দেখিয়া ভুলিলা দেব ত্রিপুরারি...
কাঁচা সরা ভর করি নৃত্য করইন সুন্দরী
মোহিত হইলা যত দেবপুর নারী...
পঁচিশ-ত্রিশ হাত কুঁচি দেওয়া লাল-হলুদ পাড় দেওয়া সাদা ঘাগরি, লম্বা হাতা পাঞ্জাবি, মাথায় সাদা পাগড়ি, গলায় লাল ওড়না, কপালে চন্দনের ফোঁটা, কানে কুন্তল, নূপুর পায়ে হাতে সাদা চামর দুলিয়ে দুলিয়ে পদ্মপুরাণ গানের সঙ্গে নাচ করেন গুরমা। ওঝা নাচ। বরাক উপত্যকার এক গুরুপরম্পরা নৃত্যধারা। ওঝা নৃত্যের এই পোষাক নিয়ে একটি কাহিনি প্রচলিত রয়েছে। বান রাজার কন্যা ঊষা এবং কৃষ্ণের পৌত্র অনিরুদ্ধ ছিলেন দেবসভার নৃত্যশিল্পী। দেবসভায় নাচের সময়ে তাল ভাঙার অপরাধে ইন্দ্রের অভিশাপে এই দম্পতিকে পৃথিবীতে জন্ম গ্রহণ করতে হয়েছিল বেহুলা লখিন্দর রূপে। লোকশ্রুতি অনুযায়ী ওঝাদের এই পোষাক নাকি উষা-অনিরুদ্ধ পৃথিবী থেকে শাপমুক্ত হয়ে স্বর্গে ফিরে যাওয়ার আগে মনসা গান করার জন্য গুরমা বা ওঝাদের জন্য এই পোষাক রেখে যান। পূর্ববঙ্গের মনসাপুজার এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ এই ওঝা নাচ। গোটা শ্রাবণ মাস জুড়ে একটু একটু করে পড়ে শেষ করা হয় পদ্মপুরাণ পাঠ। শ্রাবণী সংক্রান্তিতে মনসাপূজার দিনে গানের নৃত্যরূপ পরিবেশন হয় ওঝা নাচের মাধ্যমে। সাত আটজনের একটি দলে ওঝা ছাড়াও সঙ্গে থাকেন দোহার এবং বাদ্যকররা। যিনি ওঝা তিনি একাধারে সূত্রধর, গায়ক, নৃত্যশিল্পী এবং পরিচালক।
লোক এবং শাস্ত্রীয় নৃত্যের সংমিশ্রণে এই ওঝা নাচে শরীরের ওপর নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক বিষয়। কাঁচা মাটির সরার উপর দাঁড়িয়ে এবং দু'পায়ের নীচে সরাটিকে রেখে, সরাটিকে অক্ষত রেখে নাচের মুদ্রায় এগিয়ে চলতে হয় হংস, সর্প, নাগ, ময়ূর ইত্যাদির চলনে। এই ওঝা নাচ একসময়ে শুধুমাত্র নপুংসকরাই করতেন বলে এই নাচকে 'গুরমানি নাচ'ও বলা হয়। গুরমা শব্দের অর্থ নপুংসক। এই নপুংসকদের আবার যে বিষহরির পূজা করে তিনি ডরাই বিষহরি। ডরাই শব্দটি অনুমান করা হয় ডহর+আই থেকে এসেছে। ডহর শব্দের অর্থ হচ্ছে জলাশয় এবং আই শব্দের অর্থ মা। ডরাই বিষহরি মূলত জলাশয়ের দেবী। জেলে সম্প্রদায়ের মানুষেরা ঘূর্ণি, প্রবল জলস্রোত, সাপের কামড় ইত্যাদি বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এই দেবীর পূজা করেন। হলুদ বর্ণের নগ্ন চতুর্ভুজা দেবীর হাতে পরানো থাকে সাপের বাজুবন্ধ। কচ্ছপের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা এই বিষহরির পূজা প্রকাশ্যে হয় না। নপুংসক পুরোহিত কোনো গুপ্ত স্থানে এই পূজা করে থাকেন।
ওঝা নাচ মূলত গুরুকূল ঘরানার। ছ থেকে সাত বছর বয়সের মধ্যে শুরু করতে হয় গুরুর কাছে তালিম নেওয়া। টানা দশ থেকে বারো বছর শিক্ষা গ্রহণের পর গুরুর আদেশ নিয়ে ওঝানাচ পরিবেশন করতে পারেন শিল্পীরা। এই অঞ্চলের নৌকা পূজায় সাতদিনব্যাপী ওঝাগানের রীতি প্রচলিত ছিল। ক্রমবিলীয়মান এই নৌকা পূজার সংখ্যা বর্তমানে হাতে গোনা। প্রচলিত সংস্কার অনুযায়ী দূর থেকে কোনো ওঝা যদি নৌকা পূজার মনসাগান শুনতে পান তাহলে তাঁকে এসে যোগদান করতে হয়। মূলত গুরুকুল পরম্পরায় শিক্ষনীয় ওঝা নাচ মনসাপূজার অঙ্গ হিসেবে পদ্মাপুরানের নৃত্যাভিনয় হলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই নাচও পূজা পার্বনের শামিয়ানা থেকে বেরিয়ে স্থান করে নিয়েছে আধুনিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মঞ্চে। ধর্মীয় পরিমন্ডল থেকে মুক্ত করে ওঝানাচকে পরিমার্জন পরিবর্ধন করে মঞ্চের উপযোগী রূপদান করেন নৃত্যগুরু মুকুন্দদাস ভট্টাচার্য। মানুষের পালটে যাওয়া রুচি, পছন্দ এবং সময়ের কথা মাথায় রেখে মঞ্চে পরিবেশিত ওঝা নাচের জন্য মূলত বেহুলার দেবসভায় নৃত্যের অংশটিকেই বেছে নেওয়া হয়। খোল, পখোয়াজ, করতাল ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্রের পরিবর্তে ব্যবহৃত হয় আধুনিক যন্ত্রানুসঙ্গ।
"নৃত্য করেন শাহেরও কুমারী
ও তুমরা দেখো গো আসি
ভালা নৃত্য করে শাহেরও কুমারী
এগো মনোহর বেশ ধরি নৃত্য করইন সুন্দরী
তার চরণে নেপুর ধ্বনি রুনুঝুনু শব্দ তুলি
দাঁড়ায় কত অঙ্গভঙ্গি করি
যেমন হংস চলন তেমন তার দোলন চলন
যেমন হংস পরে হংস বাহিনী
দেখ দেখ ময়ূর চলে শতপুষ্প মেলি ধরি..."
কোনো অনুষ্ঠানে মঞ্চে নাচ পরিবেশনে যেহেতু সময় নির্ধারিত থাকে তাই নব আঙ্গিকের ওঝা নাচে বেশিরভাগ সময়ে এই গানটিকে বেছে নেওয়া হয় কারণ এই অংশে শিল্পীরা অল্প সময়ে বিভিন্ন মুদ্রা প্রদর্শনের সম্পূর্ণ সুযোগ পান। ওঝা, পুরোহিত অথবা গুরমা অর্থাৎ নপুংসক শ্রেণীর মানুষের পরিবেশিত ধর্মীয় আচার বা ম্যাজিক্যাল ড্যান্স হিসেবে পরিচিত। ব্যতিক্রমী এই নৃত্যকলাটি আচার আচরণ এবং প্রচুর সময় সাপেক্ষ উপস্থাপনার কারণে হারিয়ে যাচ্ছিল ক্রমশ। কমে আসছিল ওঝা নাচের শিল্পীদের সংখ্যা। কিন্তু নৃত্যগুরু মুকুন্দদাস ভট্টাচার্য কৃত ওঝা নাচের প্রযোজনাটি বর্তমানে ওঝা নাচকে ছড়িয়ে দিয়েছে নতুন আঙ্গিকে। ভাতখন্ডে সঙ্গীত বিদ্যপীঠের লোকনৃত্যের পাঠ্যসূচিতেও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে এই ওঝানৃত্য।
শ্রাবণ মাসে বরাক উপত্যকার গ্রামাঞ্চলের জল মাটি বাতাসে মিশে থাকে পদ্মাপুরাণের সুর। সিজতলায় খই বাতাসা তিলের নাড়ু দিয়ে আনন্দডালা সাজিয়ে বড়ো আদর যত্ন ভক্তিতে শ্রাবণীপূজা করেন সারা বছর জল-জঙ্গল-কাদায় খেটেখাওয়া মানুষরা। শ্রাবণ মাসের পঞ্চমী তিথিতে উর্বরতা, ধন, সম্পদ শস্যের প্রতীক এই দেবীর পূজার আয়োজন চলে গোটা মাস ধরে নিয়ম করে, পদ্মপুরাণের সুর গ্রামের খোলা বাতাসে ছড়িয়ে। শহরাঞ্চলেও ইদানীং চোখে পড়ার মতো মহা আড়ম্বরে মনসা পূজার চল হয়েছে। তবে এই আড়ম্বর পূজার পরদিন প্রতিমা বিসর্জন যাত্রায় মাত্রাছাড়া উদ্দাম রূপ নেয়। নাচ গান আবির খেলা এসবের প্রেক্ষাপটে থাকে না কোনো পদ্মপুরানের সুর কিংবা 'নেপুর' এর রুনুঝুনু শব্দ। শুধু এইসব কোলাহল থেকে বহুদূরে কোনো আত্মমগ্ন পাঠক তখন আপনমনে বিড়বিড় করেন,
"হু হু করা কালসন্ধ্যা ভেসে আসা গানে
সায়ের ঝিয়ারি যায় অনন্ত ভাসানে। "
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team