‘আমি একটা পাহাড় কিনতে চাই, বিনিময়ে আমি একটা নদী দিতে পারি।’ সত্যি সুনীলবাবু একদম ঠিক বলেছিলেন। যার লেখা পড়ে আমাদের মনের বয়স একুশ পেরিয়েছিল, যৌবনকে চিনিয়েছিল, বুঝতে শিখেছিলাম যন্ত্রণাগুলোকে কী করে ভুলে থাকতে হয়। এখন তাই বুঝতে পারি এই বিখ্যাত লাইনের তাৎপর্য। সত্যি যদি আমার একটা পাহাড় থাকতো, যখন খুশি চলে যেতে পারতাম। এখন অবশ্য আমার সেরকমই অবস্থা। মন ভালো হয়ে যায় ওই পাহাড় দেখে, মন ভালো হয়ে যায় পাহাড় জঙ্গলের বুক চিরে তিরতির করে বয়ে চলা এক চিলতে নদীর জলের শব্দ শুনে। হারিয়ে ফেলতে ইচ্ছা করে নিজেকে ওই বিশালতার মাঝখানে। আমি ক্যালেন্ডারে দিন দেখতে থাকি যে কবে একসাথে দু তিনটে দিনের টানা ছুটি পাব আর ছুটে যাব সেই রূপকথার অচিনপুরীতে, যার রূপ দেখব দুচোখ ভরে একেবারে কাছ থেকে।
এবারের গন্তব্য ছিল তাকলিং বলে একটি জায়গা, পাহাড়ি জঙ্গলের মাঝে। সত্যি কথা বলতে কী এই যাব যাব আর সেই যাওয়া নিয়ে প্রচুর প্ল্যান করব মনে মনে এই ব্যাপারটাই আরো বেশি করে মনকে উত্তেজিত করে তোলে। বহু খুঁজে খুঁজে গুগল ম্যাপ ঘেঁটে এই জায়গাটির সন্ধান পেয়েছিলাম। গুগল ম্যাপে দেখতে পেয়েছিলাম পাহাড় জঙ্গলের মাঝে একটা সুইমিং পুল। অদ্ভুত লেগেছিল ব্যাপারটা। ম্যাপ জুম করে দেখলাম ওটা একটা হোমস্টে। নাম ডন্বো ইন। নামটাও বেশ স্বতন্ত্র, এর আগে এ ধরনের নাম কিন্তু শুনিনি কোথাও।
এই হোমস্টেটি চালান এক নেপালি দম্পতি। তবে তাঁদের নাম আমার ঠিক মনে নেই। এর জন্য সত্যিই দুঃখিত। আমি অবশ্য দিদি আর দাদা বলেই কাজ চালিয়েছিলাম। এঁরা দুজনেই সকালে বেরিয়ে যেতেন নিজেদের কাজে আর ফিরতেন বিকেল চারটার পরে। দাদা সিঙ্কোনা প্লান্টেশন-এর অফিসে কর্মরত আর দিদি কোনও ব্যাংকিং এজেন্সির সাথে যুক্ত। রান্নাবান্না করে দিতেন একজন বয়স্ক মহিলা। বেশ সুস্বাদু ছিল তার হাতের রান্না। গেস্টদের থাকবার জন্য দুটো রুম রয়েছে, আরো একটা রুম তৈরি হচ্ছে ওপরের তিনতলায়। বেশ বড় বড় রুমগুলো। আর সব রুম থেকেই বেশ ভালো ভিউ পাওয়া যায়। সন্ধে নামার পর থেকেই পাহাড়গুলোতে আলো জ্বলে ওঠে, একদিকে আকাশের তারা আর নিচে পাহাড়ের আলো সব যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়, স্বপ্নের মত। জানালার সামনে একটা টেবিল আর দুটো চেয়ার রয়েছে। এখানে বসে এই অপার্থিব দৃশ্য দেখতে দেখতে সময় কেটে যাবে।
আর পাঁচটা হোমস্টের মতনই সুন্দর ছিমছাম সাজানো গোছানো। তবে একে অন্যদের থেকে আলাদা করা যায় শুধু এর অনবদ্য লোকেশনের জন্য। দুভাবে আসা যায় এখানে। প্রথমটি শিলিগুড়ি সেবক-তিস্তাবাজার হয়ে পেশক রোড ধরে, আর দ্বিতীয়টি আমার প্রিয় রুট। কার্শিয়াং জোড়বাংলো হয়ে ডানদিকে মোড় নিয়ে লামাহাটা পেরিয়ে পেশক রোড ধরে বেশ খানিকটা এগিয়ে ডানদিকে সারস্বত হাইস্কুলকে রেখে একটি বাঁকে পৌঁছে আবার ডান দিকে নিচে জঙ্গলের পথ ধরে এগিয়ে যেতে হবে। এভাবেই কিছু পরে রাস্তার ওপর থেকেই দেখা যায় এই হোমস্টেটি। সেখানে নিজের যানটিকে রেখে সিঁড়ি ধরে নিচের দিকে নেমে যেতে হবে, একটা ছোট ঝোরা পেরিয়ে পৌঁছে যাওয়া যায় ডমবো ইন্-এ। সেবক-তিস্তাবাজারের রাস্তা অ্যাভয়েড করাই ভালো, কারণ এটি পাহাড়ের ব্যস্ততম রাস্তা এবং মাঝে মাঝেই এখানে বিশেষত বর্ষাকালে ধ্বসের জন্য রাস্তা বিপদসংকুল হয়ে ওঠে। তাই দ্বিতীয় পথই বাঞ্ছনীয়, ট্রাফিক অনেক কম, তাই পলিউশন লেভেলও কম। সব মিলে একটা আলাদা ভালোলাগা তৈরি হয়।
এখানে থেকে ঘুরে নেওয়া যায় তাকদা, তিনচুলে, রংলি-রংলিওট টি এস্টেট, লামাহাটা, চটকপুর ফরেস্ট ইত্যাদি জায়গাগুলো। আরেকটু নিচের দিকে বড়া মাংওয়া, ছোটা মাংওয়া এইসব ভীষণ সুন্দর সব পাহাড়ি গ্রামগুলো রয়েছে। একদিন দুদিনের জন্য বেশ সময় করে ঘুরে আশা যায়। আর সব থেকে মজার ব্যাপারটা হলো এখানে পাহাড় হলেও অতটা ঠান্ডা নেই, যার কারণে এখানকার বেশিরভাগ হোমস্টেগুলোতেই সুইমিং পুল রয়েছে, বিশেষ করে বরামংওয়া এবং ছোটা মাংওয়াতে। আমাদের হোমস্টের সুইমিংপুলটিতে অবশ্য আমরা নামতে পারিনি তার কারণ তখন সেটির জল পরিষ্কার করা হচ্ছিল। অবশ্য তাতে কোনও দুঃখ নেই, জায়গাটা এত সুন্দর, চারপাশটা জঙ্গলে ঘেরা। এই জঙ্গলের কী যে নাম তা ঠিক জানিনা। তবে প্রচুর পাখি চোখে পড়ছিল। রাতের বেলায় দু একটা লেপার্ডের সঙ্গে সাক্ষাৎ হওয়াটাও অস্বাভাবিক কিছু ছিলনা। একটা গা ছমছমে রোমাঞ্চকর পরিবেশ রয়েছে । সবমিলে বেশ জমজমাট একটা অভিজ্ঞতা হয়েছিল।
এখানে থাকা খাওয়ার খরচ জনপ্রতি ১৪০০ টাকা আর এর বাইরে কোনও খাবার নিতে চাইলে তার জন্য আলাদা করে দাম ধার্য করা হয়। এখানে আসতে চাইলে শেয়ারের গাড়িও রয়েছে আবার গাড়ি রিজার্ভ করেও আসা যায় শেয়ারের গাড়িতে খরচটা একটু কম পড়বে। যোগাযোগের জন্য 8016590674 এই নাম্বারে ফোন করে রুম বুকিং করা যায় এবং জায়গাটির সম্পর্কে অন্যান্য তথ্যও জেনে নেওয়া যায়।
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team