'শিলিগুড়ি' নামের অভিধাগত অর্থ নিয়ে মতপার্থক্য আছে। তবে তিব্বতি ভাষায় 'শিল' অর্থে 'বর্ষণ' বোঝায় আর 'গুড়ি' শব্দের স্বীকৃত একটি অর্থ হলো স্থান। হান্টার সাহেব Statistical Account of Bengal বইটিতে লিখেছিলেন যে, এ অঞ্চল বসবাসের উপযুক্ত নয়। বইটি লেখা হয় উনিশ শতকে। দার্জিলিং-এর পাদদেশে এই শহরের অবস্থান। এ শহরের উত্তরে কার্শিয়াং, দক্ষিণে দিনাজপুর, পশ্চিমে নেপাল, আর পূর্বে জেলা জলপাইগুড়ি। একসময় এই শহর পরিচিত ছিল 'সিকিম মোরাঙ' (সূত্র : Bengal District Gazetteers Darjeeling, Reprint 1985, Delhi) নামে, এবং কখনও 'কিরাতভূমি' নামটিও প্রচলিত ছিল। এখানে অন্যান্য ঋতু প্রবল হলেও বৃষ্টির দাপট বেশিই ছিল। বর্তমানে অবশ্য নগরায়নের দাপটে বৃষ্টির প্রাবল্য অনেক অনেক কম। মেঘমুক্ত আকাশে শহর থেকে দেখা যায় তুষারশুভ্র কাঞ্চনজঙ্ঘা। ভৌগোলিক দিক দিয়েও গুরুত্বপূর্ণ শহর শিলিগুড়ি শহরের গড়ে ওঠার প্রাথমিক প্রক্রিয়া ছিল বেশ শ্লথ।
১৮১৪-১৬ সালের ইঙ্গ-নেপাল যুদ্ধের পরে ইংরেজরা দখল করেছিল মহানন্দা নদীর দুই পাড়। ১৮৫০ সালে শিলিগুড়ি মহকুমা ইংরেজরা দখল করে এবং তাকে দার্জিলিং-এর সঙ্গে যুক্ত করে। তথ্য অনুসারে শিলিগুড়ি মহকুমা শহরের মর্যাদা লাভ করেছিল ১৯০৭ সালে। এ সময় মহকুমার দায়িত্ব পালন করতেন একজন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। ১৯৩৮ সালে শিলিগুড়িতে তৈরি হয়েছিল 'ইউনিয়ন বোর্ড'। এই বোর্ডের প্রথম প্রেসিডেন্ট ছিলেন আইনজীবী লক্ষ্মীনারায়ণ মজুমদার। এই বোর্ড গঠনেরও আগে ১৯১৪ সালে শিলিগুড়ির পরিচ্ছন্নতা এবং অন্যান্য দায়িত্বে ছিলেন 'স্যানিটারি কমিটি'। এই কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন শহরের বিখ্যাত আইনজীবী সুরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য্য। পরবর্তীকালে এই বোর্ডের সভাপতি হন স্যর জন মেবার্ট। শহর পরিচ্ছন্নতার পাশাপাশি শহরের বিভিন্ন স্থানে কাঠের খুঁটি রেখে সেখানে আলো ঝুলিয়ে রেখে রাতে আলো জ্বালানোর ব্যবস্থা করেছিল এই কমিটি। আলো বলতে ছিল অবশ্য হ্যাজাগ, পেট্রোম্যাক্স, কারবাইটের গ্যাসলাইট প্রভৃতি।
১৯৪৯ সালের এপ্রিল মাসে শিলিগুড়ি পৌরসভা গঠিত হয়। পৌরসভার প্রথম চেয়ারম্যান ছিলেন তৎকালীন মহকুমাশাসক শচীন্দ্রমোহন গুহ, এবং ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন বীরেন্দ্রনাথ রায় সরকার। শিলিগুড়ি পৌরসভার প্রথম নির্বাচিত চেয়ারম্যান ছিলেন জগদীশ চন্দ্র ভট্টাচার্য্য। প্রথম নির্বাচিত ভাইস চেয়ারম্যান ডাক্তার ব্রজেন্দ্র বসু রায় চৌধুরী । ১৯৫২-র ২৬শে অক্টোবর অক্টোবর বর্তমান অবস্থানে (কোর্ট মোড় সংলগ্ন অঞ্চল) স্থায়ী পৌরভবনের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন পশ্চিমবঙ্গের তদানীন্তন রাজ্যপাল ভক্টর হরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। ১৯৬০ সালে উক্ত পৌরভবনের দ্বারোদ্ঘাটন করেন প্রবীণ আইনজীবী বীরেশ্বর মজুমদার। প্রথম নির্বাচিত চেয়ারম্যান জগদীশ চন্দ্র ভট্টাচার্য্য বিধায়ক হওয়ার পরে ঐ পদ থেকে ইস্তফা দিলে চেয়ারম্যান পদে বসেন জীবনকৃষ্ণ দত্ত। ১৯৭৪ থেকে ১৯৮০ পর্যন্ত শিলিগুড়ি পৌরসভার চেয়ারম্যান ছিলেন কৃষ্ণেন্দু নারায়ণ চৌধুরী (আলো চৌধুরী বা মতান্তরে আলু চৌধুরী)। এই সময় শিলিগুড়ি শহর ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের জনসংখ্যা ছিল প্রায় দু লক্ষ। এইসময় পুনর্বাসন, রাস্তাঘাট সংস্কার ও পরিবর্ধন, পানীয় জল সরবরাহ ব্যবস্থা এবং শহরের প্রধান রাস্তাগুলিতে বাল্ব বসানো ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হতে থাকে। এ সময় শিলিগুড়ির প্রাচীন গ্রন্থাগার হরসুন্দর লাইব্রেরিকে শিলিগুড়ি মিউনিসিপ্যাল লাইব্রেরিতে রূপান্তরিত করা হয়। এই সময়েই শিলিগুড়ি টাউন স্টেশন সংলগ্ন রেললাইনের ওপর দিয়ে কোর্ট মোড় পর্যন্ত একটি ফ্লাইওভার নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়েছিল।
১৯৮১ সালে পৌরবোর্ড হস্তান্তরিত হয় এবং পুর উন্নয়নের দায়িত্ব গ্রহন করে তদানীন্তন কালের নির্বাচিত বামফ্রন্ট সরকার। পৌরপতি নির্বাচিত হন স্বপন কুমার সরকার। ১৯৮৮ সালে শিলিগুড়িতে অনুষ্ঠিত হয় সপ্তম নেহেরু গোল্ডকাপ। এই ক্রীড়ানুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয় কাঞ্চনজঙ্ঘা ক্রীড়াঙ্গনে। খেলার মাঠ তিলক ময়দানের কাঞ্চনজঙ্ঘা ক্রীড়াঙ্গন হয়ে ওঠার মধ্যে দিয়ে শিলিগুড়ির এক নতুন যাত্রা শুরু হয়। এই ক্রীড়াঙ্গনকে কেন্দ্র করে টাউন স্টেশনের পাশে তৈরি হয় দ্বিতীয় রেলগেট। যোগাযোগ রক্ষাকারী রাস্তা নির্মাণ, বড় রাস্তাগুলির (কাছারি রোড, স্টেশন ফিডার রোড, বিধান রোড, বর্ধমান রোড, সেভক রোড) সার্বিক নির্মাণ এই সময়ে ঘটে। হাওড়া পেট্রোল পাম্প পর্যন্ত বিপরীতমুখী যান চলাচলের জন্য বিভাজিকা এবং রাস্তার দুপাশের ফুটপাথ গঠন করা হয়। রাস্তার দুপাশে সোডিয়াম ভেপার ল্যাম্প বসানো হয়। তৈরি করা হয় বিভিন্ন উদ্যান। যেমন দেশবন্ধু পাড়ার সুব্রত শিশু উদ্যান, ডিজেল কলোনি পার্ক প্রভৃতি।
১৯৮৩ থেকে ১৯৮৮র মধ্যে তৈরি হয় বাঘাযতীন পার্কে রবীন্দ্র মঞ্চ। এই সময়ের মধ্যেই গড়ে ওঠে তথ্য কেন্দ্র এবং অতিরিক্ত জেলা গ্রন্থাগার।এছাড়াও এই সময়ের মধ্যে তৈরি হয় পান্থনিবাস এবং বিবেকানন্দ সুপার মার্কেট। ১৯৮৪ থেকে ১৯৮৬র মধ্যে ডাবগ্রাম এলাকায় নির্মিত হয় 'সমষ্টি মিলন কেন্দ্র'। ওই এলাকাতেই জল জলাধারে সংগ্রহ করে রেখে বিভিন্ন অঞ্চলে নলবাহিত পানীয় জল সরবরাহ করা শুরু হয়। ১৯৮৩ সালে শেষ হয় কিরণচন্দ্র স্মৃতি শ্মশানঘাটের উন্নয়ন কার্য। পরিকল্পনা করা হয় বৈদ্যুতিক চুল্লি স্থাপনের। এ সময় শিলিগুড়ি শহরের অভ্যন্তরে সিটি বাস পরিষেবাও শুরু হয়েছিল, তবে তা দীর্ঘস্থায়ী হয় নি।
১৯৮৮ সালে পৌর নির্বাচনে পৌরপ্রধান নির্বাচিত হন অশোক নারায়ণ ভট্টাচার্য্য। ১৯৯১-এর মধ্যে শেষ হয় কিরণচন্দ্র শ্মশানঘাটের বৈদ্যুতিক শবদাহ কেন্দ্রের নির্মাণ। অশোক ভট্টাচার্য্য বিধানসভা নির্বাচনে পুর ও নগরোন্নয়ন দপ্তরের প্রতিমন্ত্রী হলে পৌরপ্রধান হিসাবে নির্বাচিত হন শিলিগুড়ি কলেজের অধ্যাপক বিকাশ ঘোষ। ক্রমশ নগর অভিমুখী এক চলন শুরু হয় শিলিগুড়ির।
১৯৯০এর মে মাসে বিধানসভায় শিলিগুড়ি পৌরসভাকে কর্পোরেশনে উন্নীত করার কথা ঘোষণা করা হয়েছিল। ১৯৯৪-এর মে মাসে মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের প্রথম নির্বাচন হয়, সেখানে বিজয়ী হয়ে প্রথম মেয়র নির্বাচিত হন বিকাশ ঘোষ। শিলিগুড়ি জলপাইগুড়ি উন্নয়ন সংস্থার চেয়ারম্যান হন অশোক নারায়ণ ভট্টাচার্য্য। ২০০৪ সালে নির্মিত হয় শিলিগুড়ি জলপাইগুড়ি উন্নয়ন বোর্ড (SJDA)। এই বোর্ড শিলিগুড়ির জনসংখ্যা বৃদ্ধি, আবসন সমস্যা, জনস্বাস্থ্য, নিকাশি ব্যবস্থা, বর্জ্য পরিশোধন, পানীয় জল সরবরাহ প্রভৃতি বিষয়ে বিভিন্ন প্রকল্প প্রণয়ন করে। এই প্রকল্প রূপায়নে প্রধান পরার্শদাতা ছিল খড়্গপুরের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির স্থাপত্যবিদ্যা বিভাগ এবং আঞ্চলিক পরিকল্পনা বিভাগ। সহায়তা করেছিল আন্তর্জাতিক সংস্থা ইউনিসেফ। সামগ্রিক প্রকল্পটির নাম ছিল Perspective Plan 2025।
২০০৮ সালে কিছু সময়ের জন্য মেয়র ইন চার্জ এবং পরে মেয়র হন মুন্সি নুরুল ইসলাম। ২০০৯এর অক্টোবর মাস থেকে ২০১১র ২৭শে জুন পর্যন্ত এবং ওই বছরের ৯ই জুলাই থেকে ২০১৪র ২০শে মে পর্যন্ত নির্বাচিত মেয়র ছিলেন আইনজীবী গঙ্গোত্রী দত্ত। ২০১৫ সালে নির্বাচনে জয়ী হয়ে পুনরায় মেয়র নির্বাচিত হন অশোক ভট্টাচার্য্য। ২০২০ সালে অতিমারীর জন্য স্থগিত ছিল নির্বাচন। তখন শিলিগুড়ি কর্পোরেশনের দায়িত্বভার পরিচালনা করেন রাজ্য সরকার গঠিত প্রশাসক মণ্ডলী। শিলিগুড়ি শহরের বর্তমান নির্বাচিত মেয়র প্রাক্তন মন্ত্রী গৌতম দেব।
শিলিগুড়ি পুরসভার অন্তর্গত বিভিন্ন ওয়ার্ডগুলি হলো-- প্রধান নগর, মহানন্দা পাড়া, খাল পাড়া, মহাকাল পল্লী, আশ্রম পাড়া, হাকিম পাড়া, সুভাষ পল্লী, পূর্ব বিবেকানন্দ পল্লী, মিলন পল্লী, দেশবন্ধু পাড়া, বাবু পাড়া, ভরতনগর, শক্তিগড়, পরেশ নগর, সমর নগর ইত্যাদি। শিলিগুড়ি শহরের পানীয় জল সরবরাহের জন্য আশ্রম পাড়ায় রামকৃষ্ণ ব্যায়াম শিক্ষা সংঘের পাশে একটি জলাধার, বিধান রোড সংলগ্ন স্টেডিয়ামে পাশে জলাধার, বাবু পাড়ার জোৎস্নাময়ী গার্লস হাই স্কুলের পাশে একটি জলাধার রয়েছে। এছাড়াও রথখোলা, ৩১নং ওয়ার্ডের শক্তিগড় ও সেভক রোডে উচ্চ জলাধার নির্মাণ করে জল সঞ্চয় ও সরবরাহের ব্যবস্থা করেছে পৌরসভা। বর্তমানে প্রচুর বাড়িতে এই পানীয় জল সরবরাহের ব্যবস্থা করেছেন পৌর কর্তৃপক্ষ। ইতিমধ্যে বায়ো মাইনিং পদ্ধতিতে মাধ্যমে বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণের কাজ চলছে দ্রুতগতিতে। সুলভ ইণ্টার ন্যাশানাল সংস্থার মাধ্যমে শহরের বিভিন্ন স্থানে তৈরি করা হচ্ছে কমিউনিটি ল্যাট্রিন এবং পাবলিক টয়লেট। শহরের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্পের কথা বলা হয়েছে পুরনিগমের পক্ষ থেকে।
শিলিগুড়ি পৌর কর্পোরেশনের সীমানার মধ্যে আছে দার্জিলিং এবং জলপাইগুড়ি জেলার কিছু অংশ। পুর কর্পোরেশনের আয়তন ৪১.৯০ বর্গ কিলোমিটার, এর মধ্যে ২১.৮০ বর্গ কিলোমিটার রয়েছে জলপাইগুড়ি জেলার। কর্পোরেশনের অন্তর্গত মোট ৪৭টি ওয়ার্ড রয়েছে। এর মধ্যে ৩৩ টি দার্জিলিং জেলার এবং ১৪টি জলপাইগুড়ি জেলার সদর মহকুমার অন্তর্গত। বর্তমানে এ শহরে বস্তি ও কলোনির সংখ্যা প্রায় ১৫৪টি। বর্তমানে কর্পোরেশনের এলাকাভুক্ত অঞ্চলের জনসংখ্যা ৫,১৩,২৭২। মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫২ শতাংশ পুরুষ এবং ৪৮ শতাংশ নারী। স্বাক্ষরতার হার শহরে ৭০ শতাংশ। শিলিগুড়ি পৌর কর্পোরেশনের অন্তর্গত এলাকার স্থানীয় ভাষা বাংলা এবং বিভিন্ন প্রশাসনিক কাজকর্মে ব্যবহৃত ভাষা মূলত বাংলা ও ইংরেজি। শহরের কথ্য ভাষায় বাংলা ছাড়াও বিভিন্ন ভাষার ব্যবহার আছে। বিশেষত হিন্দিভাষী লোকের সংখ্যাও যথেষ্ট।
মাত্র দুই হাজার জনসংখ্যার একটি গ্রামীণ পরিকাঠামো থেকে রাজ্যের দ্বিতীয় মহানগরে উত্তরণ এককথায় অভাবনীয়। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার এবং জনবিন্যাসের পরিবর্তন অনেক পেছনে ফেলে দিয়েছে নগর সম্প্রসারণের পরিমাণকে। এই অস্বাভাবিক দ্রুত বৃদ্ধির পেছনে রয়েছে দেশভাগ পরবর্তী নানা রাজনৈতিক ওঠাপড়ার সমীকরণ। ফলে শিলিগুড়ি পুরনিগমের চ্যালেঞ্জ এখন অনেক এবং বহুমুখী। অনেকেরই প্রশ্ন তাই শহর শিলিগুড়ি আগামীর পথচলায় কতটা নিজস্বতা বজায় রাখতে পারবে! কতটাই বা হয়ে উঠবে 'স্মার্ট সিটি!'
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team