× home হোম archive আগের ওয়েব সংখ্যা panorama ডুয়ার্স সম্পর্কে play_circle_filled ভিডিও file_download মুদ্রিত সংখ্যার পিডিএফ library_books আমাদের বইপত্র
people এখন ডুয়ার্স সম্পর্কে article শর্তাবলী security গোপনীয়তা নীতি local_shipping কুরিয়ার পদ্ধতি keyboard_return বাতিল/ফেরত পদ্ধতি dialpad যোগাযোগ
login লগইন
menu
ad01112021105753.jpg
×
সংখ্যা: ভাদ্র, ১৪৩০
সম্পাদকের কলম
ডাকে মুক্তি
সম্পাদক - এখন ডুয়ার্স
ধারাবাহিক প্রতিবেদন
উত্তরবঙ্গের লোকসংস্কৃতি ও সংস্কৃতির লোকজন | পর্ব - ১২
সব্যসাচী দত্ত
উত্তরের জনজাতি
যে সম্প্রদায়ের নারীরা বিধবা হয় না
প্রমোদ নাথ
দুয়ার বার্তা
উত্তরে সংঘাতে সংকটে প্রকৃতই বিপন্ন হস্তীকুল: সমাধানের পথ কী?
প্রদোষ রঞ্জন সাহা
কোচবিহার অনলাইন
বোগেল সাহেবের ডাইরিতে তিব্বত-যাত্রার পথে কোচবিহারে রাত্রি যাপন
সৌরভ ঘোষাল
শিলিগুড়ি স্টোরিলাইন
শিলিগুড়ির পাড়া কলোনি সরণী বেয়ে
নবনীতা সান্যাল
জলশহরের কথা
এক যে ছিল টউন | পর্ব - ৫
শুভ্র চট্টোপাধ্যায়
উত্তরের বইপত্র
আজকের জাতিদাঙ্গার উৎস সন্ধানে এক জীবন্ত দলিল
অর্ক দেব
পর্যটন
এক অবাক অরণ্যের দিনরাত্রি
সুজাতা পুরকায়স্থ
নেট গল্প
পুরনো সে নক্ষত্রের দিন
রম্যাণী গোস্বামী
আমচরিত কথা
ফেলে আসা শিক্ষকবেলা
তনুশ্রী পাল

প্রচ্ছদ ছবি

এই সংখ্যার প্রচ্ছদ শিল্পী গৌতমেন্দু রায়

ফেলে আসা শিক্ষকবেলা

তনুশ্রী পাল
Fele Asa Shikshakbela

পাশটাশ করে একটা কাজের জন্যে মুখিয়ে আছি তখন। নারীপুরুষ নির্বিশেষে চাকরি মানে নিরাপত্তা আর ইচ্ছেপূরনের চাবিকাঠিই তো বটে। কত অচেনা, আধা-চেনা গ্রামেগঞ্জে ইন্টারভিউ দিয়ে, শুকনো মুখে ঘুরে ফিরে তবে গে স্থায়ীপদে কর্মপ্রাপ্তি। নিত্যই বিজ্ঞাপন দেখে দেখে, সাদা কাগজে হাতে লেখা আবেদনপত্র পাঠাই, সঙ্গে যায় মার্কশীট ইত্যাদির প্রতিলিপি।  জেরক্স মেশিনও আসেনি তখন। কাগজে স্কেল টেনে টেনে অনেক যত্নে, অনেকটা সময় নিয়ে সার্টিফিকেট আর মার্কশীটের কপি বানিয়ে রেডি রাখি। বিজ্ঞাপন দেখলেই সব কাগজপত্র খামে ঢুকিয়ে সযত্নে নামঠিকানা লিখে পোস্ট করাই কাজ। কালেভদ্রে ডাক পেলে আসল কাগজপত্র সহ হাজিরা দেওয়া। ইন্টারভিউ স্থলে গিয়ে প্রায়ই দেখা হয় সিনিয়র বা ক্লাসমেটদের কারও কারও সঙ্গে। অন্যান্যদের খবর পাওয়া যেত, অমুকে সরকারি দপ্তরে, তমুকে ব্যাঙ্কে, স্কুলে বা অন্য কোথাও কাজে ঢুকেছে। বুকের মধ্যে তখন চিনচিনে ব্যথার অনুভূতি, সেটা কিঞ্চিৎ ঈর্ষায় না অন্য কারণে বলতে পারিনা।

স্থায়ী কর্মপ্রাপ্তির আগে মাস তিনেকের জন্যে স্থানীয় এক বিদ্যালয়ে ডেপুটেশন ভ্যাকান্সিতে মাস্টারির সুযোগ মিলেছিল। দূরত্ব সামান্য তবু বাবার তাড়নায়  দশটা বাজতেই বাড়ি থেকে বেরোতে হত। তাঁর বক্তব্য, মাস্টার দেরিতে আইলে ছাত্ররা নিয়মশৃঙখলা শিখবে কার কাছ থিকা? কিন্তু মুস্কিল হল অশিক্ষক কর্মচারী দিদিটির মোটেও পছন্দসই হলনা আমার এই আগেভাগে এসে পড়াটা। তখন তিনি স্টাফরুম পরিস্কার করেন, ফিল্টারে জল ভরেন, চক-ডাস্টার রোল-কলের খাতা টাতা, আরও সব গুছিয়ে রাখেন। বেশ ব্যস্ত থাকেন। তবে কর্মই ধর্ম এই মন্ত্রেই দীক্ষা তাঁর এমনটা নয়। আসলে অফিসঘরে আরেকজন কর্মীও এসে পড়েন ওইসময়ে। অন্যান্য স্টাফেরা আসবার আগে পর্যন্ত এটুকু তাঁদের দুজনার একান্ত সময়। সেখানে মূর্তিমান উৎপাতের মতো আমার সাতসকালে আগমন মোটেই প্রীতিপদ ছিলনা তাঁদের কাছে। পূর্ব পরিচিতা দিদিটি ঝাড়ুর যথার্থ ব্যবহারে স্টাফরুমের টেবিল ও মেঝে থেকে এমন ধুলোবালি ওড়াতে লাগলেন সেখানে টেকাই দুস্কর! মুখে বলেন, এত তাড়াতাড়ি আসার কী দরকার তোমার? এগারোটায় আসলেই মেলা। রাস্তায় গিয়া দাঁড়ায় থাকোগা। আমি নাকে আঁচল চেপে বাইরে বেরোই বাধ্য হয়ে।

এরপর সেই নতুন স্কুল। বাড়ি থেকে দূরত্ব কম নয়। কতশত নিত্যযাত্রীদের সঙ্গে পরিচয় হল। হাসি ঠাট্টা, মজা, সিট নিয়ে মন কষাকষি, খোঁচানো কথা, ঝগড়া, বন্ধুত্ব, পাত্র-পাত্রী, নিন্দেমন্দ, সংবাদ চালাচালি, তার সঙ্গে মদনদেবতার তীরাক্রান্ত কতিপয় পুনর্জুটি। শেখা হল বাসে সিট রাখার বিচিত্র পদ্ধতি, যাত্রী সাধারণের মুখ দেখেই বুঝে ফেলা তার 'ভমিটিং টেন্ডেন্সি' আছে কিনা ইত্যাদি। আর অনবদ্য যাত্রাপথটি ভোলবার নয়! সে মুগ্ধতা আজও তেমনই। তিস্তা পেরিয়ে, ছোটবড় গ্রামগঞ্জ পেরিয়ে গরুমারা জঙ্গলের মধ্য দিয়ে আট কিলোমিটার পথ। জানালা দিয়ে ঢুকে আসে জঙ্গলের তাজা গন্ধে ভরা মিঠা বাতাস। মাঝে মধ্যে বনদেবীর সন্তানদের দেখাও পাই; বাইসন, লেপার্ড, রাস্তা পেরোয় যূথবদ্ধ হাতি, ময়ূরপঙ্খী আঁচল উড়িয়ে একডাল থেকে অন্যডালে বসে ময়ূর, বাচ্চাকে বুকে জড়িয়ে গাছের শাখায় বসে থাকে বানর-মা। ঋতুতে ঋতুতে বদলে যায় অরণ্যের রূপ! ফেরার পথে দেখি শালবনের আড়ালে আড়ালে রঙের তুফান তুলে পাটে বসছেন অর্কদেব। কেউ চেয়ে দেখুক চাই না দেখুক প্রকৃতিদেবী সাজিয়ে রাখেন নিজেকে।

দৈবাৎ গাড়ির চাকা ফেঁসে জঙ্গলে দাঁড়িয়ে পড়ে বাহন, চাকা পালটানো ইত্যাদি চলতে থাকে। বন পেরিয়ে দুটি কুঁড়ি একটি পাতার সবুজ জাজিম, ছায়াগাছ। মহিলারা চা-পাতা তুলছেন। লেবার লাইন, কোয়ার্টার খানিক এগিয়ে হাট বাজার, অল্পকিছু দোকানপাট, মনুষ্য বসতি।  আশপাশের চা-বাগান আর ছোটো ছোটো লোকালয় থেকেই ছাত্রছাত্রীরা আসে। সাদরি, নেপালি, বাংলা আর রাজবংশী ভাষী ছেলেমেয়েরা এখানে পড়তে আসে। স্কুলটির প্রাথমিক পর্ব নির্মিত হয়েছিল স্থানীয় এবং ওপার বাংলা থেকে আগত মানুষদের উৎসাহ আর চেষ্টায়। প্রথম দর্শনেই জায়গাটা মুগ্ধ করে। অরণ্য আর পাহাড়ের কোল ঘেঁষে ছোট লোকালয়। একটা স্বাস্থ্যকেন্দ্র, ছোট্ট রেলওয়ে স্টেশন, পাওয়ার স্টেশন, কিছু শ-মিল, গলাগলি এই হাইস্কুল আর এক প্রাইমারি স্কুল।

কী যে শান্ত আর সবুজ! যেন এক নতুন দেশে এসে হাজির হয়েছি। এইয়া মোটা দেহকান্ডযুক্ত  বিরাট বিরাট সব গাছ রাস্তার দুধারে! তেভাগা আন্দোলনের বিশিষ্ট সৈনিক চারণকবি লাল শুকরা ওঁরাও তো নিকটেই মেটেলিতে থাকতেন। সাদরি ভাষায় গণ জাগরণের গান রচনা করেছেন। স্কুলের কাছেই মঙ্গলবাড়ির গয়ানাথের খেলানে ঘটে যাওয়া তেভাগা আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী ছিলেন লাল শুকরা ওঁরাও। বিরাট সবুজমাঠের একপ্রান্তে টানা বারান্দাওয়ালা দালান। বারান্দায় দাঁড়ালে চোখে পড়ে পাহাড়ের গা বেয়ে মেটেলিতে উঠে যাচ্ছে কত গাড়ি! মাঠে প্রতিদিন ফুটবল খেলে ছাত্ররা, পিটি ক্লাসে নানা ব্যায়াম শেখানো হয়, কাবাডি, খোখো খেলে ছাত্ররা। ইন্টারক্লাস ফুটবল টুর্নামেন্ট হয় ছেলেদের, মেয়েদের কাবাডি। স্কুলে উৎসবের আবহ তৈরি হয় জমজমাট বাৎসরিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা ঘিরে। হাইজাম্প, লংজাম্প কী দারুণ পারফরম্যান্স। চিতাবাঘের মতো দৌড়য় একেকটা ছেলে মেয়ে!

যজ্ঞ অঞ্জলি খিচুড়ি আর ছেলেমেয়েদের হাতের কাজ নিয়ে প্রদর্শনী সরস্বতী পুজোয়। অভিভাবক আর প্রাক্তন ছাত্রেরা দলবেঁধে আসে। পুজোটা করেন স্কুলেরই সংস্কৃত শিক্ষক, ছোটখাটো চেহারার পন্ডিত মশাই। কে জানে কী উদ্দেশ্যে তিনি বারান্দা দিয়ে হেঁটে গেলেই সিক্স সেভেনের ছাত্রেরা ঘিরে ধরে তাকে ঢিপ করে প্রণাম করে বলে,'স্যার আশীর্বাদ দ্যান, ও স্যার আমাকে দিলেন না! আমাকে দ্যান।' বৃষ্টি শুরু হলেই ঘিরে ধরে বলবে,'স্যার বৃষ্টি কয়টায় থামবে স্যার? আজকে রেনিডে দিবে, ও স্যার বলেন না।' পন্ডিত স্যার বলেন,'এখন যা তোরা, তিনটায় বৃষ্টি থামবে। যাঃ।' সত্যিই মাঝেমধ্যে ওনার কথামত থেমেও যায় বৃষ্টি। তুমুল বর্ষায় একেকদিন নাইন টেনের ছেলেরা ফুটবল নিয়ে নেমে পড়ে মাঠে, পিটি স্যারের দেখাদেখি আরও কয়েকজন স্যারও প্যান্টগুটিয়ে নেমে পড়েন জল থৈথৈ মাঠে। কাদাজল মেখে বলের পিছে ছুট আর আছাড় খাওয়া চলতে থাকে। আমরা ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে সানন্দে চিৎকার করি।

একটা সেশান শেষ হয়, রেজাল্টের দিন, হাসিকান্নার করুণ দৃশ্য। অকৃতকার্য শুকনো মুখের ছাত্রদের দিকে চাইতে পারিনা। ছাত্রীদের অবস্থা আরও করুণ, ফেল করলে অভিভাবকেরা আর পড়াতে চান না। অন্যবাড়িতে পাঠাতে হবে, তার পিছনে এত কষ্টের পয়সা ব্যয় করা কেন, আবার বিয়েও তো দিতে হবে। সুতরাং বিয়ে দিয়ে দাও। অনুভব করেছি ব্যর্থতা তাদের যতটা আমাদেরও ততটাই! আমাদের বলতে শুধু শিক্ষকরা নন, পুরো ব্যবস্থাটার কথা বলছি। আমি যে শহর থেকে পড়াতে যাই সে শহরের বিভিন্ন স্কুল থেকে বোর্ডের পরীক্ষাতেও রাজ্যস্তরে কৃতিত্ব দেখিয়েছে ছাত্রছাত্রীরা; তাদের মধ্যে হয়তো অর্থনৈতিক দিকে দুর্বল পরিবারের ছেলেমেয়েও থাকে। অবশ্যই তাদের মেধা, শ্রম, চেষ্টারই ফলশ্রুতি ভালো রেজাল্ট। কিন্তু ভাষা সমস্যা তত তীব্র নয়। বাংলা, ইংরেজি, হিন্দি মিডিয়ম স্কুল আছে। সমর্থ ও সচেতন অভিভাবকের সংখ্যা তুলনায় বেশি।

আমার মনে হয়েছে চা-বাগান অধ্যুষিত অঞ্চলের প্রকৃত বিদ্যাশিক্ষার হার বাড়াতে চাইলে প্রাথমিক স্তরেই সে চেষ্টা শুরু হওয়া চাই। চাবাগানের হিন্দি মাধ্যম প্রাথমিকে পড়ে বাংলা মাধ্যম হাইস্কুলে ক্লাস ফাইভে এসে এত দ্রুত সব শিখে নেওয়া কঠিন, ছাত্র মেধাবী হলেও।
তখনও সরকারি তরফ থেকে মিড-ডে মিল, পোশাক, সাইকেল, জুতো এসবের ব্যবস্থা হয়নি। শিক্ষায়, অর্থনৈতিক দিক থেকে অনেক পেছনে পড়ে আছে এই প্রান্তিক জায়গার বেশিরভাগ পরিবার। পাঠ উপকরণের অপ্রতুলতা, পোশাক আশাক, যানবাহন, খাবার, স্কুলের ফি, বাগান থেকে বিদ্যালয়ের দূরত্ব সব নিয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জ ছাত্র তথা অভিভাবকদের সামনে। ফরেস্ট ভিলেজ থেকে বা চা-বাগান থেকে স্কুলে আসবার পথ তত সহজ তো নয়! সব বাগান থেকে স্কুলবাসের ব্যবস্থাও ছিল না তখন।

আরেকটি গুরুতর  কঠিন সমস্যা মনে হত ভাষাগত দিক থেকে। স্কুলে শিক্ষক ছাত্রকে শিখনে সাহায্য করতেই যান, সেখানে দান ও গ্রহণের বিষয়টি প্রধান; ভাষার সূত্রেই চলে এ প্রক্রিয়া। শিক্ষকের পাঠদানের ভাষা বা উচ্চারণ ছাত্র অনুধাবন করতে না পারলে সে বিষয়ের মধ্যে ঢুকতেই পারবেনা। তাতে পাঠদান বিষয়টি সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়ে যায়। বিশেষ করে প্রত্যন্ত চা-বাগান থেকে আগত সাদরি ভাষী ছাত্রদের সমস্যাই বেশি মনে হত। ভাষা সম্পর্কে প্রাথমিক জ্ঞান না থাকলে এত আ-কার ই-কার যুক্তাক্ষর সমন্বিত বাংলা শব্দের অর্থ, বানান, ব্যাকরণ; ইতিহাস, ভূগোল, বিজ্ঞানের শব্দ প্রতিশব্দ বোঝা তো সহজ নয়। ইংরেজি তার গ্রামার, অঙ্ক আটকে গেলে বাড়িতে বুঝতে সাহায্য করবে কে? আসলে আনন্দের সঙ্গে শিক্ষা গ্রহণের অনুকূল পরিস্থিতি কোথায়? সেখানে পরীক্ষা, রেজাল্ট, পাশ বা ফেলের মাহাত্ম্য বা গুরুত্ব কোন জায়গা থেকে পরিমাপ করা সম্ভব? কীভাবেই বা 'অজ্ঞানতা থেকে জ্ঞানের আলোর স্পর্শে আলোকিত' হবে হৃদয়? শিক্ষক হিসেবে অতৃপ্তি থেকেই যায়!

বিশ্বপরিবেশ দিবসে ছাত্র শিক্ষক মিলে গাছ লাগানো হয়৷ অরণ্যদিবসে বনদপ্তরের আমন্ত্রণে তাদের ব্যবস্থাপনায় ছাত্র শিক্ষকেরা মিলে গরুমারা জঙ্গল সাফারি হল। শিক্ষক দিবসে গায়ক শিল্পী খেলোয়াড়  শিল্পপতি  নর্তক  লেখকদের কঠোর শ্রম আর সংগ্রামের গল্প শোনাই তাদের। শোনাই পর্যটক হিউয়েন সাংয়ের কঠিন অভিযাত্রার কথা। ক্লাস শেষের ঘন্টা পড়ে, ছাত্ররা এসে প্রণাম করে, কত সুন্দর সব কথা লিখে লাজুক মুখে চমৎকার কার্ড উপহার দেয়। আনন্দে ভরে যায় মন, ঈশ্বরের কাছে তাদের মঙ্গল প্রার্থনা করি। একবার শিক্ষক দিবসে এক প্রাক্তন ছাত্র তার গানের শিক্ষককে নিয়ে হাজির, সে তার প্রিয় স্কুল আর শিক্ষকদের নিয়ে নাকি নতুন গান লিখে সুর দিয়েছে। প্যাঁ পো সজোরে বাজিয়ে নিয়ে গানের শিক্ষক নাকি সুরে গান ধরেন, কিন্তু একী! স্কুলের ভাঙা জানালা, ভাঙা বাথরুম, জল চোঁয়ানো ক্লাসরুম আর প্রত্যেক টিচারের নিন্দেমন্দ করে গান। বেলা দিদিমণি ইতিহাস পড়ায় না নিজেই পড়ে কিছুই বোঝা যায়না, অমুক স্যার সেই ভুল করেছে, তমুকে ওই করেছে! টিউশনি করে অমুকে, তমুকে পরীক্ষার আগেই প্রশ্ন বলে দেয় প্রাইভেটের ছাত্রদের। একদল ছাত্র ফিকফিক করে হাসছে আরেক দলের মুখ গম্ভীর! প্রথম হতচকিত ভাব কাটতেই অনুষ্ঠান বন্ধ করে হারমোনিয়াম সহ তাদের বিতাড়ন করা হল। তবু পরিবেশ কেমন থমথমে। সবার মুখ গম্ভীর।

দীর্ঘদিন চাকরি করে স্বেচ্ছাবসরে সরে এসেছিলাম কর্মজগৎ থেকে। কিন্তু আত্মার গভীরে জড়িয়ে গেছে সেইসময়, বিস্ময় আর ভালবাসায় মাখামাখি সারি সারি উজ্জ্বল মুখগুলো। সহকর্মীদের অনেকেই অবসরে গেলেন, কেউ কেউ অন্যলোকের যাত্রী হলেন। সাইকেল, মিডডে মিল, আরও নানান প্রকল্প এল, অবশ্যই অনেক ছাত্রছাত্রীদের সুবিধা হলো। চলে আসবার আগে দেখলাম জঙ্গল কেমন পাতলা হয়ে আসছে, প্রচুর হোটেল, রিসর্ট গজিয়ে উঠেছে। গাড়িঘোড়া, লোকজন, জনবসতি সবই সংখ্যায় বেড়েছে। রাস্তার ধারের সেই প্রকান্ড গাছগুলো কিছু দাঁড়িয়ে আছে, কিছু বিদায় নিয়েছে চিরতরে। অনেক নতুন শিক্ষক এসেছেন, স্কুলও এখন আর তেমনটি নেই, উঁচু দেওয়াল ঘেরা, বিরাট ফটক ও প্রচুর কক্ষ নিয়ে বৃহদাকার ধারণ করেছে। অরণ্যদিবসে লাগানো গাছগুলো কতগুলো অনেক বড়ো হয়েছে, কিছু বেঁচে নেই।

প্রাক্তন ছাত্রদের সঙ্গে দেখা হয়ে যায় পথেঘাটে, নিজেরাই চিনে এগিয়ে আসে, পরিচয় দেয়, কুশল সংবাদ নেয়। একজন বলল মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ, নার্সিং হোমে ভর্তি নিয়ে কোনও অসুবিধে নেই, ব্যস একটা ফোন। ভ্রামরি দেবীর মন্দিরে পুজো দিতে গিয়ে দেখা হয় এক ছাত্রীর সঙ্গে। স্বামীর সঙ্গে জমিজায়গা চাষবাস দেখাশোনা করে, মুরগীর ফার্ম আছে, আবার শনি মঙ্গলবারে মন্দিরে ভিড় হয় বলে পুজো উপকরণ নিয়ে দোকান দিয়ে বসে। যে যার মত করে লড়াই জারি রেখেছে তারা সবাই হাসিমুখে। জীবনের নানা মোড়ে স্বেচ্ছায় হারিয়ে যাওয়া ছেলেমেয়েদের মুখগুলো মনে পড়ে যায়। আজও প্রত্যেক বছর বোর্ডের পরীক্ষার ফলাফল লক্ষ্য করি। জেলা শহরের রেজাল্ট আর চা-বাগান অধ্যুষিত অঞ্চলের রেজাল্টে সেই ফারাক আদৌ মেটেনি তো এতগুলো বছরে। মূল রোগটা ধরে তো চিকিৎসা হবে! সেটা কী আদৌ হচ্ছে? হবে কি কোনও দিন? আজ এতবছর পরে সেসব পানে চেয়ে দেখি কড়া-তেতো-মিঠে সব অভিজ্ঞতা ছাড়িয়ে কেবল মায়াটুকুই জেগে আছে!

এই সংখ্যার সূচী

করোনা কালের প্রতিবেদন ফ্রি রিডিং

Disclaimer: Few pictures in this web magazine may be used from internet. We convey our sincere gratitude towards them. Information and comments in this magazine are provided by the writer/s, the Publisher/Editor assumes no responsibility or liability for comments, remarks, errors or omissions in the content.
Copyright © 2025. All rights reserved by www.EkhonDooars.com

Design & Developed by: WikiIND

Maintained by: Ekhon Dooars Team