কিছুদিন আগেই পেরিয়ে এলাম আরও একটি শিক্ষক দিবস। হর্ষচিত্তে নিউজ পোর্টালে, পত্রপত্রিকার পাতায়, সোশ্যাল সাইটে আমরা দেখলাম ছাত্রছাত্রী ঘিরে থাকা শিক্ষক সমাজের হাসিহাসি মুখ। সেইসব ঝকঝকে ছবির বিপ্রতীপে মনে জেগে উঠল আরও কয়েকটি খন্ডদৃশ্য। বেশিদূরে যেতে হবে না। চোখ মেলে দেখুন বিগত দু বছরের তীব্র দাবদাহ ও কনকনে শীত বা ঝড়বৃষ্টি মাথায় নিয়ে ধর্মতলায় গান্ধী মূর্তির নীচে বসে থাকা নবম থেকে দ্বাদশের চাকরিপ্রার্থীদের ভিড়টাকে। সেই ভিড়ের মধ্যে রয়েছেন বছর ত্রিশের মণিকা সমাদ্দার। যথাসময়ে স্কুল সার্ভিস কমিশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েও তিনি পথে বসেছেন হকের নিয়োগের দাবিতে। মালদা থেকে মুর্শিদাবাদের এই দলে রয়েছেন তাপসীও। হা ক্লান্ত, বিধ্বস্ত। অথচ ২০১৬তে যখন পরীক্ষা দিচ্ছেন তখন তাঁরা নেহাতই ছটফটে স্বপ্ন দেখা তরুণী। এখন সেসব চুরমার হয়ে লুটোচ্ছে তেতে থাকা রাজপথে।
হলদিবাড়ির তরুণ বসাকের ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন ছিল শিক্ষকতার। যথাসময়ে প্যানেলে নামও উঠেছিল। কিন্তু কোনও অজ্ঞাত কারণে চাকরিতে নিয়োগের চিঠিটি আর এল না। এখন জাতীয় সড়কের ধারে তাঁর সাইকেল সারানোর ঘুপচি দোকান। অঙ্কে মাথা ছিল। এখনও ফাঁকা বসে থাকলে চুপচাপ প্রবলেম সলভ করেন। দোকানের পাশ দিয়ে ধুলো উড়িয়ে একে একে বেরিয়ে যায় চারচাকা। অঙ্কখাতার পাতাগুলো ধুলোয় ঝাপসা হয়ে আসে। হিসেব মেলে না।
তাপসীর কথা শুনলেন তো? ওর যেখানে বাড়ি, সেই পাতকাটা থেকে আরও বারো কিলোমিটার উত্তরে সরে গেলে পাশাপাশি রয়েছে কয়েকটি উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল। কাছেই ডেঙ্গুয়াঝার চা বাগান। গত কয়েক বছরে এই এলাকার স্কুলগুলিতে রাজ্যের আরও অনেক স্কুলের মতো ছাত্রছাত্রী ভর্তির সংখ্যা অস্বাভাবিক হারে কমেছে। ইদানীং স্কুলে আসার চাইতে চা বাগান বেল্টের মেয়েরা বেছে নিয়েছে ঘরকন্না বা বাগানে পাতা তোলার কাজ। ছেলেরাও পড়াশোনায় বা স্কুলে যেতে আগ্রহী নয়। ওরা মেশিনে পাতা ছাঁটে, পাতা তোলার গাড়ি চালায় অথবা জন খাটতে যায়। এমনিতেই কোভিডকালে প্রাইমারী স্কুলের বাচ্চারা অনভ্যাসের দরুন নিজেদের নামটাও লিখতে ভুলেছিল, তার উপরে দীর্ঘদিন সরকারি স্কুলগুলিতে শিক্ষকের অভাব। হাতিয়ার কেবল মিড-ডে মিল। যা খুঁজে দিতে পারেনি প্রকৃত সমাধানের পথ।
বাগান পেরিয়ে সতেরো কিলোমিটার মতো গেলে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যাবে এলাকার পুরনো কলেজটিকে। সেখানকার অধ্যক্ষের মুখে শোনা গেল শ্বাসরুদ্ধকারী খবর। গত এক থেকে দেড় বছরে জেনারেল লাইনে পড়তে আসা স্টুডেন্টদের সংখ্যা নাকি ক্রমশই কমছে। সবাই এখন স্কিলবেসড পড়াশোনায় আগ্রহী। টেকনিক্যাল লাইনে লেগে থাকলে যদি পেট চালানোর রাস্তা মেলে ভবিষ্যতে। সরকারি স্কুল কলেজগুলোতে তাই পড়তে আসতে চাইছে না কেউ। আগে অনার্সের সিটগুলোর জন্য কাড়াকাড়ি পড়ে যেত কলেজে কলেজে। আর এখন মেজর কোর্সের মেরিট লিস্ট বের করে করে হতাশ কলেজ কতৃপক্ষ। ভর্তির সময়সীমা বাড়িয়েই চলেছে বিশ্ববিদ্যালয়। তবুও কলেজের সবগুলো সিট ফিল আপ করাটাই এখন মস্ত চ্যালেঞ্জ।
সামগ্রিক শিক্ষার নমুনা পাওয়া গেল শিলিগুড়ির প্রতিষ্ঠিত কলেজের এক অধ্যাপকের কাছে। ইংরেজি অনার্সের স্টুডেন্ট অথচ একটা অ্যাপ্লিকেশন ঠিকমতো লিখতে পারে না। প্রতিটি সেনটেন্সে হোঁচট। একই গল্প কেমিস্ট্রি থেকে সোশিওলজির। ভিতটাই নড়বড়ে হয়ে গিয়েছে।
“নিজের ভাষায় ওদের একটা উত্তর লিখতে বলুন তো, দু একজন ছাড়া বাকিরা মাথা চুলকে থই পাবে না।”
ফিজিক্স মেজরে ভর্তি হয়েও পড়া ছেড়েছে বিকাশ মুন্ডা। ফোনে তাকে ধরতে অভিভাবক সুহাস মুন্ডা বললেন, “ব্যাটা তার চাইতে ফার্মেসি পড়ুক। পরে কোনওরকমে একটা চাকরি তো জুটবে।”
হিস্ট্রি অনার্সের কলেজছুট মালতী মুর্মুর বাবা সাফ জানালেন, “মেয়েকে কলেজে পড়িয়ে কী হবে দিদিমণি? চাকরির কোনও শিওরিটি নাই। তার চেয়ে বরং নার্সিংয়ের ট্রেনিং নিক। ভবিষ্যতে করেকম্মে খেতে তো পারবে।”
নার্সিং, ফিজিওথেরাপি, রিসেপশনিস্টের জব। একই সুর লক্ষ করা গেল ইউনিভার্সিটির অন্দরেও। রিসার্চেও ঝোঁক কমছে। আগে যেখানে মেধাবী ছেলেমেয়েদের একটা সিংহভাগই চলে যেত গবেষণা করতে, ধীরে ধীরে কর্মসংস্থানের অনিশ্চয়তার ফাঁদে সেই কঠিন ও শ্রমসাধ্য পথটাকে ছেড়ে দিয়ে শর্ট কাট মেথডে রোজগারের পথ খুঁজছে মেধাবী তরুণ প্রজন্ম।
এরপরের চিত্রটা তবে কী? ফাঁকা ঘরে শূণ্য হাই-লো বেঞ্চ, আর চক ডাস্টার হাতে শিক্ষক? শিক্ষকদের অবস্থাও যে সংকটের সীমানার বাইরে এমনটা ভাবার কোনও কারণ নেই। জাতীয় শিক্ষানীতির আওতায় এসে গিয়েছে এই রাজ্যের কলেজগুলো। চার বছরের আন্ডার গ্র্যাজুয়েট কোর্স। বিপুল পরিমাণ ক্লাসের পাশাপাশি সামার ইন্টার্নশিপ, মাল্টি ডিসিপ্লিনারি ও ভোকেশনাল কোর্স এসবের ব্যস্ততা পেরিয়ে চতুর্থ বছরটায় আবার ছাত্রছাত্রীদের রিসার্চ করানো বাধ্যতামূলক। কিন্তু যখন কলেজগুলো শিক্ষকের অভাবে ধুঁকছে, কারা নেবেন এত বিপুল সংখ্যক ক্লাস? সঙ্গে গোঁদের উপর বিষফোঁড়ার মতো এসে জুটেছে গবেষণাকর্মের বাধ্যবাধকতা!
শহরের কলেজগুলোর কথা না হয় বাদই দিলাম। প্রান্তিক কলেজগুলোতে গবেষণার পরিকাঠামো আদৌ কি রয়েছে? না। বহু প্রান্তিক কলেজগুলো স্রেফ পরিকাঠামোর অভাবেই তাই উঠে যেতে বসেছে। হয়তো তাদের নিকটবর্তী শহরাঞ্চলের অপেক্ষাকৃত উন্নতমানের কলেজের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হবে। জল্পনা তো সেরকমই ইঙ্গিত দিচ্ছে। কিন্তু মোদ্দা কথাটা হল এই যে সেই সব প্রান্তিক কলেজের ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে কি আমরা কেউই ভাবিত নই? সকলের পক্ষে কি বাড়ি থেকে দূরে শহরে থেকে পড়াশোনা করার মতো আর্থিক সঙ্গতি আছে? শিক্ষকদের পক্ষেও কি সম্ভব এতদিনের পরিচিতির গণ্ডি ছেড়ে এসে সম্পূর্ণ নতুন জায়গায় মানিয়ে নিয়ে ক্লাশ নেওয়া?
এর ফলে যা হওয়ার তাই হবে। স্কুল-কলেজছুটের সংখ্যা বাড়বে বৈ কমবে না। এত চাপের মুখে শিক্ষার মানেরও অবনমন ঘটবে অবধারিতভাবেই। খেসারত দিতে হবে সেই তরুণ প্রজন্মকে। আরও একটা ভোট আসবে। ভোটার বাড়বে। পাল্লা দিয়ে দীর্ঘ হবে সামগ্রিক শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের নৈরাজ্যকর গাঢ় ছায়া। এক্ষেত্রে সবচাইতে বড় প্রশ্ন আমাদের অবস্থানের। শুধুই নীরব দর্শক হয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই কি করার নেই?
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team