১৭৬৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের গোড়ায় রেনেল সাহেব ফরাসডাঙায় পা দিলেন। কদিন আগে, জানুয়ারির শেষে তিনি যাত্রা শুরু করেছিলেন দেওয়ানগঞ্জ থেকে, যেখান থেকে পূবদিকে তিস্তার পশ্চিম পাড়ের দূরত্ব তিন মাইল। রেনেলের মতে, তিস্তা ভোটান থেকে নেমে আসা বড় নদী। এবার তিনি তিস্তার পশ্চিম পাড় ধরে উত্তরে চলবেন। এরপর নন্দনপুর, বোয়ালমারি, মন্ডলঘাট হয়ে তার উচিত ছিল জলপাইগুড়ি টাউনে পৌঁছন। কিন্তু টাউন তো তখন ছিল না তাই রেনেল জলপাইগুড়ির বদলে যেখানে এলেন, তার নাম ফরাসডাঙা।
মানচিত্র আঁকার অভিজ্ঞতা নিয়ে রেনেল একটি জার্নাল রচনা করেছিলেন। সেখানেই তিনি দিচ্ছেন ফরাসডাঙায় আসার খবর। এই ফরাসডাঙা আসলে টাউনের গতজন্ম। তিস্তার পশ্চিম পাড়ের এই ফরাসডাঙা দেখে রেনেলের মন্তব্য: After crossing the Jabbonau & Ponga two shallow Rivers we came to Farsydunga, a Bazar Village lying on the Teesta & about 6 miles NNE from Taledaar. The Countrey here is open & well cultivated on the West side of the River, but the East side (which is part of Boutan) is Jungly & desart. We perceived pieces of different kinds of Trees lying on the Sands in the River: these the Countrey People informed me are brought down from the Boutan Mountains by the Freshes: amongst many other kinds of fine Timber I perceived the stump of a Firr Tree of which I brought away several pieces.
ফরাস ডাঙায় ঢোকার আগে দুটো অগভীর নদী পেরিয়েছিলেন রেনেল। তার মধ্যে ponga যে পাঙ্গা, এটা বোঝা যাচ্ছে, কিন্তু আরেকটা নদীর নাম হলো Jabbonau. এটা কোন নদী তা নিয়ে এখন মাথা ঘামাচ্ছি না। এটা লুপ্তও হতে পারে। নাম বদলে যেতেও পারে।
ফরাসডাঙা ছেড়ে রেনেল Sannyasigota, মানে সন্ন্যাসীকাটা গেলেন। তারপর মহানন্দা, মেচি নদী হয়ে খানিকটা তারাই অঞ্চলে ঘুরে তিস্তা পেরিয়ে একটা চক্কর দিয়ে আবার এপাড়ে এসে একটা তথ্য দিলেন। সেটা পরে লিখছি।
ফরাস ডাঙ্গার অনেকটাই সম্ভবত তিস্তার গ্রাসে বিলীন। বাকিটা আজকের টাউনের মধ্যে বিলুপ্ত হওয়াই উচিত। এবং এই ফরাসডাঙা ছিল, বৈকুণ্ঠপুর নয়, রংপুরের সীমানায়। সেখান থেকে দু চার মাইল উত্তরেই শেষ হচ্ছে রংপুর নামক ‘চাকলা’-র সীমা। শুরু হচ্ছে "বত্তিশ হাজারে" রাজ্য। এটা আসলে বৈকুণ্ঠপুরের অর্থনৈতিক নাম। কুচবিহার রাজ্যের পত্তন হওয়ার পর বৈকুণ্ঠপুরে উৎপন্ন রাজস্বের পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়েছিল বত্রিশ হাজার সেকালের টাকা।
সুতরাং বত্তিশ হাজারের রাজধানী যে রংপুর চাকলার মাটিতে হবে না, এটা ভাবাই যায়। রংপুর ছিল বোদা-র চাকলা বা বড় টুকরো। উদাহরণ: চাকলা চাকলা করে কাটা। এই প্রসঙ্গে আগেকার রাজ্য সম্পর্কে দুটো কথা বলা দরকার। অধিকাংশ রাজ্যেই হত ছোট। একালের জেলা-এর মাপের হয়তো। অধিকাংশই কোনও না কোনও বড় রাজ্যের রাজাকে খাজনা দিয়ে স্বাধীন ভাবেই রাজ্য চালাত।
বৈকুণ্ঠপুরের আকারও একটা জেলার মতোই। এর একদিক ভোটান, আরেকদিকে মোঘলদের রাজ্য, আরেকদিকে কুচবিহার। এদের রাজরাই বড় রাজা। কাগজে কলমে বৈকুণ্ঠপুরের কর্তব্য হলো কুচবিহারের আনুগত্য স্বীকার করে তাকে খাজনা দেওয়া। বৈকুণ্ঠপুরের রাজারা সেটা সব সময় মানেন নি। ভোটানের সাথে ফন্দি এঁটে কুচবিহারকে ঝামেলায় ফেলতেও তাঁরা পিছপা হতেন না।
রেনেল যখন এদিকে হাঁটছিলেন, মানে সেই ১৭৬৪ নাগাদ বৈকুণ্ঠপুরের রাজধানী যে বর্তমান স্থানে আসে নি, সেটা মেনে নেওয়া যেতেই পারে। কিন্তু রেনেল বৈকুণ্ঠপুরের রাজধানীর নামও উল্লেখ করে গেছেন তাঁর জার্নালে। সন্ন্যাসীকাটা থেকে তিনি বত্তিশ হাজারের রাজধানীতে গেলেন। সেটা একটা বড় গ্রাম। রাজার বাস। রাজধানীর নাম Parpour.
রেনেলের জার্নালের সম্পাদক পাদটিকায় জানিয়ে দিয়েছেন যে এই parpour হলো রেনেলের মানচিত্রের jelpigore. আরো জানিয়েছেন যে, পারপৌরের রাজাদের রাজধানী আগে ছিল বৈকুণ্ঠপুরে। মোঘলদের কারণে সেটা চলে আসে parpour-এ। এখন parpour খুব সম্ভবত পাহাড়পুর। সাধারণ উচ্চারণে পারপুর চেহারা পেয়েছিল এবং রেনেল সেটাই শুনেছিলেন।
রাজা জগদিন্দ্রদেব রায়কত ছিলেন পোষ্যপুত্র এবং সেই হেতু মূল রাজার অভিভাবক হিসেবে শাসন করেছিলেন বলে তাঁকে বলা হত পোষ্যরাজা। অন্যদিকে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ জলপাইগুড়িতে বেশ জনপ্রিয়তা পেতেন। তাঁর চলতি নাম ছিল সি আর দাশ। এই তল্লাটের সাধারণ লোক ওই দুজনকে পরম শ্রদ্ধায় বলত পশুরাজা এবং শিয়াল দাস। অপমান শব্দে নয়, উচ্চারণে থাকে। সুতরাং পাহাড়পুর যে parpour নয়, তা বলি কী ভাবে? এই পাহাড়পুর থেকেই রাজধানী এসেছে টাউনে। কিন্তু সাথে নিয়ে এসেছে jelpigore নামটাও। এসবের মধ্যেই গড়ে উঠেছে ‘জলপাইগুড়ি’ শব্দ।
রেনেলের জার্নালের ভিত্তিতে মনে হচ্ছে যে বত্তিশ হাজারে রাজ্যের রাজধানী প্রথমে ছিল বৈকুণ্ঠপুর। সেটা ছিল অরণ্য বেষ্টিত। এরপর সেটা স্থানান্তরিত হয় jelpigre-তে এবং তখন তার নাম হয় পাহাড়পুর। আরো পরে জলপাইগুড়ি-র সম্ভাবনা তৈরি হলে রাজধানী বর্তমান জায়গায় আসে। অবশ্য ততদিনে বত্তিশ হাজারে লুপ্ত হয়ে গেছে। রাজাও পরিণত হয়েছেন জমিদারে। তাই বর্তমান আমবাড়ি-ফালাকাটা সন্নিহিত jelpigore গুরুত্ব হারাল। বদলে জলপাইগুড়ি গড়ে উঠল হয় তো বা ফরাসডাঙারই মাটিতে।
নিরাপত্তার কথা বিচার করলে রায়কতদের টাউনে চলে আসাটাই ছিল উপযুক্ত সিদ্ধান্ত। টাউন হওয়ার আগে ইংরেজদের কাছে এটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়েছিল সামরিক কারণে। এখানে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করা হয়। স্থানটি ভোটানের গতিবিধি লক্ষ্য রাখার পক্ষে আদর্শ।
এবার যে প্রশ্নটা আসছে তা হলো: যে জেল্পিগোরে-তে পাহাড়পুর ছিল, সেই জেল্পিগোরে আসলে কী ছিল? সেটা কি পুরনো কোনও জনপদ? কোনও বাজার বা হাট? সে যুগের নিরিখে জেল্পিগোরে-র ভৌগোলিক অবস্থান ছিল বেশ গুরুত্বপূর্ণ। হতে পারে এটাই ছিল রায়কত রাজাদের সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ জনপদ।
বিষয়টি গবেষণার অপেক্ষা রাখে।
ইংরেজরা জলপাইগুড়ি নামক একটা জেলাকে সরকারি ভাবে গঠন করেন ১৮৬৯ সালের ১লা জানুয়ারি। ষোল বছর পর ১৮৮৫ সালের ১লা এপ্রিল গঠন করেন পাঁচটি ওয়ার্ড বিশিষ্ট জলপাইগুড়ি পুরসভা বা টাউন জলপাইগুড়ি। তখন টাউনের আয়তন ছিল সাড়ে তিন বর্গ মাইল আর লোকসংখ্যা আট হাজারের সামান্য কম। নতুন জেলা, নতুন টাউন --- ফলে কাজের সন্ধানে লোকজন এসে ভিড় জমাতে শুরু করেছিলেন। রহিম বক্স ছিলেন পেশকার। তিনি টাউনে তেত্রিশ বিঘা জমির ওপর যে বাড়ি বানালেন সেটাকে লোকে বলত নবাব বাড়ি।
অচিরেই টাউন জমে উঠল। আপিস-আদালত-জেলাস্কুল হলো। চাকরি নিয়ে কলকাতা ও আশপাশের অঞ্চল থেকে মানুষেরা এলেন। আইনি ব্যবসার সূত্রে লোকেরা এলেন পুব বাংলা থেকে। গোড়ায় ঢাকা আর পাবনার লোকটাই বেশি। বিহার থেকে এলেন শ্রমজীবীর দল। রহিম বক্সের উদ্যোগে মুসলিমরা এলেন মুর্শিদাবাদ, নোয়াখালি, কুমিল্লা থেকে। এলো চা ও তার বাগান। এলো টাউন ক্লাব, আর্যনাট্য।
শুরুর পর থেকে কয়েক দশক টাউনের লোক টাউন গঠন নিয়েই মেতে ছিলেন। যে কোনও টাউনের ক্ষেত্রে সেটা এক রোমাঞ্চকর সময়।
(চলবে)
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team