কী হত যদি বৈকুন্ঠপুরের রাজারা ইংরেজদের সাথে মিত্রতা চুক্তিতে আবদ্ধ হয়ে পরিণত হতেন দেশীয় রাজ্যে? যেমনটা হয়েছিল কুচবিহার। অবশ্যি ধারে এবং ভারে কুচবিহার যে বৈকুন্ঠপুরের তুলনায় অনেক এগিয়ে ছিল তা অনস্বীকার্য, কিন্তু স্বাধীনতা ঘোষণার কালে সাড়ে পাঁচশোরও বেশি দেশীয় রাজ্যের সবগুলিই যে আকারে বড় ছিল এমন নয়। ক্ষুদ্র রাজ্যও কম ছিল না নেহাৎ। সুতরাং আয়তনে ছোট হলেও বৈকুন্ঠপুর হতেই পারত একটা দেশীয় রাজ্য।
কিন্তু তা হয় নি।
এই না হওয়াটাই ছিল টাউন জলপাইগুড়ির পক্ষে অতি গুরুত্বপূর্ণ একটা ঘটনা। এমনিতে দেশীয় রাজ্যগুলির নিরাপত্তার দায়িত্ব ইংরেজরা নিয়ে নেওয়ার ফলে দেশীয় রাজাদের কাজকর্ম বিশেষ ছিল না। এদের অধিকাংশই আমোদ-প্রমোদ-শিকার এবং লন্ডনে বান্ধবীদের নিয়ে ফূর্তি করার কাজে ব্যস্ত থাকতেন। কেউ কেউ অবশ্য সাহিত্য-সংগীত চর্চায় মনোনিবেশ করেছিলেন। তবে সকলেই কমবেশি নিজেদের রাজ্যে আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও স্থাপন করেন। কিন্তু এই রাজ্যগুলি বিংশ শতকের গোড়ায় জেগে ওঠা এক উত্তেজনাপূর্ণ অধ্যায় থেকে দূরে থাকতে বাধ্যও হয়েছিল।
সেই উত্তেজনাপূর্ণ অধ্যায়টি ছিল স্বদেশী আন্দোলন।
বস্তুতঃ দেশীয় রাজ্যগুলি তাদের রাজ্যের মধ্যে এই ধরনের কিছু করতে পারত না। যা ইংরেজ শাসনের বিরোধী তা ছিল দেশীয় রাজ্যগুলিতে নিষিদ্ধ। ঠিক এই কারণেই কুচবিহার রাজ্য অন্য বিষয়ে মন দিলেও বঞ্চিত ছিল এই উত্তেজনা থেকে। রাজারা অবশ্য কলকাতায় গিয়ে স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথে যুক্ত লোকজনদের উৎসাহ যোগাতে পারতেন, কিন্তু নিজের রাজ্যে এইসব করার অর্থ ছিল রাজত্ব হারান।
বৈকুন্ঠপুর যদি দেশীয় রাজ্য হিসেবে থেকে যেত আর জলপাইগুড়ি টাউন যদি হত সেই রাজ্যের রাজধানী তবে তার চেহারা হত অন্য রকম। বিংশ শতকের প্রথম ভাগে এসে সে টাউন হয়ে উঠত না রাজনৈতিক আন্দোলনের অন্যতম কেন্দ্র। রাজবাড়ির পুকুরের ধারে গড়ে উঠত না সশস্ত্র আন্দোলনের স্বপ্ন দেখা যুবকদের আখড়া। চিত্তরঞ্জন দাশের সাথে গড়ে উঠত না টাউনের সম্পর্ক। প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতি হিসেবে লোমখাড়া করা বক্তব্য রাখতেন না সুভাষচন্দ্র। করলা নদী লাগোয় বিরাট ময়দানে সভা করতেন না মোহনদাস কর্মচন্দ গান্ধী।
আর জগদীন্দ্রদেব রায়কতও হাল ধরতেন না জেলা কংগ্রেসের।
এই যে নেটিভ স্টেট না হয়ে উঠতে পারা, এই যে বৈকুন্ঠপুরের রাজাদের জমিদারে পরিণত হওয়া --- এটাই ছিল টাউন জলপাইগুড়ির এক বিরাট সুযোগ। চা শিল্পের আবির্ভাবকে কেন্দ্র করে গত শতকের প্রথম ভাগ থেকেই টাউনের অর্থনীতি সমৃদ্ধ হচ্ছিল। শিল্পপতিরা, ব্যবসায়ীরা, শিক্ষিত মধ্যবিত্তরা কখনো প্রকাশ্যে কখনো গোপনে টাউনের রাজনৈতিক কর্মকান্ডের প্রযোজক হয়ে উঠছিলেন। যুবকদের সামনে খুলে যাচ্ছিল দেশসেবার নতুন দিগন্ত।
গোড়া থেকেই টাউনের দুটো ভাগ। একটা ভাগ ইউরোপীয়। বর্তমান পোস্টাপিসের মোড় থেকে যে রাস্তা দক্ষিণে চলে গেছে তার বাঁ দিক ধরে করলা নদী বরাবর ইংরেজদের বসতি। সে যেন ছোট্ট এক টুকরো বিলেত। ক্লাব, ঘোড়দৌড়ের মাঠ, ছিমছাম বাড়িঘর, উদ্যান আরো কত কী! বিলেতের সেই টুকরোটি ছিল দেশিয় মানুষের কাছে নিষিদ্ধ। রবার গাছের জঙ্গলের ফাঁক দিয়ে ভেসে উঠত তার চেহারা। টাউন স্টেশন থেকে কিং সাহেবের ঘাট পর্যন্ত মালপত্র সহজে বহনের জন্য রেল লাইন।
এই ‘বিলেত’-এর বাইরে বাকি টাউন। ‘তরাই উৎরাই’ নামক স্বরচিত উপন্যাসের একটুখানি এই প্রসঙ্গে তুলে দিলে আশা করি আপনারা কিছু মনে করবেন না।
“উপেন গায়ে চাদর জড়িয়ে যাচ্ছিল কদমতলার দিকে। শহরটায় পাকা আর বড়ো বাড়ি ঘর খুব একটা নেই। বেশির ভাগই টিনের খড়ের চাল ছাউনি দেওয়া কাঠের বাড়ি। এরমধ্যে যে বাড়িগুলোর দেয়াল পাকা বলে মনে হচ্ছে, তা আসলে বাঁশের ওপর সিমেন্টের প্রলেপ লাগান। উপেনের মনে হয়েছিল যে এখানে কলকাতার কিছুই সে পাবে না। আস্তে আস্তে বুঝেছে অনেক কিছুই পাওয়া যায়। মামার মতে বড়ো জোর হাজার পঁচিশ লোক থাকে শহরে। শিক্ষা-দীক্ষার ব্যাপারে লোকজনের বেশ উৎসাহ। জেলা স্কুল বাদ দিলেও বেসরকারী স্কুলের অভাব নেই। উপেন যে রাস্তা দিয়ে হাঁটছিল তার দু –পাশে বেশ কয়েকটা ব্যাংক। উত্তর থেকে দক্ষিণে থানার দিকে চলে যাওয়া এই ছোট্ট রাস্তাটিকে শহরের লোকের ডাকে ‘ক্লাইভ স্ট্রিট’ বলে। লাল ইটের পর পর কয়েকটা দোতলা বাড়ির একটা হলো আর্য ব্যাংকের ভবন। উপেন সেই রাস্তায় একটা চক্কর কেটে যাচ্ছিল কদমতলার দিকে। শোভার জন্য রবীন্দ্রনাথের বই কিনতে হবে।
“উপেন লক্ষ্য করেছে খুব শহরের খুব কম বাড়িই বেড়া বা প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। এক রাস্তা থেকে আরেক রাস্তায় যেতে শর্টকাট হিসেবে এর ওর বাড়ির উঠোন ব্যবহার করাটাই অলিখিত নিয়ম। কেউ কিছু মনে করেনা। গোড়াতে উপেনের অস্বস্তি হত, এখন সে খানিকটা রপ্ত হয়েছে। আরেকটা জিনিসও সে রপ্ত করছে বঙ্কিমের কাছ থেকে। সেটা হলো দেশি ভাষা। এই ভূখন্ডের আদি মানুষেরা প্রায় সকলেই রাজবংশী। এঁদের ভাষা উপেনের কাছে গোড়াতে দুর্বোধ্য মনে হত। কলকাতার আসে-পাশে গা-গঞ্জের ভাষার সঙ্গে কোনো মিল নেই তাঁদের ভাষার। অথচ মামা এমন কি শোভাও দিব্যি বলতে পারে এই ভাষা। জলপাইগুড়ি শহর গড়ে ওঠার পর নানা প্রান্ত থেকে ভাগ্যান্বেষী মানুষ এসে ভিড় জমিয়েছে এখানে। রাজবংশীদের কাছে এরা সবাই ভাটিয়া বা ভাটি দেশের লোক।
“কদমতলায় আসতে আসতে অন্ধকার নেমে এলো। বই-এর দোকানদার পেট্রোম্যাক্সের আলোটা জ্বালাবার চেষ্টা করছিলেন। একটি ছেলে একটু ঝুঁকে সেই চেষ্টার দিকে তাকিয়েছিল। উপেন ছেলেটাকে চিনতে পারল। কয়েক দিন আগে বঙ্কিমের সঙ্গে ঘটকবাড়ির পেছন দিয়ে বেগুনটারির দিকে শর্টকাটে হাঁটার সময় এই ছেলেটা বঙ্কিমকে দাঁড় করিয়ে কী জানি আলোচনা করেছিল। উপেন পরে জেনেছিল ছেলেটার নাম মহেন্দ্র।”
শরতে পুজোর মুখে টাউন স্টেশনের একটা লাইনে এসে দাঁড়াত হরেক মাল বোঝাই কয়েকটা রেলের কামরা। সেটাই দোকান। কলকাতার বাজার থেকে সেরা জিনিস বাছাই করে সেজে আসত সেই রেলদোকান। টাউনের মানুষ ভিড় জমাত স্টেশনে পুজোর বাজার করার জন্য। সে কালে চা বাগানের শ্রমিকদের বেতন ছিল তুলনায় বেশ ভালো। পুজোর আগে বাড়তি টাকা পেয়ে তাঁরাও ভিড় জমাতেন স্টেশনের শপিং মল-এ। দূর-দূরান্ত থেকে আসতেন বিত্তশালী মানুষেরা।
শেয়ালদা থেকে এক রাত্তির জলপাইগুড়ি টাউনে পৌঁছবার রেল ব্যবস্থা সে কালের নিরিখে উন্নত যোগাযোগের দৃষ্টান্ত। এটাই ছিল দার্জিলিং যাওয়ার পথ। এই রেল যোগাযোগের কারণেই টাউন জলপাইগুড়ি হয়ে উঠেছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কলকাতা থেকে দার্জিলিং-এর পথ ধরা যাত্রীরা ভোর ছটায় এই স্টেশনে নেমে চা পান করতেন। সেই উৎকৃষ্ট দার্জিলিং চায়ের সুবাসে ভরে উঠত স্টেশন। তখনো সিটিসি আসে নি।
আরেক দিন এই স্টেশন ভরে উঠেছিল শোকার্ত মানুষের ভীড়ে। দার্জিলিং-এ মারা গেলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস। টাউনের সাথে তাঁর সম্পর্ক ছিল। তাঁর মরদেহ সেদিন টাউনের স্টেশনে এনে রাখা হয়েছিল যাতে টাউনবাসী শেষ নমস্কারটি জানাতে পারে।
টাউনের মূল রাস্তার নাম আজো ডিবিসি রোড বা দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন রোড।
(চলবে)
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team