অন্যান্য সম্প্রদায়ের মত আদিম আদিবাসি টোটো সম্প্রদায়ের মধ্যেও প্রচলিত রয়েছে জামাই আদর বা জামাই বরণের প্রথা। এর জন্য এই সমাজের মধ্যে একটি বিশেষ উৎসব প্রচলিত রয়েছে। টোটো সমাজে মুষ্টিমেয় কটি উৎসব অনুষ্ঠান রয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি অনুষ্ঠান হলো এই জামাই বরণের উৎসব। শ্বশুরবাড়িতে কোন জামাই কী ধরণের আপ্যায়ন পাবেন তা নিয়ে জল্পনা হয় এই সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রায় এক মাস ধরে।
পশ্চিমবঙ্গের তিনটি আদিম আদিবাসির মধ্যে অন্যতম একটি আদিবাসি সম্প্রদায় হল এই টোটো সম্প্রদায়। ভূতাত্ত্বিক বিচারে এরা টিবেটো-মঙ্গোলয়েড গোষ্ঠীর একটি শাখা। তারা প্রকৃতির উপাসক। প্রকৃতির বিভিন্ন রূপ কল্পনা করেই চলে তাদের পূজা-পার্বণ-উৎসব। উত্তরবঙ্গের আলিপুরদুয়ার জেলার মাদারিহাট থানার ভারত-ভুটান সীমান্তে টোটোপাড়ার ছয়টি গ্রাম যথা, ১ দুমসিগাঁও, ২ পুজাগাঁও, ৩ মিত্রংগাঁও, ৪ সুব্বাগাঁও ৫ মণ্ডলগাঁও এবং ৬ পঞ্চায়েত গাঁও-এর মধ্যে এদের বসবাস। পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম আদিবাসি সম্প্রদায় এই টোটো সম্প্রদায়। মোট জনসংখ্যা (২০২১) ১৬৩২ জন, পুরুষ ৮৪৮ জন, মহিলা ৭৮৪ জন।
সমতলে যখন দুর্গাপূজার প্রস্তুতি চলে জোর কদমে সেই সময়ে টোটোপাড়ায় টোটোরা ‘আরসিং’ উৎসবের প্রস্তুতিতে মেতে ওঠেন। দুর্গাপূজা চলাকালীন সপ্তমী থেকে নবমী এই তিন দিন টোটোপাড়া আরসিং উৎসবের আনন্দে মাতোয়ারা হয়। হাউরি নদীর তীরে কাশফুল ফুটতেই এই উৎসবের প্রস্তুতি চলে। আরসিং উৎসব টোটোদের কাছে জামাই ষষ্ঠী উৎসব নামে প্রচলিত। টোটো সম্প্রদায়ের জামাই আদরের পরব। শ্বশুরবাড়িতে গেলে জামাইকে কী ভাবে আপ্যায়ন করা হবে, তা নিয়ে জল্পনা চলে এক মাস ধরে।
কী ভাবে পালন করা হয় এই জামাই বরণের উৎসব? কী ভাবেই বা হয় টোটোদের বিবাহ?
টোটো সমাজে প্রচলিত রয়েছে বিচিত্র এক বিবাহ প্রথা। এই সমাজে বাল্যবিবাহ প্রথা প্রচলন না থাকলেও খুব অল্প বয়সেই এদের বিবাহের কথাবার্তা পাকা হয়ে যায়। তবে স্ব-গোত্রে বিবাহ হয় না। আবার নুবি-বে ও দান্ত-বে দুটি আলাদা গোত্র হলেও এদের মধ্যে বিবাহ হয় না। কারণ দুই গোত্রই মাসতুতো ভাই সম্পর্কিত। টোটো বিবাহে কোনও পণ প্রথা প্রচলিত নেই। বিধবা বিবাহ প্রচলিত আছে। সাধারণত এরা এক-বিবাহ প্রথাতেই বিশ্বাস করে। শ্যালিকাকে বিবাহ করার প্রচলন থাকলেও স্ত্রীর বড় বোনকে বিবাহ করা যায় না।
সাধারণত দুই প্রকার বিবাহ প্রথা দেখা যায় টোটো সমাজে। ১ বড় বিবাহ ও ২ ছোট বিবাহ। বড় বিবাহকে টোটো ভাষায় বলা হয় টাবোরাহী। ছোট বিবাহকে বলা হয় তাইপাওয়া। খুব অল্প বয়সে বিয়ের কথাবার্তা পাকা হলেও মেয়েকে তখন বরের বাড়ি পাঠানো হয় না। বর্তমানে মেয়ে সাবালিকা অর্থাৎ আঠারো-উনিশ বছর বয়েস হলে তবেই ছেলের বাড়িতে যেতে দেওয়া হয়। ছেলেমেয়ে ছেলের বাড়িতে স্বামী-স্ত্রীর মতো বসবাস করে। এই ভাবে সন্তানসম্ভবা হলে তখন পাঁচ, সাত বা নয় মাসের মধ্যে তাঁদের আসল বিবাহ হয়। শুভ দিন দেখে বিয়ের অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। টোটোদের এই প্রকার বিবাহে খাওয়াদাওয়ার আয়োজন থাকে। যথেচ্ছভাবে ‘ইউ’ মদ ব্যবহার করা হয়।
এবার বিয়ের পর জামাই শ্বশুরবাড়িতে গেলেই অনুষ্ঠিত হয় জামাই বরণের অনুষ্ঠান আরসিং উৎসব। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছঅ, হাউরি নদীর তীরে কাশ ফুল ফুটতেই এই উৎসবের প্রস্তুতি চলে। জামাই বাড়িতে এলেই তাকে এবং মেয়েকে দেওয়া হয় নতুন পোশাক। দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত চলে পাঁঠা, মুরগি বা শুকরের মাংস রান্নার পর্ব। ভুটান পাহাড়ে যখন সূর্য ঢলে পড়ে সেই সময়ে গানের সুরে বেজে উঠে ঢাক। আর এই গানবাজনার সঙ্গে চলে রাতভর নাচ গান আনন্দ হুল্লোড়। তবে এই অনুষ্ঠানে জামাইদেরও একটি দায়িত্ব থাকে– তাহলো সময় মত ‘ইউ’ মদ তৈরি করা। জল মিষ্টি কিংবা শ্বশুর শাশুড়ির জন্য নতুন কাপড়ের দরকার হয় না। শুধুমাত্র মাড়োয়া দিয়ে তৈরি বিশেষ ধরনের ‘ইউ’ শ্বশুর বাড়িতে নিয়ে গেলেই হল। দুর্গাপূজা চলাকালীন এই তিন দিনের মধ্যে বা কোনও একদিন ভোরে স্ত্রীর হাতে ‘ইউ’ দিয়ে শ্বশুরবাড়ি পাঠানো হয়। বাড়িতে ‘ইউ’ পৌঁছালে বাড়ির লোকজন ধরে নেন ওই দিন জামাই আসছে। সকাল থেকেই প্রস্তুতি চলে জামাই আদরের জন্য। একটা আনন্দের পরিবেশ তৈরি হয় বাড়িতে। কোনও জামাই এই আরসিং উৎসবে না এলে সেটা দুর্ভাগ্যজনক বলে মনে করা হয়। জামাই আদরের জন্যই এই সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে এই বিশেষ উৎসব প্রচলিত রয়েছে।
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team