'পাওয়ার হাউস' হয়ে উঠবার অফুরন্ত হাউস হিমালয় বাংলার প্রতিবেশি সিকিমকে যে কোনওদিন অস্তিত্ব সংকটে ফেলে দিতে পারে, যার ফলে বিপন্ন হয়ে উঠতে পারে উত্তরের বিস্তীর্ণ এলাকার জল-জঙ্গল-জনসত্তা, আমাদের সেই বহু আলোচিত আশঙ্কা অবশেষে সত্যি হয়ে দেখা দিয়েছে। ছোট্ট করে হলেও মানুষের যথেচ্ছাচারের যে প্রাথমিক জবাব দিয়েছে প্রকৃতি, তাতেই বেসামাল হয়ে পড়েছি আমরা। তিস্তার রুদ্র মূর্তির ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা উত্তর সিকিম। তিস্তার করাল গ্রাসে ভেসে গিয়েছে শখানেক মানুষ, অসংখ্য পশুপাখি, বিষয়আশয়, পরিবহণ পরিকাঠামো। মোট ক্ষয়ক্ষতির আর্থিক অংক এখনও নিরূপণ করা যায়নি। পর্যটক সহ শয়ে শয়ে আটকে পড়া মানুষকে ইতিমধ্যে সেখান থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। প্রাকৃতিক বিপর্যয় মোকাবিলার বাহিনী ও সেনাবাহিনীর জওয়ানরা দিনরাত এক করে উদ্ধার কর্মের পাশাপাশি স্বাভাবিক জনজীবন পুনরুদ্ধারের আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন, যেমনটা তাঁরা করে থাকেন।
সত্যি বলতে একদিনের এই হড়পা বানে তিস্তা নদীর দুপারের সিকিম পুরোটাই ক্ষতিগ্রস্ত, সে রাজ্যে প্রবেশের মূল পথই উড়ে গিয়েছে নদীগর্ভে। আর বলাই বাহুল্য, এই ভয়াবহ প্লাবনের প্রভাব পড়বে সিকিমের আসন্ন পুজোর মরসুমের পর্যটন বাণিজ্যে। যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে হাজার হাজার মানুষের জীবিকা ও সংস্থান। বিকল্প ঘুরপথে দিয়ে গ্যাংটকে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে, দার্জিলিং দিয়ে দক্ষিণ ও পশ্চিম সিকিমের পথেও চলবে টুরিস্ট গাড়ি, কিন্তু তা সত্ত্বেও বিপুল ক্ষতিকে কতটা সামলানো যাবে সন্দেহ আছে। কারণ ভীত সন্ত্রস্ত সমতলের পর্যটক বেশিরভাগই এবার পাহাড় এড়িয়ে চলতে চাইছেন। আর এই ধরণের প্রাকৃতিক বিপর্যয় যদি উত্তরাখণ্ডের মতো বারংবারের ঘটনা হয়ে দাঁড়ায় তবে আগামী দিনে পর্যটন বাণিজ্যই অবধারিত মুখ ফিরিয়ে নেবে সিকিম থেকে।
তিস্তাকে দুমড়ে মুচড়ে নিংড়ে নেওয়ার দুঃসাহসিক প্রয়াস নিয়ে গত দু দশক ধরে সোচ্চার হয়েছে নানা স্তরের মানুষ, কিন্তু কান দেননি সিকিম সরকার। এই বিপর্যয়ের পর আজ টনক নড়েছে সরকারের, তাঁরা স্বীকার করছেন পূর্বতন সরকারের বেপরোয়া মনোভাবই আজ সিকিমের মতো পাহাড়ি রাজ্যের অস্তিত্ব বিলীন হওয়ার জন্য দায়ী। সিকিমের সাধারণ মানুষও পথে নেমেছেন গণ প্রতিরোধে। কাল এই পাহাড়ি উপত্যকার কী ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে তা অনিশ্চিত! কাল প্রকৃতি ফের কতোটা বিরূপ হবে তাও অজানা। কে জানে কাল একটা সিকিমের বিনিময়ে পৃথিবী হয়ত পেতে চলেছে সাস্টেইনেবল ডেভলপমেন্ট-এর এক করুণ পাঠ।
এদিকে সমতলে বরষণ-মন্দা-বন্যা-রাজনীতির রোষ উপেক্ষা করে মহামায়ার আগমনী বার্তা ঢুকে পড়েছে বিপন্ন বাঙালির ঘরে ঘরে। তাই শেষবেলায় একটু একটু যেন জাগতে চাইছে ঘুমন্ত বাজার। হাতে পড়ে কটা দিন, তার মধ্যেই যতটা সম্ভব জুটিয়ে নেওয়া যায় বেঁচে থাকার রসদ, কোনওমতে চালিয়ে নেওয়াটাই যে এখন আমাদের মূলমন্ত্র। প্রশ্ন হচ্ছে, লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা ব্যয়ে যে উৎসব মরসুমের সূচনা হতে চলেছে সেই আনন্দ মরসুমে মানুষ তার চিরাচরিত আবেগ ভালোবাসাকে সত্যিই খুঁজে পাচ্ছে কতটা? পরবাসী তরুণ হৃদয় আজ কতটা উদ্বেলিত হয় বাড়ি ফেরার অমোঘ টানে? সেই যে কবে থেকে শেকড়ের টান আলগা হতে শুরু করেছে আমাদের, সেই দিন থেকে একটু একটু করে মুছে যেতে শুরু করেছে প্রাণের আরাম। আজ এইটলেন মহাসড়কে শরণার্থী সবাই, কবে যেন মান আর হুঁশ খুইয়ে আশ্রয় নিয়েছি দুধারের পায়রার খোপে, ঘড়ি ধরে আকন্ঠ গিলে চলেছি মদিরা ও মেডিসিন, আর প্রজনন চালিয়ে যাচ্ছি অবিরত, পিঁপড়ের সংখ্যা ছাড়িয়ে যাওয়ার সদর্প নেশায়!
কাল যদি কোনও লোনাক লেকের মহাপ্লাবন ভাসিয়ে নিয়ে যায় আমাদের এই যাবতীয় অহং, রোশনাই, বিলবোর্ড, চাড্ডি-বানিয়ান, তবে তুমি কি ফিরিয়ে দেবে আমাদের সেদিনের সেই অবুঝ সবুজ শৈশব, হে জগজ্জননী, মাগো!
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team