বর্ষার সমাপ্তি ঘোষণা করতেই শরতের আবির্ভাব ঘটে। ভাদরের ভ্যাপসা গরম আর ভাইরাল ফ্লু-র পাঁচিল ডিঙ্গিয়ে বাংলায় প্রতিবার আশ্বিন আসে, অবিরাম জলধারার ওপার থেকে বয়ে আনে টুকরো মেঘেদের নীলাকাশ ও সাদা কাশবনের সেই শাশ্বত ল্যান্ডস্কেপ, আর সুদিনের প্রতিশ্রুতি। এবারও শরতে উত্তরের জন্য আছে নানান মিশ্র খবর। যেমন মাঠে পাট ও ধানের ফলন এবার চাষিকে হতাশ করবে না শোনা যাচ্ছে, যদিও অতিরিক্ত বর্ষণ সবজি ফলনের জন্য খুব একটা সুখকর নাও হতে পারে বলে আশঙ্কা! চা বাগান শ্রমিক পরিবারের লাখ পনের মানুষের জন্য নতুন কোনও খবর অবশ্য আপাতত নেই, তবে উত্তরের কৃষির সঙ্গে জুড়েছে এবার শিল্প সুসংবাদ। মুখ্যমন্ত্রীর সাম্প্রতিক বিদেশ সফরে স্পেন থেকে বিনিয়োগ এসে শিলিগুড়িতে ইথানল প্ল্যান্ট এবং নিউজলপাইগুড়িতে কংক্রিট স্লিপার ফ্যাক্টরি গড়বার সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। খবর আছে উন্নয়নেরও। রাজ্যের কৃষি বিপণন মন্ত্রী এসে নাকি ডুয়ার্সের রাস্তায় ঝাঁট দিয়ে একাধিক সলিড ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট প্রজেক্টের উদবোধন করে গিয়েছেন! সাধু সাধু!
ওদিকে শরৎ এলেই হই হই করে শুরু হয় উত্তরের পর্যটন শিল্প। উত্তরবঙ্গ সংলগ্ন সিকিমে এসে বাইরের ব্যবসায়ীদের হোমস্টে-র ব্যবসা করা আর চলবে না, সে রাজ্যের সরকার কড়া আইন করে দিয়েছেন। কারণ হোমস্টের জনপ্রিয়তা হোটেল বাণিজ্যের ক্ষতি করছে, ফলে সরকারি রাজস্ব আদায় কমে যাচ্ছে। সিকিমে আইন মানে আইন, সবাই মেনে চলে। আমাদের বাংলার পাহাড়ে সেসব নিয়ে অবশ্য এখনও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত নন কলকাতার খুচরো পর্যটন কারবারি কিংবা হোমস্টে-তে বিনিয়োগকারীরা, এখানে আইন থাকলেও কাঁচকলার কদরই বেশি। যেমন আইন করে পাতলা মাইক্রনের প্লাস্টিক বন্ধ হয়েছে, তারও অনেক আগে গুটখা-পানমশলা বিক্রি বন্ধের আইন হয়েছে এ রাজ্যে!
সে যাই হোক, উত্তরের পর্যটন শিল্পে জোয়ার আছে এবারও, মহালয়ার পরদিন থেকেই ট্রেনের ওয়েটিং লিস্ট তিন অংকে আর বিমান ভাড়াও পাঁচ অংকে পৌঁছল বলে। ওদিকে সিকিমের পাকিয়াং এয়ারপোর্ট ফের খুলবার খবর মিলেছে, দিল্লি-গ্যাংটক বা কলকাতা-গ্যাংটক আকাশ যাত্রার টিকিটমূল্য ইতিমধ্যেই আকাশ ছুঁতে চলেছে। বিমানের পর্যটকেরা এবার কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলছেন, যাক এবার বাগডোগ্রার ভয়ানক চাপটা বোধহয় খানিক কমবে, ওফফ! কারণ ওদিকে কোচবিহার বিমানবন্দরেও দ্বিতীয় বিমান পরিসেবা শিগগিরি চালু হবার কথা জানিয়েছে সংবাদ মাধ্যম। আর আকাশপথের সঙ্গে পাল্লা দিতেই যেন সিকিমের ট্রেন পরিসেবাও আগামী বছর শুরু হয়ে যাচ্ছে বলে ঘোষণা করেছেন রেল দপ্তর। আটত্রিশটি টানেলের মধ্যে দিয়ে পঁয়তাল্লিশ কিমির এই পাহাড়ি রেলযাত্রার রোমাঞ্চ দার্জিলিঙের খেলনা রেল ঐতিহ্যকে বা ডুয়ার্সের গ্রিন গ্ল্যামারকে কতোটা ম্লান করে দেবে তা আগাম বলা কঠিন, তবে এতে সিকিমের সঙ্গে আমাদেরও বুক যে গর্বে বেশ কয়েক ইঞ্চি বেড়ে যাবে তা বলাই বাহুল্য। হাজার হলেও তো প্রিয় প্রতিবেশি, আমরা আছি বলেই তো ওরা আছে! ওরা আছে বলেই তো আমরাও!
এইসব ভালো খবরের মধ্যেই অবশ্য মন খারাপ করে দেয় এদিক ওদিক কিছু দুর্নীতির খবর। যেমন, উত্তরের এক সমবায়ে ছাপোষা মহিলাদের জমানো পঞ্চাশ কোটি টাকা নাকি উধাও, বছর দুয়েক হয়ে গেল সে দুর্নীতির কোনও কিনারা হচ্ছিল না বলে বিরক্ত উচ্চ আদালত নির্দেশ দিয়েছেন সিবিআই তদন্তের, পঞ্চাশ লক্ষ মুদ্রা নাকি ফাইন করে দিয়েছে সরকারকে! তেমনই, এখানকার এক মেডিকেল কলেজে ধরা পড়া দুর্নীতি নিয়েও নাকি সরকারি তদন্ত শুরু হয়েছে। স্থানীয় সাধারণ মানুষ তো আজকাল নিজেদের মধ্যেই আলোচনা করছেন, চুরিচামারি টুকটাক তো চিরকালই ছিল, প্রশ্রয়ও ছিল আগাগোড়াই, কিন্তু উত্তরবঙ্গে সেসব কোনওকালে এমন মাত্রাছাড়া হয়েছে কি? নাকি আগেও হতো কিন্তু জানাজানি হতো না, তার কারণ উত্তরবঙ্গের খবর স্থান পেত কম? এখন কি তবে উত্তরবঙ্গ আগের চাইতে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে? কে জানে?
এইসব বিচিত্র সংবাদের মধ্যেই শরৎ উঁকিঝুকি দিচ্ছে। বাজার জমে উঠবার অপেক্ষায় দিন গুনছেন দোকানিরা, একবুক আশা নিয়ে ব্যস্ত গোছগাছ চলছে সবার। গতবারের ঘাটতি কি এবার আদৌ পুষিয়ে যাবে? ডিএ নেই তবু কি ঘুরে দাঁড়াতে পারবে বাংলার খুচরো বাজার? বাড়িতে বুড়ো মা-বাপ দিন গুনছে, ভিনদেশ থেকে ছেলেদের কি এবার ঘরে ফিরবার ছুটি মিলবে? উচাটন তরুণী প্রেমিকার মন, আগের মতো সবাই মিলে যাওয়া হবে কি আবার পুজোর কেনাকাটায়? বাইকের পিঠে একদিন জঙ্গলের পথে জয়ন্তি কিংবা বিন্দুঝালং? আসলে আশ্বিনের আবির্ভাব লক্ষ কোটি মানুষের মনে হাজার ওয়াটের আলো জ্বালুক এটাই আমাদের কামনা। মানুষ আবার আগের মতই হেসে উঠুক এটাই প্রার্থনা। তবে এটাও ঠিক, শরৎ মানেই কিন্তু এবার পুজো নয়! পুজো আসছে আমাদের পরের সংখ্যায়!
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team