যাকে বলে পায়ের নীচে সর্ষে, আমার তাই। সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়ছি। আর বেরোতে না পারলেও মনটা ঘুরে বেড়ায় সব সময়। আমাদের হাতের কাছেই উত্তরবঙ্গের তিন জেলা, যার প্রতিটা বাঁকেই সৌন্দর্য। পাহাড়, নদী, সমতল, চা বাগান, জঙ্গল। প্রকৃতি আমাদের দুহাত ভরে দিয়েছে। আমরা তার কতটুকু রাখতে পারছি আর কতটুকু নয় সে আলোচনা অন্য অবসরে করা যাবে। আজ শুধু ছুটির আমেজে প্রকৃতির হাতছানির গল্প।
কজন বন্ধু মিলে ঠিক হলো একদিনের জন্যে কোথাও ঘুরে আসি। কোথায় যাবো? একেক জনের মুখে একেক নাম। ঠিক হলো সস্তাসুন্দর প্ল্যান, সকালের ট্যুরিস্ট স্পেশাল ট্রেনে ডুয়ার্স যাব। যেমন ভাবা তেমন কাজ, পরদিন সকালে বেরিয়ে পড়লাম চার বান্ধবী। ট্যুরিস্ট স্পেশাল এনজেপি থেকে ছাড়ে সকাল ৭.২০ তে। শিলিগুরি জংশনে রাইট টাইম সকাল ৭.৪০। এই ট্রেনের সাথেই আছে দুটো ভিস্তাডোম কোচ। যেটা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত, কাঁচের মস্ত জানালা, এমনকি ছাদেও কাঁচ, চেয়ারগুলো ৯০ ডিগ্রি ঘোরে। এলাহি ব্যাপার। ভাড়াও তেমনি এলাহি। দুবছর আগে ৭৫০টাকা ছিলো। এখন সম্ভবত বেড়েছে। তবে আমাদের আগেই চড়া হয়ে গেছে বলে সাধারণ কোচেই যাওয়া স্থির হলো। সওয়া সাতটার মধ্যে চলে এলাম স্টেশনে। শিলিগুড়ি জংশনে টিকেট কাটার সময় আবার একপ্রস্থ আলোচনা, চালসা না রাজাভাতখাওয়া, আমাদের গন্তব্য কী হবে? শেষে ঠিক হলো চালসাই যাওয়া যাক।
এপথের শুরু থেকেই প্রকৃতির স্পর্শ মাখা। ট্রেন চলেছে গুলমা চা বাগানের মধ্যে দিয়ে, চারিদিকে উজ্জ্বল সবুজ মনটাকেও সবুজ করে দেয়। এরপর শুরু হলো মহানন্দা অভয়ারণ্য। যদিও এ পথে অনেকবার এসেছি তবু বারবার নতুন মনে হয়। এ পথে হাতির আনাগোনা, অন্যান্য বন্যপ্রাণীও আছে তাই ট্রেন চলছে ধীরে। দুচোখ আটকে আছে জানলার বাইরে, যদি কিছু দেখা যায়। হাতি হরিণ না পেলেও ময়ূর-ময়ূরীর দেখা মিললো দুবার। দেখতে দেখতে এসে গেল সেবক, তিস্তা, সুন্দরী তিস্তা। আরো চমক আছে। সেবক পার করেই পরপর দুটো টানেল। যদিও বেশি বড়ো নয় তবু যখন নিকষ অন্ধকারে ডুবে যাই, বেশ শিহরণ লাগে। যতবার যাই ততবার। ট্রেন ছুটছে কখনো চাবাগান কখনো জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে। কখনো সবুজ মখমল কখনো শাল সেগুন, জারুলের জঙ্গল। এটা মে মাস, চারিদিক জারুল ফুলের বেগুনি রঙে উজ্জ্বল। ট্রেনলাইনের সাথেই চলেছে ন্যাশনাল হাইওয়ে ৩১সি। এর মধ্যেই আমরা একে একে পার করে এসেছি বাগরাকোট, ওদলাবারি, ডামডিম, মালবাজার। ঘড়িতে ৯.৩০, চালসা আসতেই হুড়মুড় করে নামলাম।
স্টেশন পেরিয়ে চলে এলাম চালসা মোড়ে। এখান থেকে তিন রাস্তা চলে গেছে তিনদিকে। আমরা এলাম পশ্চিম মানে শিলিগুড়ি-মালবাজারের দিক থেকে। পুবে চলে গেছে নাগরাকাটা, বিন্নাগুড়ি, হাসিমারা, রাজাভাতখাওয়া হয়ে আলিপুরদুয়ার। দক্ষিণের রাস্তা গেছে গরুমারা অভয়ারণ্য হয়ে লাটাগুড়ি। সে রাস্তা ধরে একটু এগোলেই বাতাবাড়ি মোড়, সেখান থেকে বাঁ দিকে রাস্তা চলে গেছে মূর্তিতে। এদিকটা আমরা কদিন আগেই একবার ঘুরে গেছি। তাই এবার আর এদিকে নয়। আমাদের সামনে এখন কাছাকাছি যাওয়ার মতো দুটো রাস্তা। এক পুবদিকে এগিয়ে খুনিয়া মোড় হয়ে ঝালং-বিন্দু-প্যারেন। দুই মেটেলি হয়ে সামসিং সুন্তালেখোলা রকি আইল্যান্ড লালিগুরাস।
ঘোরাঘুরি করতে তো এনার্জি দরকার। তাই আর দেরি না করে ঢুকে পড়লাম এক মিষ্টির দোকানে। পুরি তরকারি মিষ্টি খেতে খেতে দোকানির কাছেই গাড়ির খোঁজ করলাম। তিনি তাঁর পরিচিত চালককে ডেকে দিলেন। বেশ দরদাম করে ভাড়া ঠিক হলো ২০০০ টাকা। আমরা যাব দ্বিতীয় রাস্তায়। চালসা পার করেই গাড়ি উর্দ্ধমুখী। সামসিং ৩০০০ফুট উচ্চতায় অবস্থিত। মেটেলির পর গাড়ি চলল চা বাগানের মধ্যে দিয়ে, যা আমাকে বারবার টানে। প্রথমে মাটিয়ালি, পরে সামসিং চা বাগান। ড্রাইভার বিশাল অল্পবয়সী। কোনো বিরক্তি নেই, যেখানে সেখানে দাঁড় করাচ্ছি আর ফোটো সেশন চলছে। গাড়ি এবার উর্দ্ধমুখী। সামসিং ৩০০০ফুট উচ্চতায় অবস্থিত। রাস্তায় একটা ছোটো জঙ্গলের পর ছোট্টো জনপদ সামসিং বস্তি। এখা্নেই পেয়ে যাবেন অনেক হোমস্টে। জীবিকা চাষ আবাদ, ব্যাবসা ও সরকারি বা চাবাগানের চাকরি। এখানে একটি স্ট্রবেরি চাষের কেন্দ্র আছে। কাছেই এক শান্ত সুন্দর শিবমন্দির। বেশ ভালো লাগে।
এরপর আমাদের গন্তব্য সুন্তালেখোলা। যেখানে আপনি নিজের গাড়ি নিয়ে যেতে পারবেন না। চেক পোস্টে নিজের গাড়ি রেখে স্থানীয় গাড়ি নিয়ে যেতে হবে। ভাড়া ২০০-৩০০ টাকা, সময় অনুযায়ী। তবে পায়ে হেঁটেও যেতে পারেন। গাড়িওয়ালাদের দেখানো ভয় উপেক্ষা করে আমরা হাঁটা লাগালাম। গাড়িতে ছবি তোলায় বিঘ্ন ঘটে। পৌঁছে গেলাম ১৫মিনিটে। আগে এখানে নদীর ধারে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের ৩টি স্থায়ী টেন্ট ছিলো। অসাধারণ ছিলো তার সৌন্দর্য। এবার দেখলাম ওগুলো সরিয়ে কংক্রিটের কটেজ তৈরি হয়েছে। এছাড়ও নর্থবেঙ্গল টুরিজমের রিসর্ট আছে। সুন্তালেখোলার (খোলা মানে নদী) ঠান্ডা জলে কিছুক্ষণ কাটিয়ে, ছবি তুলে, দোলনা ব্রিজের মজা নিয়ে চললাম গাড়ির কাছে। পরের লক্ষ্য রকি আইল্যান্ড।
মূর্তি নদীর ধারে, সামসিং থেকে দুকিমি দূরে রকি আইল্যান্ড। আপনারা চাইলে ট্রেক করতে পারেন। আমাদের তো দিনেদিনেই ফিরতে হবে, তাই গাড়িতেই চললাম। অ্যাডভেঞ্চার ভালোবাসেন যারা তারা এখানে অবশ্যই রাত কাটাবেন। নদীর ধারে অস্থায়ী টেন্টে রাত কাটানোর ব্যবস্থা আছে। মূর্তি নদীর অসাধারণ রূপ দেখে আমরা চললাম পরের গন্তব্যে। ইতিমধ্যেই পেটও একটু খিদে খিদে বলছে। কোল্ড ড্রিংক আর কিছু কেক বিস্কিট কিনে নিলাম।
আবারও মূর্তি নদীর ধারে। লালিগুরাস। মানে রডোডেনড্রন। এই উচ্চতায় হয় না। তবু কেন এই নাম কেউ বলতে পারলনা। এর সৌন্দর্য বলে বোঝাতে পারবো না। দুই দিকে দুই টেব্ল টপ পাহাড়ের মাঝে, নীচে উপত্যকা দিয়ে বয়ে চলেছে মূর্তি নদী। মে মাসের গরমে সারাদিন ঘুরে আমরা খুবই ক্লান্ত ছিলাম। ওপর থেকে নীচে নদীর ধারে গাড়ি যাবেনা। তাই আমার দুই সঙ্গী আর কষ্ট করে নীচে নামতে চাইলো না। ওপর থেকে দেখেই ফিরবে। কিন্তু ওই সৌন্দর্যের কাছে সব ক্লান্তি হেরে গেল। নদীতে নেমে আমাদের দেহ, মন শীতল হয়ে গেল। অপার মুগ্ধতা! জলকেলি চলল বেশ কিছুক্ষন। কিন্তু আর তো দেরি করা যায় না! পরের বার স্নান করব এই আশা নিয়ে সামনে এগোলাম।
বিশালের সাথে আগেই কথা হয়েছিলো আমাদের মালবাজারে ড্রপ করতে হবে। মালবাজার ক্যালটেক্স মোড়ের কাছেই হনুমান মন্দির। একটু প্রসাদ পেলেও ভালো হয়। রবিবারে সর্বসাধারণকে ভোগ খাওয়ানো হয়। আমরা পেলাম অতি কিঞ্চিৎ। কারণ ততক্ষণে শেষ হয়ে গেছে, বন্ধ হয়ে গেছে সব। তবে মন্দির দর্শন হলো। তাই বাইরে একটু খেয়ে নিলাম। বিশাল আমাদের নিউ মাল স্টেশনে নামালো বিকেল প্রায় পাঁচটা। ৫.৩০য় দিনহাটা-শিলিগুড়ি ডিএমইউ। কিন্তু বেশিরভাগ দিন লেট থাকে। কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেস আসবে ৬.১৫। ঠিক করলাম কাঞ্চনকন্যাতে যাওয়াই ভালো। রাত ৮টায় শিলিগুড়ি পৌঁছে যাব।
একটা অসাধারণ দিন কাটালাম। তবে হাতে দুটো দিন থাকলে আরো ভালো হতো। সবুজ আর শান্তিতে, বিশ্রাম আর আড্ডায় জমজমাট হতো।
প্রয়োজনীয় তথ্য- নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনেই ভাড়া গাড়ি পাওয়া যায়। ভাড়া মোটামুটি কমবেশি ৩৫০০-৪০০০টাকা। কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেস হলে সরাসরি মালবাজার বা চালসা চলে যাওয়া ভালো। ওখান থেকে গাড়ি ভাড়া কম হবে। শিলিগুড়ির পিসি মিত্তাল বাস টার্মিনাস থেকে চালসা, মালবাজারের বাস ১৫মিনিট পরপর পাওয়া যায়। ভাড়া ৭০টাকা। সামসিং-এ হোমস্টে রেট মোটামুটি প্রতিদিন মাথাপিছু থাকা খাওয়া ১২০০-১৫০০ টাকা। রিসর্টে একটু বেশি লাগতে পারে। সামসিং থেকে ঘন্টাখানেকের পথ ঝালং-বিন্দু। আর একটা দিন হাতে থাকলে ঘুরে আসতে পারেন। ওখানে থাকতেও ভালো লাগবে। আর এক দিকে গরুমারা অভয়ারণ্য। ঘুরে নিতে পারেন সেটাও। তবে জুন থেকে সেপ্টেম্বর যে কোনো জঙ্গল সাফারি বন্ধ থাকে। তাই এই সময়ের বাইরে গেলেই গরুমারা ঘোরা সম্ভব।
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team