয়। সমস্যা জাতিসত্তার। লেখক বলেছেন ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদীরা যখন সহজাত স্বাধীনতার আবহে প্রতিপালিত এই জনজাতি গোষ্ঠীর রাজত্বকে তাদের সাম্রাজ্যের অধীনে এনে অন্য কোনো রাজ্যের সঙ্গে তাদের সাম্রাজ্যের স্বার্থেই যুক্ত করেছিল তখন তারা ভাবে নি স্বাধীন প্রিয় এই জনজাতিদের নিজস্ব সংস্কৃতি, সামাজিক জীবন এর ফলে কতখানি রক্ষিত হবে।
এই বইটির আরেকটি মূল্যবান সংযোজন হচ্ছে বহু ঐতিহাসিক দলিল এখানে যুক্ত করা হয়েছে একই সঙ্গে বিপুল সংখ্যক সহায়ক গ্রন্থের উল্লেখ আছে। যারা উত্তরবঙ্গ তথা উত্তর পূর্ব ভারতের এই জন বৈচিত্র্য নিয়ে গবেষণা করতে চান তাদের কাছে এই বইটিতে অসংখ্য তথ্য নৈবেদ্যর থালার মতন সাজিয়ে দেওয়া হয়েছে।
এই প্রয়োজনীয় মুহূর্তে এমন একটা বই পাঠকের দরবারে উপহার দেওয়ার জন্য প্রকাশক ও লেখককে ধন্যবাদ। প্রচ্ছদ শুধু যে দৃষ্টিনন্দন তাই নয়, বিষয় নিয়ে ইঙ্গিত বাহী। মুদ্রণ বিন্যাসে আছে সাবধানী ছোঁওয়া। এত বিশাল বইতে একটা দুটো যে বানান ভুল আছে তা ধরার মতন নয়।
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team